নীলরঙ প্রজাপতি
আমজাদ হোসেইন
খুব রাগ হলো নিজের উপর । যে কথা বলার জন্যে প্ল্যান করে রিডিং-রুমে আব্বুর কাছে গেলাম, তা-ই বলা হলো না । রাত বারোটার বেশি বাজে । থোম ধরে বসে আছি বিছানার উপর । দেয়াল-ঘেঁষে রাখা লাগেজের উপর চোখ পড়লো । সঙ্গে সঙ্গে রাগ আরো বেড়ে গেল । কাল সুযোগ পাবো না । এজলাসের দিন, সকাল বেলা আব্বু ব্যস্ততা ফেলেই অফিসে দৌড়াবেন । পরে একা আম্মুর সামনে লাগেজ খুলে শাড়ির প্রদর্শনি করে লাভ নেই । এ রকম বহু শাড়ি তার অয়্যারড্রবের তলায় অযত্নে পড়ে আছে । মেয়ের শ্রমের টাকায় প্রথম কেনা আনন্দ– আম্মু বুঝবে না । বুঝতে হলে আব্বুর ডিকসনারি পাঠ করতে হবে তাকে । তাহলে ?
প্রথমে কিছু ভেবে পেলাম না । তারপরেই আব্বুকে ফোন দিয়ে বললাম, তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন ? এ-এ-ই শুয়ে পড়বো ভাবছি । কি ব্যাপার মা ? আমার রুমে একটু আসতে পারবে ? আসছি । এরপরে আম্মুকে ফোন করতেই ভেজালে পড়ে গেলাম ।
আম্মু ফোন কানে ধরেই বললো, ফোন করেচিস কেন ? কত দূর– চলে আয় । আমি এখন আসতে পারবো না আম্মু । তুমি আসো ।
আম্মু বললো, তাহলে একটু পড়ে আয় । কথা আছে । কতদিন পরে তুই বাসায় এলি, ভালোমত একটু কথাও বলতে পারলাম না । কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, কেউ তোরা আমার সাথে কথা বলতে চাস না, কেন– বত্রিশ বৎসর পর কি দোষ করেছি আমি ?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমি রাখছি । তোমার কথা পড়ে শুনবো । তুমি আসো । ফোন কেটে দিলাম । আম্মু এমন প্রগলভ ছিলেন না । প্রয়োজন ছাড়া তিনি বাসার কারো সাথে কথা বলতেন না । ছয়মাস পর বাসায় এসে দেখি কত পরিবর্তন । শালকাঠ নরম হয়েছে। পারফেক্ট কেমিক্যাল রিএ্যাকশন । ধন্যবাদ আব্বু । আমার হাসি পাচ্ছে, খুশিও লাগছে । এতদিনে এ সংসারের দক্ষিণা-জানালা খুলে গেল বোধহয় । ঠান্ডা হাওয়ার পরশ পাচ্ছি । অপেক্ষা করতে লাগলাম, দেরী হবেনা সিওর ; এখুনি হয়তো আম্মু এসে আমার রুমে ঢুকে বকা-ঝকা শুরু করে দিবেন । কিন্তু আব্বুই আগে এলেন । দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, আসবো মা ? আমি হাত ধরে নিয়ে এসে আব্বুকে চেয়ার বসিয়ে দিলাম । তাঁকে উৎসুক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, তুমি রমেশ মৈত্রকে চেনো? রমেশ মৈত্র– কোন্ রমেশ মৈত্র ?
