বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :

ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে রেলকর্মীদের অদক্ষতা, উদাসীনতা ও গাফিলতি

আশীষ কুমার দে
  • প্রকাশিত সময় : বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১
  • ৪৮৫ পাঠক পড়েছে
  • রয়েছে সংস্কার ও রক্ষণা-বেক্ষণের অভাব
  • সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা-সিলেট রেলপথ

সরকার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তৎপর হলেও এককালের জনবান্ধব এই পরিবহন ব্যবস্থা এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। এজন্য রেলওয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের অদক্ষতা, উদাসীনতা ও দায়িত্বে অবহেলার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ঘাটতি রয়েছে যথাযথ সংস্কার ও সুষ্ঠু রক্ষণা-বেক্ষণেরও। একটি দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ওই প্রতিবেদন দেয়। রেল চলাচল ব্যবস্থার পর দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ঢাকা-সিলেট রেলপথ সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। গত দুই বছরের পরিসংখ্যানে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৮ সালে সারা দেশে সব মিলিয়ে ৯১টি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি ছিল মুখোমুখি দুর্ঘটনা। লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছিল ৭৮টি। অন্যদিকে ২০১৯ সালে সব মিলিয়ে ১২৯টি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়। এসব দুর্ঘটনায় ৩৯ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি আহত হন দেড় শতাধিক যাত্রী। অনুসন্ধানে জানা যায়, যথাযথ সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে জনপ্রিয় রেলপথটি এখন জীর্ণদশায় রূপ নিয়েছে। এছাড়া দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রেলকর্মীদের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও উদাসীনতার অভিযোগও রয়েছে। এসব কারণে কিছুদিন পরপরই ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। বলা যায়, সাম্প্রতিককালে দেশে যতগুলো বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার সবই হয়েছে ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে। গত নভেম্বরে চারদিনের ব্যবধানে দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছিল। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ৬ ডিসেম্বর একটি তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয় হবিগঞ্জের মাধবপুরে। যদিও ওই দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। তবে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর মাধবপুরে তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় রেলকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার মতো বিষয় থাকতে পারে বলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সরদার সাহাদাত আলী মন্তব্য করেছিলেন। দুর্ঘটনার পরেরদিন তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যে স্থানে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, সেখানে রেলপথ সংস্কারের কাজ চলছিল। সংস্কারের জন্য সেখানে কিছু রেলপথ তুলে ফেলা হয়েছিল। তাঁর ভাষায়, নিয়ম হলো কোথাও লাইনের কাজ হলে তার দুপাশেই রেড সিগন্যাল থাকবে। দুই প্রান্তের স্টেশন মাস্টারকে অবহিত করে সেখানে কাজ করতে হবে। সংস্কার কাজ চলাকালে সেখান দিয়ে তেলবাহী ট্রেন চলাচল করায় স্পষ্ট হয় যে, সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে এ রেলপথে দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ২১ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনায় ট্রেন দুটির বগি-ইঞ্জিন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এছাড়া রেলপথও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কসবার এ দুর্ঘটনার পাঁচ মাস আগে একই বছরের ২৩ জুন সেতু ভেঙে উপবন এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে যায়। এতে চারজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অন্তত ৬৪ যাত্রী আহত হন। রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগের সূত্র মতে, প্রায় প্রতি মাসেই ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে এক বা একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে, এর বেশির ভাগই লাইনচ্যুতির ঘটনা। এর মধ্যে ২০১৯ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু লাইনচ্যুতির ঘটনাই ঘটেছে ৯টি। ওই বছরের ১৬ মে ফেঞ্চুঞ্জে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন, ২ জুন শায়েস্তাগঞ্জে কুশিয়ারা এক্সপ্রেস, ২০ জুলাই একইস্থানে কালনী এক্সপ্রেস, ১৯ জুলাই কুলাউড়ায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, ৪ সেপ্টেম্বর ও ১৬ আগস্ট একই এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস, ১৭ সেপ্টেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জে জালালাবাদ এক্সপ্রেস, ৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জালালাবাদ এক্সপ্রেস, ২৯ ডিসেম্বর কুলাউড়ার বরমচালে একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে দুর্ঘটনার হার তুলনামূলক বেশি। এর কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এই সেকশনটির অনেক স্থানে একটা ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব হয় না। প্রয়োজন হলে ট্রেনের পেছনে আরো একটি ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে ট্রেন টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা করতে গিয়ে অনেক সময় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখন লাইনচ্যুতিসহ নানাভাবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তবে এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, শুধু ভূ-প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাই দুর্ঘটনার কারণ নয়। সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার জন্য আখাউড়া-সিলেট রেলপথে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণও হয়নি। কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কস ম্যানুয়াল এবং জেনারেল অ্যান্ড সাবসিডিয়ারি রুল’ অনুযায়ী রেলপথটি সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হন রেলকর্মীরা। দুর্ঘটনার জন্য রেলপথ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580