চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশের পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম, পাহাড় ঘেরা বন সমৃদ্ধ এলাকা, কিছু অসাধু বন কর্মকর্তার কারণে এই বনাঞ্চল আজ হুমকির সম্মুখীন, শুধু কাঠ আর কাঠ, অবৈধ কাঠে সয়লাব চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের প্রধান হিসেবে (চট্টগ্রাম বন সার্কেলের) দায়িত্বে আছেন বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল সরকার, যিনি চট্টগ্রাম বন সার্কেলের ৯ টি গুরুত্বপূর্ণ বনবিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ সংরক্ষণ কাঠ পাচার রোধ কর্মকর্তা কর্মচারী বদলি নিয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন।
বন বিভাগ সমূহের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ, লামা বন বিভাগ, পম্পউড প্লান্টেশনস বিভাগ, বান্দরবান বনবিভাগ, উপকূলীয় বন বিভাগ, ইউটিলাইজেশন বন বিভাগ। এই বন বিভাগ সমূহ থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ নির্বিচারে কেটে চট্টগ্রাম হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনে করে পাচার করা হয়ে থাকে। যা দেখভালের সর্বোচ্চ দায়িত্বরত কর্মকর্তা হচ্ছেন বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল সরকার কিন্তু তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের উদাসীনতা ও চোরাই কাঠ পাচারের সিংহভাগ পার্সেন্টেজ প্রাপ্তির কারণে সবকিছুই ওভারলুক করে আসছেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বেশ কয়েকটি পয়েন্ট রয়েছে, যেসব্ পয়েন্টে অবৈধ কাঠে সয়লাব। প্রতিনিয়ত এসব পয়েন্টে পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত বিভিন্ন স্থান হতে গভীর রাতে কিছু ট্রাকে অবৈধ কাঠ ভর্তি হয়ে আসে এবং এসব পয়েন্টে আনলোড করা হয়। এসব কাঠ সঠিক ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে কাঠের স্বপক্ষে কোন বৈধ কাগজ পত্র কাঠের মালিকগণ দেখাতে পারবে না। অবৈধ কাঠগুলি যেখানে ট্রাকে লোড করা হয় সেখানকার সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তাকে গাড়ী প্রতি ২০,০০০/- হাজার টাকা ঘুষ দেওয়া হয়। অতঃপর সড়কে এসব স্থানে ফরেস্ট চেক ষ্টেশন রয়েছে সেসব ফরেস্ট টেক স্টেশনে গাড়ী ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চেক ষ্টেশন কর্মকর্তাকে দিয়ে ট্রাক চেক ষ্টেশন পার হয়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাক হতে কাঠ আনলোড হয়।
অবৈধ কাঠের ট্রাক চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করার পূর্বেই চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের অধীন শহর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা কে রাতেই প্রতি ট্রাক কাঠের জন্য ৬ হাজার হতে ৭ হাজার টাকা দিতে হয় প্রতি কাঠ ভর্তি খোলা ট্রাকের জন্য। যদি কাঠ ভর্তি ট্রাক ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকে অথবা কাভার্ড ভ্যান হয় সেক্ষেত্রে প্রতি ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানের জন্য দিতে হয় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এই টাকার ভাগ পার্সেন্টেজ হিসেবে সহকারী বন সংরক্ষক, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রাম বন সার্কেলের বন সংরক্ষক পর্যন্ত পৌছায়। শুধু মাত্র ট্রাক বা কাভারভ্যানেই নয় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত ৫০ থেকে ৬০টি খোলা জীপ ও পিক আপে অবৈধ গোল কাঠ ও রদ্দা ও চিরাই সেগুন, গামারী, গর্জন, চাপালিশ, চাম্পাফুল, গোদা, বৈলাম ইত্যাদি মূল্যবান কাঠ এসব পয়েন্টে এসে আনলোড হয়।
পয়েন্টগুলো হলো- চট্টগ্রাম শহরে ঢোঁকার পথে অক্সিজেন নামক স্থানের স- মিল সমূহ। এসব সমিলের কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের হালিশহরস্থ এক্সেস রোডের মোখছেদুর রহমান (কাজল) সওদাগরের স মিল। হাজী সুফিয়ানের স মিল, বজল সওদাগরের স মিল এবং পতেঙ্গা থানার অন্তর্গত কাঠগড় এলাকায় আব্দুল কাদেরের স মিল। হালি শহরের সবুজ বাগের বিভিন্ন স মিল সমূহে। ফিরিঙ্গি বাজার চেয়ারম্যান ঘাট রোডের জনতা স মিল।