আগামী কাল তোমার কোর্টে যিনি জবানবন্দি দেবেন । আচ্ছা-আচ্ছা, তিন-চারদিন আগে এনএসআই’র একটা রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে ডিসি অফিসে পৌঁছেছে । সেখানেই নামটা দেখেছি । আমি তাকে চিনিনা । ভারতের কম্যুনিষ্টি পার্টির সম্মেলনে তিনি কেন যাচ্ছেন বিশেষ নিরাপত্তা আইনে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলা হয়েছে । তারপর আব্বু অনেকটা অবজ্ঞার সুরে বললেন, মশা মারতে কামান দাগা আরকি । আমি আমার মতো করে থানাকে বলেছি । কেন রে মা, তুই এ কথা জানলি কোত্থেকে ? বললাম, বাস থেকে উনাকে তোমার কথা বলে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল । ওল্ডার জেন্টেলম্যান ।আব্বু বললেন, এ সব জ্ঞান পাপী লোক । গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল । দামী-দামী রাষ্ট্রনীতির কথা বলে । রাজনীতি ও সরকারের সমালোচনা করে । আন্তর্জাতিকতাবাদে ওরা একসময় সসস্ত্র বিপ্লবের কথাও বলতো । এখন সাধারন মানুষ আর ওদের রিলাই করেনা । আমি হাবার মতো প্রশ্ন করলাম, উনার কি জেল-টেল হতে পারে আব্বু ? আরে নাহ্ । সম্মেলনে তিনি যেন সময় মতো পৌঁছাতে না পারেন– এ শুধু তারই একটা বেরিয়ার । এক সেন্সে সরকারের পোষ্য এরা । রাজনৈতিক অলঙ্কার । সরকার এদেরকে কখনো ছাড়েও না, ধরেও না ।
আমি রাজনীতির এসব মারপ্যাঁচ বুঝিনা । সহজ ভাবে বললাম, রমেশ মৈত্র একজন ভালো মানুষ আব্বু । লেখক । আব্বু বললেন, এরা এ ধরনেরই হয় । থ্যাঙ্ক ইউ আব্বু, তোমার কাছ থেকে আস্বস্ত হলাম যে, উনার কিছু হবেনা । আব্বু অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিনে তুই এই রমেশ মৈত্রকে নিয়ে এভাবে এত মেতে উঠলি কেন ? আমি হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, সেই সময় আম্মু প্রবেশ করলো ঘরে । তার চোখে ঘুম-ঘুম ভাব । আব্বুকে দেখে অবাক হলো । হাই তুলতে-তুলতে বললো, ফোন করে আসতে বললি আমাকে– আর এসে দেখলাম এসেছে তোর বাপ । দেখালি বটে । কী যে হয়েছে আমার, খালি ঘুম আসে । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । হুট করে মনেহলো তুই না ফোন করেছিলি ? চলে এলাম । তো রুমে মেলা বসিয়েছিস কেন বল্ । আম্মুকেও আমি হাত ধরে বিছানায় আব্বুর পাশে বসিয়ে দিলাম । বললাম, চুপকরে এখানে বসে থাকো । আমি যাদু দেখাবো ।
লাগেজ খুলে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো নুতন গামছার মতো দুইটা বান্ডিল বিছানার উপর রেখে বললাম, খোল ।
আম্মু প্রশ্ন করলো, কি এগুলা ? এবং সাথে সাথে একটা বান্ডিল খুলে আব্বুর পাঞ্জাবীর কাপড় বিছানায় ছড়ায়ে ফেলে আবার প্রশ্ন করলো আম্মু, কী এটা ? আমি বললাম, আব্বু বলো । মারভেলাস মা ! আমার গায়ে মানাবে বেশ । আম্মু এবার দ্বিতীয় বান্ডিল খুলে তৃতীয় বারের মতো একসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন করে বসলো, শাড়ি ? কার– তোর, না আমার ? খুব সুন্দর তো ! আব্বু ভ্রু-কুঁচিয়ে বললেন, তুমি আসলেই একটা গাধা । ছোটলোকও বলা যায় । তোমার মেয়ে কি শাড়ি পরে নাকি ? আম্মু খিল খিল করে হেসে উঠলো । বালিকার মতো । আনন্দিত হয়ে বললো, আমার খুব পছন্দ হইছে রে মা । দোগাছির মেটে তাঁতের শাড়ি ? আমার কখনোই পরা হয়নি ।
আম্মুর এই রকম উচ্ছসিত হাসি আমি প্রথম দেখলাম । আব্বুর কোন কথায় অথবা রসিকতায় কখনো আম্মুকে আমি হাসতে দেখিনি । অথচ আজ বকা খেয়েও আম্মু এইরকম প্রান খুলে হাসলো ।এই খিলখিল-হাসিতে আম্মুকে দেখতে যে কী সুন্দর লাগে– আম্মু কি তা জানে ? হাতি ছোট চোখের কারণে নিজের সৌন্দর্য্য দেখতে পায়না । সত্যি কথা । আমি দু’জনকে মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম । জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা এখন কি করবে ? আম্মু বললো, ঘুমবো । আব্বু বললেন, দু’একটা ফাইল দেখার চেষ্টা করবো । এসেনশিয়াল ?
