গার্মেন্টসের নামে গাড়ি ভাড়া করে বিক্রি করা একটি চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন রেন্টে কার বা ব্যক্তির কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া করে চক্রটি। পরে তা গাড়ির মূল মালিকদের অগোচরে বিক্রি করে টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেয় তারা। সম্প্রতি এমন ২২ টি ভাড়া করা গাড়ি অবৈধ ভাবে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে নগদ ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিক্রি করে আত্মগোপনে চলে যায় প্রতারক চক্রটি।
সংঘবদ্ধ গাড়ি প্রতারক চক্রের হোতাসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এলআইসি শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগের সিআইডি প্রধান কার্যালয় সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ওই ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো, মো. আব্দুল কাইয়ুম ওরফে ছোটন ওরফে ইসতিয়াক ওরফে মেহেদী হাসান (৩২), আ. আলী মিজি ওরফে আ. হাই (৪৬), মো. নাজমুল হাসান (১৯), মো. সানি রহমান (২০), মো. সাজরাতুল ইয়াকিন রানা (৩৩), আলমগীর শেখ (৪৮) ও মো. সেলিম (২৭)। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ৭টি গাড়িও উদ্ধার করা হয় সে সময়।
এলআইসি শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে গার্মেন্টস কোম্পানির নামে গাড়ি ভাড়া করে প্রতারণার মাধ্যমে অন্যত্র বিক্রি করে আসছে। এমন একাধিক ঘটনা সিআইডির নজরে আসে। এরই প্রেক্ষিতে সিআইডি’র এলআইসি শাখা ছায়া তদন্ত শুরু করে।
তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যায় যে, মো. আব্দুল কাইয়ুম ওরফে ছোটন ওরফে ইসতিয়াক ওরফে মেহেদী হাসান ও তার চক্রের অন্যান্য সদস্যরা জিএমপির গাছা থানাধীন একটি চারতলা ভবনের ৩য়-৪র্থ তলায় স্থাপিত এ.কে ফ্যাশনস পোশাক কারখানার নামে মোট ২২ টি গাড়ি ভাড়া করে। পরবর্তীতে গাড়ির মূল মালিকদের অগোচরে প্রতারণার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে গাড়িগুলো অবৈধ ভাবে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রয় করা হয়। গাড়ি বিক্রির নগদ ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারক চক্রটি আত্মগোপনে চলে যায়। গাড়ির প্রকৃত মালিক তাদের গাড়ি ও প্রতারক চক্রের কোথাও কোনো সন্ধান না পেয়ে হোতা কাইয়ুম ও তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা করে। এরই প্রেক্ষিতে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখার এক পর্যায়ে প্রতারক চক্রকে চিহ্নিত করা গেলে মানিকগঞ্জ পৌরসভার শহীদ রফিক সড়কে অভিযান চালানো হয়।
এ সময় আলী মিজি ও নাজমুল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও প্রায় ১৫ লাখ টাকা মূল্যের প্রতারণার মাধ্যমে নেওয়া একটি সেলুন টয়োটা প্রাইভেট কার যার উদ্ধার করা হয়। ওই দুজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ দুস্কর্মে তাদের প্রধান সহযোগী সানি রহমানকে দিনাজপুর এলাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী রংপুর শহরস্থ শাপলা চত্বর এলাকা থেকে সাজরাতুল ইয়াকিন রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসময় একই উপায়ে নেওয়া প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার মূল্যের সাদা রংয়ের ‘এক্সিও’ প্রাইভেট কার উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে, গ্রেপ্তারকৃতরা প্রতারণার ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানী উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে আরো প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ৪টি চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাই পূর্বক খুলনার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে, আত্মগোপনে থাকা প্রতারক চক্রের মূল হোতা আব্দুল কাইয়ুমকে আমরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।
মুক্তা ধর বলেন, আব্দুল কাইয়ুম গাজীপুরে একটি প্রত্যাশা নামক একটি এনজিও’তে চাকরি করতেন। সেখানে আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতার কারণে তার চাকরি চলে যায়। এরপর তিনি গাজীপুরের গাছা থানাধীন একটি ৪ তলা বাড়ির ৩য় ও ৪র্থ তলায় এ কে ফ্যাশনস নামে পোষাক কারখানা স্থাপন করেন। সেখানে তিনি নামমাত্র বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় ২১০ শ্রমিককে নিয়োগ দেন।
চলমান করোনা ও লকডাউনের মধ্যে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসায় বিদেশি ক্রেতাদের পরিবহনের কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ২২ টি গাড়ি ভাড়া নেন। পরবর্তীতে গাড়ির মূল মালিকদের অগোচরে প্রতারণার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে গাড়িগুলো অবৈধ ভাবে বিভিন্ন ক্রেতার নিকট বিক্রি করে দেন। এরআগে তিনি প্রত্যেকটি গাড়ীর জিপিএস সিস্টেম অকেজো করে দেন। গাড়ি বিক্রির নগদ তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারক চক্রটি আত্মগোপনে চলে যান।
এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তা ধর বলেন, আব্দুল কাইয়ুম ছোটনের এই গার্মেন্টস স্থাপনের মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। অর্থাৎ এই স্বল্প সময়ে পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করা যায়না। মূলত: প্রতারণার জন্যই তিনি গার্মেন্টস ব্যবসাকে কাজে লাগান। যখন প্রতারণার বিয়ষটি ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন তখন তিনি যাদের কাছে গাড়ী বিক্রি করেছেন তাদের ঠিকানা দেন। আমরা ভুক্তভোগী ও অন্য আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি, চক্রটি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি গাড়ী ভাড়া নিয়ে প্রতারণা করেছে। তিনি শুধু ভুক্তভোগীদের সাথেই প্রতারণা করেননি, তিনি যাদের কাছে গাড়ী বিক্রি করেছেন তাদের সাথেও প্রতারণা করেছেন। প্রতারক ছোটনের ফাঁদে নিজের গাড়ী খুইয়েছিলেন রাজধানী ধানমন্ডির অনু চৌধুরী। তিনি বলেন, বিজ্ঞাপন দেখে গার্মেন্টেসের বুদেশী ক্রেতাদে পরিবহনের জন্য আমার এক্স করোলা মোডেলের গাড়ীটি মাসিক ২৭ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়া হয়। কিন্তু এক মাসের ভাড়াও পাইনি। গাড়ীটি নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় প্রতারক ছোটন। পরে ধানমন্ডি থানায় অভিযোগ করি। সিআইডি’র সহযোগীতায় সে গাড়ীটি ফেরত পেয়েছি।
ভুক্তভোগী মিরপুরের বিউটি আক্তারও তার এক্সিও গাড়ীটি দেড় মাস পর ফিরে পায়। তারা দুজনই সিআইডিকে ধন্যবাদ জানান।
মুক্তাধর বলেন, এ ধরনের প্রতারণার সাথে জড়িত অন্যান্য প্রতারক চক্রের সন্ধানসহ মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে সিআইডি’র অভিযান ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।