বাংলাদেশ স মিল, কাপ্তাই রাস্তার মাথা হতে কালুরঘাট ব্রীজ পর্যন্ত রাস্তার দুই পার্শ্বে কমপক্ষে ২০টি স মিল। বহাদ্দরহাট হতে রাহাত্তার পোল পর্যন্ত রাস্তার দুই পার্শ্বের অবৈধ কাঠের দোকান ও দোকানের গোডাউন সমূহ এবং স মিল সমূহে প্রচুর অবৈধ মূল্যবান কাঠ অবৈধ ভাবে এসে জমা হয়। খাগড়াছড়ি জেলার অর্ন্তগত যে সব স্থান হতে অবৈধ কাঠ ট্রাকে, পিকআপ ও জীপে এবং কাভারভ্যানে লোড হয় স্থানগুলো হলো মাটিরাঙ্গা, গচ্চাবিল জামতলা, মানিক ছড়ি, তিনটহরী অন্যতম। চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন নামক স্থানে বন সংরক্ষকের দপ্তর। বন সংরক্ষক মিঃ আব্দুল আউয়াল সরকার নন্দনকানন বন সংক্ষকের দপ্তরে বসে পুরো চট্টগ্রাম বন অঞ্চল পরিচালনা করেন।
বিসিএস ২২ ব্যাচের এই বন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম শহরে বসে ঘুরে ফিরে কক্সবাজার, বান্দরবান সহ চট্টগ্রাম জেলার অধীন, একদিকে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ, বান্দরবান জেলার অর্ন্তগত বান্দরবান বন বিভাগ, পাল্পউড বাগান বিভাগ, বান্দরবান এবং লামা বন বিভাগ। চট্টগ্রাম জেলার অধীন চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ ও বন ব্যবহারিক বিভাগসহ চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এসব বন বিভাগের সফলতা ও ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তার উপরেই বর্তায়। বন বিভাগের মূল কাজ বনবাগন সৃজন, বন রক্ষা। বন রক্ষার কথা বলতে গেলেই প্রথমেই বন সংরক্ষক আব্দুল আউয়াল’র বন রক্ষা, কাঠ পাচার, পাচারকৃত কাঠ উদ্ধারে চরম অবহেলা ও ব্যর্থতার কথা উঠে আসে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কিছু বন বিট কর্মকর্তা এবং ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ বন কর্মকর্তা বলেন যে বন সংরক্ষক চট্টগ্রাম বন অঞ্চল মহোদয় চট্টগ্রাম শহরের মধ্যখানে বসে অফিস করেন অথচ সেই চট্টগ্রাম শহরেরই বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধ কাঠের স্তুপ জমে আছে। এসব অবৈধ কাঠ উদ্ধার বা জব্দ করার ব্যাপারে তার নেই কোন স্বতঃস্ফূত উদ্যোগ। এর ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে। বন বিভাগ জনগণের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে।
বনের ঐতিহ্য আজ হুমকির সম্মুখীন। বান্দরবান বন বিভাগ, পাল্পউড বাগান বিভাগ, বান্দরবান এবং লামা বন বিভাগে কাল্পনিক গাছের উপস্থিতি ও পরিমাপ দেখিয়ে সে সব কাল্পনিক ও ভূয়া জোত পারমিট হয়েছে এবং হচ্ছে ভূয়া জোত পারমিটের ছত্র ছায়ায় প্রতি নিয়ত কাঠ পাচার হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে বন সংরক্ষক আব্দুল আউয়াল সরকার কোন সঠিক পদক্ষেপ বা ভূমিকা রাখছেন না বরং তার অধীনস্থ দেরকে এসব অনৈতিক কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা প্রদান করে সরকারী বন ও সরকারের ক্ষতি করছেন। তিনি এক বন বিভাগ হতে অন্য বন বিভাগে রেঞ্জার, ডেপুটি রেঞ্জার, ফরেস্টার বন প্রহরী বাগান মালি, অফিস সহকারী দেরকে বদলি ও নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এসব কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের বদলির ক্ষেত্রে তিনি নাম মাত্র তাহার অধীনস্থ দের নিয়ে গঠিত বদলি কমিটির মিটিং দেখিয়ে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর নিয়ে নিজের পছন্দ ও ইচ্ছা মত কর্মকর্তা/ কর্মচারীদেরকে এক বন বিভাগ থেকে অন্য বন বিভাগে বদলি করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার অধীনে যে সব বন বিভাগ রয়েছে তার মধ্যে চট্টগ্রাম উত্তর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ, পাল্পউড বাগান বিভাগ, বান্দরবান, বান্দরবান বন বিভাগ, লামা বন বিভাগ ও বন ব্যবহারিক বিভাগ চট্টগ্রাম অধিকতর লোভনীয় বন বিভাগ।
কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ এবং উপকূলীয় বন বিভাগ, চট্টগ্রাম তুলনামূলকভাবে কম লোভনীয় বন বিভাগ। অভিযোগ রয়েছে যে বন সংরক্ষক এর ইচ্ছা যারা পূরণ করে সে সব বন কর্মকর্তা/ কর্মচারীদেরকে তিনি লোভনীয় বন বিভাগে বদলি করেন আর যারা তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন না তাদের তিনি কম লোভনীয় বন বিভাগ থেকে কম লোভনীয় বন বিভাগে এবং লোভনীয় বন বিভাগ থেকে কম লোভনীয় বন বিভাগে বদলি করে থাকেন। এক্ষেত্রে বন ব্যবহারিক বিভাগের ফরেস্টার বাশেদ এবং চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ফরেস্টার নাজমুল ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা শহর রেঞ্জ মধ্যস্থতা ও বিনিময়ে কাজটি করে থাকেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরেস্টার ও বন প্রহরীদের নিকট থেকে জানা যায়।
বন রক্ষার ক্ষেত্রে বদলি ও নিয়োগে স্বচ্ছতার প্রয়োজন বলেই ফরেস্টার ও বন প্রহরীরা মত প্রকাশ করেন। বন সংরক্ষক আব্দুল আউয়াল সরকার এর আমলে চট্টগ্রাম ও বন অঞ্চল এর অধীন বান্দরবানস্থ সাঙ্গু ও মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্ট যেভাবে নিধন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি তার অধীনস্থ বন রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তার বন অঞ্চলের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী রির্জার্ভ ফরেস্ট ধংসের বিষয়ে তদন্ত হয় ঢাকা বন ভবন থেকে আগত উপপ্রধান বন সংরক্ষক জগলুল হোসেন কর্তৃক। জগলুল হোসেন এবং আব্দুল আউয়াল সরকার দুজনেই এক ব্যাচের কর্মকর্তা হওয়ায় মিঃ আব্দুল আউয়াল সরকার সেফ হয়ে যান। পানি নিচের দিকে গড়ায় বিপদে পড়েন ফরেস্টার ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা।
নাম না প্রকাশ না করার শর্তে কিছু বন রক্ষক ও বনপ্রহরী বলেন যে, সুফল প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের যে সব বন বিভাগে বাগান সৃজন হয়েছে এবং হচ্ছে এসব বাগান যদি যথাযথ ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও যাচাই বাছাই করা হয় অনেক গড়মিল ও অনিয়ম ধরা পড়বে। সচেতন মহল, স্থানীয় জনগণ, এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবি চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন সংরক্ষক আব্দুল আওয়ালের অবৈধ কাঠ উদ্ধারে নীরবতা, বদলি নিয়োগে অনিয়ম, সাঙ্গু মাতামুহুরী রির্জার্ভ ফরেস্ট ধ্বংসের দায় দায়িত্বের বিষয়ে এবং সুফল প্রকল্পের ব্যাপারে নিরপেক্ষ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
স্থানীয় কর্মরত সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে আলাপকালে জানা যায় এই বন কর্মকর্তাকে অবৈধ কাঠ পাচারের সময় কাঠ ভর্তি ট্রাক (গাড়ী)’র নাম্বার জানানোর জন্য বার বার তার মোবাইল ফোন (০১৭১২৬৩৮৬০৬) রাতে দিনে জানানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেন না। ফোন না ধরার কারণ মোটেই বোধগম্য নয়। তার অধীনস্থ দু/একজন বন কর্মকর্তার কাছে তার ফোন নাম্বার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তার নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন যে, আমাদের বন সংরক্ষক আব্দুল আউয়াল সরকার সাহেব মাঝে মধ্যে বলে থাকেন অচেনা নং এর ফোন ধরলেই অবৈধ কাঠ পাচারের খবর আসে তাই তিনি কোন অচেনা নাম্বারের ফোন ধরেন না। বন বিভাগের সার্ভিসটি হলো সার্বক্ষণিক অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার সার্ভিস, সেই হিসেবে প্রধান বন সংরক্ষক, বন সংরক্ষক, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, সহকারী বন কর্মকর্তা, রেঞ্জ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা, বন প্রহরী যারা বন রক্ষার দায়িত্বে আছেন তারা যেমনিভাবে ২৪ ঘন্টা অন ডিউটিতে থাকেন তাদের ফোন ২৪ ঘন্টা সচল থাকার কথা, কারণ কখন কোথায় সরকারী বনে গাছ কাটা যাচ্ছে? কখন কোথা হতে কোথায় কাঠ পাচার হচ্ছে? এসব খবর একমাত্র দ্রুত মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই পাওয়া যায়।