নট ইয়েট । আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তাহলে তোমরা এসো আমার সাথে ।
আগে আগে হেঁটে করিডোরের অপর প্রান্তে আম্মুর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি । দেখলাম, আম্মু-আব্বু দু’জনে দু’ভাগ হয়ে দু’জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন– আমি কি বলি, সে জন্যে । দু’জনকেই স্ট্রেইট আম্মুর দরজা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ঢোকো । নো হাঙ্কি-বাঙ্কি । ভাগ্য ভালো যে, তোমাদের বিয়ের সময় আমি ছিলাম না ; নইলে তখনই দুইজনের বাঁকা ঘাড় সোজা করে দিতাম ।
আব্বু হো হো করে হাসতে লাগলেন । আম্মুর দিকে তাকিয়ে হাসছেন তিনি । আমি বললাম, মীন করে হেসো না তো আব্বু– তুমি তালকানা মানুষ, একা মনোহরদীপুর যেতে পারবে না ; আম্মুকে সঙ্গে নিতে হবে । কতদিন পরে, কবে, কিভাবে তোমরা যেতে পারবে, এখন থেকেই সেই ভাবনা শুরু করে দাও । আম্মু সাথে সাথে বলে দিল, আমি মনোহরদীপুর যাবোনা । আমি বললাম, অবশ্যই তুমি যাবে । তোমার বাপ যাবে । এবার আব্বু কান-ফাটা হাসি শুরু করলো । কিছুতেই সে হাসি আর থামেনা তার । আম্মু রেগে-মেগে টং। মেজাজ খারাপ করে সোজা বিছানায় গিয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল ।
আমিও হেসে ‘গুড নাইট’ বলে আমার রুমে চলে এলাম । টেনশনই যে শুধু ঘুম বিলম্বিত করে তাই নয় ; আনন্দও নির্ঘুমকে প্রলম্বিত করে– বুঝতে পারলাম । গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম । বেশ বেলা হয়েছে । ন’টা বাজে । ঘুম থেকে উঠে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম ।
বাইরে কুয়াশা তেমন নেই । না রোদ, না ছায়া অবস্হা । ঠান্ডা প্রচুর । জানালায় দাঁড়িয়ে একটা অভাবিত দৃশ্য দেখে অবাক হলাম ।
আমাদের বাসার নুতন ছেলেটি পাঁচিল ঘেঁষে কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে । এই ঠান্ডায় তার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি । পরনের লুঙ্গি ভাঁজ দিয়ে খাটো করে পরা । দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিলো ঘামে তার গেঞ্জি ভিজে জবজবা । চারকোনা সমান করে অনেকখানি জায়গা সে ইতোমধ্যে কোদাল দিয়ে চষে ফেলেছে । আমার জননী মাফলার-টাফলার দিয়ে কান-মাথা ঢেকে তার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে ।
আম্মু মন্ত্রীর মেয়ে । কৃষকের নয় । সে কৃষি কাজের কিছুই জানেনা । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা । ফটক দিয়ে ঢুকে গাড়ি বারান্দার সামনে বিশাল গোল চত্বরে হরেক রকম ফুল গাছের সমাহার । পরিকল্পিত বাগান । কোথাও নুতন করে আর বাগান করার প্রয়োজন পড়েনা । আমার ধারণা, উত্তর-পূর্ব কর্ণারে পাঁচিল ঘেঁষে যে জায়গাখানি প্রস্তুত করা হচ্ছে, তা ফুলের জন্যে নয় ; তরুলতা অথবা সব্জি চাষের জন্যে । আমি ভেবে পাচ্ছিনে, কী ভাবে সম্ভব– আম্মুর মাথায় এ ধরনের বুদ্ধি আসবার কথা নয় । মরে গেলেও সে এরকম কিছু কখনো ভাবতে পারবেনা । সরকারি রেসিডেন্সে বসবাসকারী সুখি গৃহিণীরা সুযোগ পেলে মনের আনন্দে এই সব কাজ করে থাকে । কারো কারো কাছে এটা একটা নেশা । অভ্যস্হতাও হতে পারে । আমার আম্মুর স্বভাবে এ সবের বালাই নেই । কোনদিন ছিলওনা ।
তাহলে ? তাহলে কি আম্মু সুখি গৃহিণীদের তালিকায় তার নামটি শেষমেষ লেখাতে পারলো ? তাড়াহুড়া করে আম্মুকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাইলাম আমি । কিন্তু এখনো ফ্রেস হইনি । সবে বিছানা ছেড়ে ঘুম কাতুর চোখে জানালায় দাঁড়িয়েছি । একটু এগিয়ে দরজার ওপাড়ে গিয়ে গলা চড়িয়ে বক্কারের মা’কে বললাম টোস্টের সাথে চা দিতে ।রোবটের মতো আমি ওয়াশ রুমে ঢুকলাম ।
অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত স্পটে আম্মুকে ধরতে পারলাম না । আম্মু দৃশ্যপটে নেই । ছেলাটা তখন একা মনোযোগ দিয়ে ফুলফোর্সে মাটি কুপিয়ে যাচ্ছে । ছেলেদের কাজ ; দেখার কি আছে । তবু মনেহয় গ্রাম-দেশের যে কাজ এখনো কাছে থেকে দেখা হয়নি আমার, তা দেখার মধ্যে একটা আনন্দ আছে । কৌতূহল তো আছেই । আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে । আমাকে দেখে ছেলেটা ভাঁজকরা লুঙ্গি ছেড়ে দিল । চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল । জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি ? আমার নাম বাদশা আপা । বাড়ি কোথায় ?
