আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে থাকেন রক্ষণভাগ দুর্বল, আবার রক্ষণভাগের সাথে আক্রমণভাগে খেলা ফুটবলারদের সমন্বয় করিয়ে দেয়া ফুটবলার না থাকার কথাও বলেন অনেকে। কিন্তু এবারের আর্জেন্টিনা খানিকটা ভিন্ন। ক্রিস্টিয়ান রোমেরো, পেজেলা, টাগলিয়াফিকো রক্ষণভাগ সামলাচ্ছেন দারুণভাবে।
রক্ষণভাগের সাথে আক্রমণভাগের যোগসূত্র তৈরি করে দিচ্ছেন প্যারেডেসরা। তবে তিনি ঠিক ফ্রান্সের এনগোলো কান্তে কিংবা ২০১৪ সালের আর্জেন্টিনার মাচেরানোর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। সম্মুখে লিওনেল মেসি, লওতারো মার্তিনেজরা গোল বানাচ্ছেন এবং দিচ্ছেন।
বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজন লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ও বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান ফুটবলার নেইমারের ব্রাজিল মুখোমুখি হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের আসর। বাংলাদেশ সময় রবিবার সকাল ছয়টায় মারাকানায় হবে এই ম্যাচটি।
কোপা আমেরিকার অন্যান্য ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তদের আগ্রহ কম থাকলেও, লাতিন আমেরিকার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল যখন মুখোমুখি হচ্ছে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও প্রেডিকশন।
দুই দলের জমাট রক্ষণভাগ
এখনও পর্যন্ত মাত্র ২ গোল হজম করেছে আর্জেন্টিনা। একই পরিমাণ গোল হজম করেছে ব্রাজিলও।
ব্রাজিলের রক্ষণভাগের ফুটবলাররা ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলেন, দানিলো, অ্যালেক্স সান্দ্রো জুভেন্টাসে খেলছেন, থিয়াগো সিলভা আছেন, এডের মিলিটাও আছেন।
আরও আছেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইর মারকুইনহোস। মিলিটাও এবারের লা লিগায় লিওনেল মেসির বিপক্ষে খেলেছেন এবং তাকে গোল করতে দেননি। খুব বেশি পরিচিত নাম না থাকলেও এবারের কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ ঠিকঠাক কাজ করে গেছে।
ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোকে আলাদাভাবে লক্ষ্য করা গেছে। অভিজ্ঞ নিকোলাস ওটামেন্ডি আছেন, তবে বল আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে মারকুস আকুনিয়া ভাল করলেও সামগ্রিক রক্ষণভাগ সামলানোর ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনি তার ওপর খুব ভরসা করতে পারছেন না।
ডিফেন্সিভ মধ্যভাগ আধুনিক ফুটবল ম্যাচ জয়ের নিয়ন্তা
রক্ষণভাগের ওপরের দিকে খেলা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রেয়াল মাদ্রিদের ক্যাসেমিরোও লিওনেল মেসির বিপক্ষে খেলে অভ্যস্ত। লিওনেল মেসি ২০১৮ সালের পর আর রেয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে লা লিগায় গোল পাননি।
এদিক থেকে কিছুটা হলেও সুবিধা আর্জেন্টিনাও পাবে। নেইমারের ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের সতীর্থ লিয়ান্দ্রো পারেদেস খেলছেন আর্জেন্টিনার হয়ে। নেইমারের আক্রমণ ঠেকানোর কিছু টোটকা পারেদেস দিতে পারেন আর্জেন্টিনার সতীর্থদের।
মেসি বনাম নেইমার
বড় ম্যাচে বড় খেলোয়াড়দের প্রমাণের থাকে অনেক কিছু। ২০১৭ সালে নেইমার বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতে যোগ দেয়ার পরে পর, মেসি আর নেইমার বড় কোন ম্যাচে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি হননি।
সে হিসেবে এই প্রথম এমন একটা প্রেক্ষাপটে দুই সাবেক সতীর্থ একে অন্যের বিপক্ষে মাঠে নামবেন। ২০১৩ সালের কনফেডারেশন্স কাপ এবং ২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার ট্রফি জিতেছেন নেইমার। ব্রাজিলের হয়ে তার পরিসংখ্যান বেশ সমৃদ্ধ। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রাজিলের কিংবদন্তী ফুটবলার পেলের গোলসংখ্যার কাছাকাছি চলে এসেছেন নেইমার।
