সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও কূটনীতিক এম খায়রুজ্জামানকে বাংলাদেশে প্রেরণে স্থগিতাদেশ আরোপ করেছেন মালয়েশিয়ার হাইকোর্ট। এ বিষয়ে অভিবাসন বিভাগের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২০ মে তারিখ নির্ধারণ করেছেন দেশটির হাইকোর্ট।
আজ বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) খায়রুজ্জামানের রিট (হেবিয়াস কর্পাস) আবেদন শুনানিকালে এ আদেশ দেন হাইকোর্টের বিচারক মোহাম্মদ জাইনি মাজলান। ফ্রি মালয়েশিয়া টুড সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ফ্রি মালয়েশিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক এ কূটনীতিকের আইনিজীবী দাবি করেছেন যে, তিনি ইউএনএইচসিআর-এর কার্ড নিয়ে একজন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন। তিনি কোনোও অভিবাসননীতি লঙ্ঘন করেননি। তাই তাকে আটক করা বেআইনি ছিল। তাতে আরো বলা হয়, খায়রুজ্জামান (৬৫) অজ্ঞাত কারণে ফেরত চায় বাংলাদেশ। খায়রুজ্জামানের স্ত্রী রীতা রহমানের দাবি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারণে তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রিতা রহমান আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার আশা, স্বামীর অবস্থান সম্পর্কে তিনি জানতে পারবেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি খায়রুজ্জামানকে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জাইনুদিন বলেন, ‘একটি অভিযোগ থাকায় খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর দেশের (বাংলাদেশের) একটি অনুরোধ আছে। ’
এম খায়রুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা মামলায় খালাস পাওয়া আসামি। তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন (২০০৭ থেকে ২০০৯)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিচারের মুখোমুখি হতে তাঁকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলেও তিনি ফেরেননি।
জেলহত্যা মামলায় সংশ্লিষ্টতা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রায় আড়াই মাসের মাথায় ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। এরপর ২১ বছর হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। ২০০৪ সালে পলাতক তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বাকি দুজনকে খালাস দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের রায়ে তিনজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে পলাতক থাকায় তাঁদের কারো সাজা কার্যকর করা যায়নি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক কর্মকর্তা এম খায়রুজ্জামানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলহত্যা মামলার অভিযোগপত্রে নাম এলে সে সময় ফিলিপাইনে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা খায়রুজ্জামানকে দেশে ডেকে পাঠানো হয়। ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় সরকার।
তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরলে জামিনে মুক্ত হন খায়রুজ্জামান। ২০০৪ সালে জেলহত্যা মামলার রায়ে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। তবে মামলা চলাকালেই নজিরবিহীনভাবে তাঁকে পদোন্নতি দেয় সরকার। করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদেও নিয়োগ দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের আগস্টে তাঁকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করা হয়।
ছিলেন নিরুদ্দেশ, পলাতক : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি খায়রুজ্জমানকে কুয়ালালামপুর থেকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ওই বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত ছুটির আবেদন করেন। ৪ জুলাই থেকে তাঁর ‘এলপিআরে’ যাওয়ার কথা ছিল। তবে সরকার তাঁর ছুটির আবেদন মঞ্জুর না করে ৮ মার্চের মধ্যে দেশে ফিরতে আদেশ দেয়। এই আদেশ পেয়ে ২৪ জানুয়ারি তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হন। সরকার এরপর তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে।