বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি যেন এলোমেলো সময় পার করছে। অগোছালো রাজনীতির ভারে দলটি ডুবে গেছে অনেকটা। কখন কী করবে, কে কী বলবে, বোঝা মুশকিল। বুদ্ধিদীপ্ত, গঠনমূলক রাজনীতি থেকে বিএনপির অবস্থান যোজন যোজন দূরে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, আগের সেই বিএনপি আর বর্তমান বিএনপির সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাৎ। একসময় বিএনপির রাজনীতিতে ছিল ক্ষিপ্রতা, ছিল চমকে ভরপুর। কিন্তু বর্তমানে দলটিকে দেখে মনে হয় বয়সের ভারে ন্যুব্জ, বসন্ত যেন অতীত। শীতের রুক্ষতায় একে একে ঝরছে পাতা। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘ সময় পার করছে দলটি। অনেক সময় গৃহীত সিদ্ধান্তেও অটল থাকতে পারছে না। অহেতুক পরিস্থিতি জটিল করে ফেলছে। সহজ-সরলভাবে চিন্তার ক্ষমতাও যেন লোপ পাচ্ছে। নেতারা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। একে-অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত ফলাফলের পর বিএনপিতে নেমে এসেছে হতাশা। এমন ফলাফলের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না দলটি। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পেলেও একটি সম্মানজনক অবস্থান থাকবে— এমন প্রত্যাশা ছিল দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের অনেকেরই ধারণা ছিল যে, বিএনপি অন্তত দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে। দলটির নেতারা অবশ্য ভোটের আগেই বলেছিলেন যে, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, তাহলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। নির্বাচনের পর তারা অভিযোগ করলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিজয়ী আওয়ামী লীগের বক্তব্য হলো, জনগণ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। একপর্যায়ে তাদের নির্বাচিতরা এমপি (সংসদ সদস্য) হিসেবে শপথ নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। যদিও সেই কথায় অটল থাকতে পারেনি দলটি। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই জোটও এখন অকার্যকর। জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তারা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, না রাখা নিয়েও আছে দোদুল্যতা। ফলে রাজনীতির মাঠে কার্যকর হচ্ছে না জোট। উল্টো শরিক দলগুলোতে ভাঙনের ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এখন হাস্যকর পাত্রে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ভেঙে গেছে, ভেঙে গেছে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি। ২০ দলীয় জোটের শরিকদের অবস্থা আরও করুণ। মূল দলগুলো জোট থেকে বের হয়ে গেলে এমন সব নেতাকে দিয়ে দল বানিয়ে জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখা হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক ময়দানে কোনো পরিচিতি নেই। এসবের জন্য বিএনপির বৃহৎ অংশ দলের মহাসচিবের ব্যর্থতাই দায়ী করেন। তারা মনে করেন, এ সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে রাতারাতি দল বানানোর এই প্রক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব জোটকে হালকা করে ফেলেছেন।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে গিয়ে শোচনীয় পরাজয়ের পর বিএনপি মহাসচিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির মতো এত বড় একটা দল কোন যুক্তিতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট করলো, তা কারও কাছেই পরিষ্কার নয়। সরকারের শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পর ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালে নেতাদের কাছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপির নেতৃত্ব মনে করে যে, তাহলে কি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বেগম খালেদা জিয়া সম্মত ছিলেন না! তাহলে কার নির্দেশে এই ফ্রন্ট গঠন হলো?
এসব বিষয়ে মহাসচিবকে অনেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। সম্প্রতি বিএনপির তিন ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীর-বিক্রম ও ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমর বীর-উত্তম একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তাতেও তৃণমূলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দলের মহাসচিব পরিবর্তনেরও নানা গুজব চলছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও মহাসচিব মিলিয়ে প্রায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করছেন। এখন তার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করছেন। এমনকি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দলে নতুন মহাসচিবের বিষয়ে ভাবছেন বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নাম আলোচিত হচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনেকটাই কোণঠাসা। কার্যত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন রিজভী আহমেদ। দলে এ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। সিনিয়র নেতারা যদিও বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না। দলের সব স্তরেই একে-অপরের সমালোচনা চলছে প্রকাশ্যে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠন, জেলা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এখন আর দলের সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ নেয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দলের জুনিয়র নেতারা তারেক রহমানের নির্দেশেই কাজ করছেন বলে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না। ফলে সিনিয়র নেতাদের কার্যকর ভূমিকা রাখতেও দেখা যাচ্ছে না। দলের তৃণমূলে এ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই মনে করেন যে, বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন কখন করবে, তারা তো নিজেরাই লড়াইয়ে ব্যস্ত। একে-অপরের চরিত্র হননে ব্যস্ত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির প্রতিপক্ষ এখন বিএনপি!
দলের অভ্যন্তরীণ এসব সঙ্কট প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘শহীদ জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া দল ৪২ বছর পর মানসিকভাবে খণ্ড-বিখণ্ড, সাংগঠনিকভাবেও খণ্ড-বিখণ্ড। দল আছে কিন্তু কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। আমরা ওপেন মাঠে খেলতে পছন্দ করি না, ঘরোয়া খেলতে পছন্দ করি। এ কারণে গত ১২ বছরে বিএনপি আন্দোলনে সফল হতে পারেনি।’
তিনি আরও বলেন, “বিএনপির অভ্যন্তরে ‘ঘরোয়া খেলা’ বন্ধ না হলে সরকার হটানোর আন্দোলনে সফলতা আসবে না। ঘরোয়া খেলা মানে, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে লাগা, একজন আরেকজনকে খাটো করা, একজন আরেকজনকে ব্যর্থ করা।” ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব বাড়িয়ে সংগঠনকে আন্দোলনমুখী করার আহ্বান জানান বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।