ক্লাব ফুটবলের তুলনায় জাতীয় দলের হয়েই নেইমার তার সহজাত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ঝলক দেখাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এসেছেন।
অন্যদিকে লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে অনেক ম্যাচেই ভালো খেললেও সফলতা পাননি, কোন আর্ন্তজাতিক শিরোপা নেই লিওনেল মেসির ট্রফি ক্যাবিনেটে। তবে ২০১৪ সালে মেসি জিতেছেন বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি।
এবারও কোপা আমেরিকার সবচেয়ে ভালো পারফর্মার মেসিই, এখন পর্যন্ত চারটি গোল করেছেন, যার মধ্যে দুটি সরাসরি ফ্রি কিক থেকে। এছাড়া সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরো পাঁচটি গোল।
অন্যদিকে নেইমার দুটো গোল করলেও গোলের অনেক সুযোগ নষ্ট করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত আটটি বড় সুযোগ নষ্ট করেছেন নেইমার। প্রচুর বলও হারিয়েছেন তিনি পা থেকে। সতীর্থদের তিনটি গোলে সহায়তা করেছেন নেইমার।
আক্রমণভাগ
যদিও মেসি ও নেইমারই দুই দলের আক্রমণভাগের নেতা। তবুও ব্রাজিলের হয়ে পাকোয়েতা এবং আর্জেন্টিনার হয়ে লওতারো মার্টিনেজ গোল এনে দিচ্ছেন। গত দুই ম্যাচেই পাকোয়েতা গোল করেছেন ব্রাজিলের হয়ে।
মার্টিনেজের পাশাপাশি আর্জেন্টিনার হয়ে দুইবার গোলদাতার খাতায় নাম উঠিয়েছেন আলেহান্দ্রো গোমেজ। আর্জেন্টিনার হয়ে চমক দিতে পারেন নিয়মিত বদলি হিসেবে নামা অ্যানহেল দি মারিয়া।
ব্রাজিলের হয়ে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়া গ্যাব্রিয়েল হেসুস আর ফাইনালে মাঠে নামতে পারবেন না। তবে নেইমারের সঙ্গী হিসেবে আছেন রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াস জুনিয়ররা।
মানসিক চাপ
স্বভাবতই ফাইনাল ম্যাচে দুই দলের ওপরই মানসিক চাপ থাকে। সেটা যখন হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিপক্ষে, সেটা আরো চাপ বাড়িয়ে দেয়। নেইমার তো আর্জেন্টিনার সেমিফাইনাল ম্যাচের আগেই ঘোষনা দিয়েছেন, “আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই কোপা আমেরিকার ট্রফি জিততে চাই।”
এর আগে ২০১৯ সালে ব্রাজিল কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেবার নেইমারকে ছাড়াই সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেয় ব্রাজিল।
লিওনেল মেসির ওপর থাকবে বাড়তি চাপ।
আর্জেন্টিনা কলম্বিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৩ সালে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তার দুই গোলে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে আর কোন বড় শিরোপা জিততে পারেনি। তার ওপর ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের ফাইনাল এবং ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালে হেরে গিয়েছিল লিওনেল মেসির দল।
লিওনেল মেসি এর মধ্যে একটি ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে গোল দিতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। আবার টুর্নামেন্টের ফাইনালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মুখোমুখি দেখায় ব্রাজিল তিনবারের তিনবারই জয় পায়।
শেষবার দুই দল কোন ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ২০০৭ সালে, সেবার ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-০ গোলের একটি জয় পায়। ব্রাজিলের মাটিতে আয়োজিত শেষ পাঁচটি কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টের পাঁচটিতেই শিরোপা জিতেছে ব্রাজিল। সূত্র: বিবিসি বাংলা