বাড়ি ঝিকরগাছা আপা । বক্কারের মা’কে চেনো ? বাদশা অবাক হয়ে বললো, বক্কারের মা কিডা ?
প্রসঙ্গ স্হগিত করলাম । আমার ধারণা ছিল, ঝিকরগাছার মানুষ আটি বেঁধে সদরে কাজ করতে আসে । বাদশাও এসেছে তেমনি ।
জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি অন্য সময়ে কি করো, শুধু এই কাজের জন্যে কি এই বাসায় এসেছ ? বাদশা হেসে বললো, আমি উমেদার আপা।স্পষ্টই তো শুনলাম– ‘উমেদার’ । উমেদার মানে কি– বুঝলাম না । আমার হাসি পাচ্ছিলো । মনে হচ্ছিলো ‘উমেদার’ মানে হলো জমিদারের বড় ভাই । অবশেষে অনেক কথা খরচ করে আমাকে ‘উমেদার’ মানে বুঝতে হলো । এক কথায় বললে উমেদার হলো হুকুমের চাকর । বেতন নেই । বকসিস আছে মেলা । বাদশা এটাকে পারিশ্রমিক বলতে নারাজ । তার কথা, পারিশ্রমিকের মধ্যে সন্মান কম । উমেদারী হলো সন্মানিত বিষয় । সবাই উমেদার হতে পারেনা । যোগ্যতা লাগে ।
বাদশারা চার ভাই । বাদশা, শাহেনশাহ্, সুলতান ও সম্রাট । চার ভাই-ই ডিসি অফিসের উমেদার । সেখানে কোন না কোন অফিসারের হুকুমে তারা উমেদারী করে । বাদশা জানালো, আল্লাহ’র রহমতে তাদের ভাল চলে । কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ বাদশার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম । একটু অবাকও হলাম । মনে মনে হয়ত অযথাই কিছু ভাবছিলাম– নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না । তবে কর্মের প্রতি এদের সন্তষ্টিবোধ দেখে আমার ভালো লাগছিল । বাদশার মুখের দিকে চেয়ে বললাম, এই জায়গায় তোমরা কি করবে বাদশা ? বাদশা উৎফুল্ল হয়ে বললো, এখেনে মনেহয় ধাইনে মরিচ, ঢ্যাঁরোস আর বাগুন লাগাবি আম্মা । কথাটা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল । এইটা কি বললো বাদশা । এত কষ্টের ফলের নাম আতাফল ? আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো না বাদশার সাথে ।
ফিরে আসবার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম, দেখি– হণ্ হণ্ করে আম্মু আমাদের দিকে হেঁটে আসছে । দাঁড়িয়ে গেলাম । আম্মুকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো । প্রথম কথাই হেসে বললো, সিমি, দেখ তো মা কেমন হবে, এখানে শাইখ সিরাজের অনুকরণে যদি একটা আঙ্গুর বাগান হয়? খুব সুন্দর হয় আম্মু । এক্সিলেন্ট হয় । আমি বললাম । দেখলাম, বাদশার মাথা নিচু হয়ে গেল । আম্মু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাদশাকে নির্দেশ দেওয়া হলো, বাদশা, এখন তুমি যাও । ঘরে খাবার দেওয়া হয়েছে । খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নেওগে ।
বাদশা মাটির দিকে তাকিয়ে বিদায় হলো ।
আম্মু আরো আরো কি কি যেন সব বলছিল– আঙ্গুরের চারা কোথায় পাওয়া যাবে, কি কি সার– কি পরিমাণ দিতে হবে, জৈব কীটনাশক কি জিনিস, কি ভাবে বানাতে হয়, কখন দিতে হয় ; অফ সিজন ফুল সিজন– ইত্যাদি ইত্যাদি । আম্মুর কথায় আমার মন ছিলনা । মন ছিল অন্য কোথাও । কিন্তু আমি বললাম আর এক কথা– গতকাল রাতেই যা ভেবে রেখেছিলাম । এবারের আমার যশোর মিশন সফল । অযথা আর বাসায় বেকার-বাস কেন ; ঘুম যতো বেলা করেই ভাঙুক, ভেবে রেখেছিলাম– সকালের নাস্তা সেরেই চলে যাবো । বত্রিশ বৎসর পর শিশুরা হাঁটা শিখেছে । একাই হাঁটুক । মাঝখানে অবলম্বের খুঁটে আর না হয়ে থাকাই শ্রেয় ।
