জাতীয় পার্টির ‘দুর্নাম করতেই’ ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার জিপিও মোড়ে ‘ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে’ নূর হোসেনকে হত্যা করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
তিনি বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে জাতীয় পার্টির দুর্নাম করতেই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নূর হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে। নূর হোসেন বুকে ও পিঠে যে স্লোগান লিখেছিলেন, আজ আমরাও সেই স্লোগান দিচ্ছি। আজ আমরাও বলছি, স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। আমরা নূরর হোসেন হত্যার বিচার চাই।’
বুধবার বনানীতে জাতীয় পার্টির ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তৃতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর সামরিক আইন প্রত্যাহার করে সংবিধান পুনর্বহাল করেন এরশাদ। দিনটিকে জাপা ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করে।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতন ঘটলেও সেই আন্দোলনের নতুন মাত্রা দিয়েছিল ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর নূর হোসেনের আত্মদান। তিন জোটের ঢাকা অবরোধ চলাকালে পরিবহন শ্রমিক নূর হোসেন বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে মিছিলে নেমেছিলেন আওয়ামী লীগকর্মী নূর হোসেন; বুকে নিয়েছিলেন সামরিক শাসকের বুলেট। তখন শামসুর রাহমানসহ কবিদের লেখনীর বিষয় হয়ে উঠেছিল নূর হোসেন। জিপিওর সামনে যে স্থানটিতে নূর হোসেন মারা গিয়েছিলেন, সেই স্থানটির নাম হয়েছে নূর হোসেন স্কয়ার। ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
সেই দিনে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি যে ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা করেছিল, তারও রয়েছে ইতিহাস। ১৯৮৭ সালের তিন বছরের মাথায় গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন এরশাদ; দুদিন পর তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ফেরে বাংলাদেশে।
এরশাদ পতনের দিনটি অন্য রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রে ফেরার দিন হিসেবে পালন করলেও জাতীয় পার্টি দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস হিসেবে’, এরশাদ দাবি করতেন, গণতন্ত্র ‘রক্ষার জন্য’ সেদিন ক্ষমতা ছেড়েছিলেন তিনি। আমৃত্যু তিনি নূর হোসেন হত্যার দায় অস্বীকার করেছেন। তার ভাই জি এম কাদেরও একই দাবি করেছেন বুধবার।
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘ কেন নূর হোসেন হত্যার পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট প্রকাশ হল না? আজ দেশের মানুষ জানতে চায়, কেন নূর হোসেন হত্যায় মামলা হল না? ১৯৯১ সালের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামে অসংখ্য মামলা হয়েছে কিন্তু নূর হোসেন হত্যার মামলা হলো না কেন? নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে নূর হোসেন হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে হবে ‘
গণতন্ত্রের নামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জনগণের সঙ্গে ‘প্রতারণা করেছে’ বলেও সভায় মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর সামরিক আইন তুলে দিয়ে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করেছেন। ১৯৯১ পরে দুটি দল গণতন্ত্রের নামে জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি। গণতন্ত্রের কথা বলে জনগনের সাথে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তা তারা রক্ষা করেনি।’
জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর থেকে যিনি দলের প্রধান, তিনিই প্রধান নির্বাহী, সংবিধানের ৭০ ধারার কারণে নিজ দলের সংসদ সদস্যরা সরকারের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য। আবার ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বিচার বিভাগ প্রচ্ছন্নভাবে সরকারের অধিনে। অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী আইন না করার কারণে নির্বাচন কমিশনও গঠন হয় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দেশে গণতন্ত্র চর্চা চলে না, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবো। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে মনোনয়ন দিতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
দেশে পরিবহন সেক্টরের সঙ্কট নিয়েও সভায় কথা বলেন তিনি।
জিএম কাদের বলেন, ‘সরকার দেশের মানুষের কষ্ট বোঝে না বলেই অযৌক্তিকভাবে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার পরিবহন সেক্টরের সাথে নাটকের মাধ্যমে ধর্মঘট ডেকে সড়ক ও নৌপথের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাড়া যা বাড়িয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছে গণপরিবহনে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। অসহনীয় কষ্টে আছে দেশের মানুষ। তেলের দাম বাড়ার সাথে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম প্রতিদিনই ওঠানামা করে। কিন্তু তেলের দাম কমলে তখন তো দেশে তেলের দাম কমানো হয় না। করোনাকালে অনেক কমদামে তেল কিনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করেছে সরকার। কিন্তু এখন ভতুর্কি দিয়ে হলেও তেলের দাম কমাতে হবে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, নাজমা আখতার।