সুযোগ পেয়ে আম্মুকে আমি সে কথাই বললাম, আম্মু, চলো তো– আমাকেও খেতে দেবে । খেয়ে-দেয়ে আমি আর বিশ্রাম নেবোনা, চলে যাবো । কোথায় যাবি ? ভার্সিটীতে । কোথায় ? আমি হেসে দিয়ে বললাম, ভার্সিটীতে । আম্মু রুখে দাঁড়ালো, বললেই হলো ? মামুর বাড়ির আব্দার । আমাদের অপরাধ ? আমি আদুরে গলায় সোজা-সাপ্টা বললাম, তোমাদের অপরাধ তোমারা সুস্হ হয়ে উঠেছ ।
আমরা অসুস্হ ? হান্ড্রেড পার্সেন্ট । আম্মু তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল । আমি বললাম, কি অসুখ ছিল তোমাদের শুনবে ? চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে রইল আম্মু । বললাম, খুব পচা অসুখ । ইগো । জীবনে সারেনা । এই অসুখে মানুষ মরেনা, জীবন্মৃত হয়ে থাকে । ভাগ্য ভালো যে, আব্বুর ধন্বন্তরীতে সুস্হ হয়ে গেছ । আম্মু করুণ কন্ঠে বললো, আর দুটো দিন থেকে যা মা– একটু বানিয়ে মিথ্যে কথা বললাম, সম্ভব নয় ; ক্যাম্পাসে একটা ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিনা, খুঁজে পাওয়া খুব জরুরী । আম্মু অবাক হয়ে বললো, সেই ছেলেকে দিয়ে তুই কি করবি ? আমি দীর্ঘদিন ধরে ওকে ওয়াচ করছি । আম্মু বিরক্ত হয়ে বললো, কি করছিস ? ওয়াচ করছি । আম্মুর মন খারাপ হয়ে গেল । আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, প্রেম-ট্রেম করছিস না তো ?
আমার খুব ভালো লাগলো কথাটি শুনে– ‘প্রেম-ট্রেম করছিস না তো ?’ আম্মু কত সহজ হয়ে গেছে এখন ! হাসলাম । কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বললাম, তোমাকে কথা দিচ্ছি আম্মু, জীবনে কখনো কোন ছেলের সাথে আমি প্রেম করবো না । তিন সত্যি করলাম । তবে আমি লাইফ পার্টনার খুঁজে নেবার স্বাধীনতা চাই । আম্মু বললো, তুই যদি ফকির-টকির চয়েস করে বসিস ? আমি বললাম, হতেও পারে । কিন্তু স্বাবলম্বি হবার মুরোদ থাকতে হবে তার । জমিদার হলে চলবে না । তোর কথা-টথা আমি ছাতা কিচ্ছু বুঝতে পারতেছিনা । ঘাড়ে ভূত উঠেছে ? আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম । বললাম, শোন কাব্যি করে বলি, যে ছেলের মধ্যে পাখি বাস করে– পাখির মতো খাবার যোগার করে খায়, যে ছেলের মধ্যে পিঁপড়ের স্বভাব– ভবিষ্যৎ মজুদ করে রাখে, যে ছেলে উঁই পোকার বাসা বানাতে পারে আর মরে গেলেও যে ছেলে ফিনিক্স পাখির মতোন আবার তাজা হয়ে উঠতে পারে– আমি সেই ছেলেকে লাইফ পার্টনার বানাবো । নাহলে ওসব পার্টনার-ফার্টনার বাদ । কোনও দরকার নেই । আম্মু আমার উপরে চরম বিরক্তই শুধু হলো না ; ক্ষেপেও গেল । বললো, তোকে মেন্টালে ভর্তি করে দেব । কাছেই তো । পাগল ছাতা । এখন খাবি আয় । আগে আগে হাঁটতে লাগলো আম্মু । আমি পিছে পিছে।