চট্টগ্রামে দিন দিন বেড়েই চলছে বাড়ি ভাড়া নৈরাজ্য। বাড়িওয়ালারা যখন ইচ্ছে তখন বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছে। এমনকি গত বছরে মহামারি করোনাকালে লকডাউন চলাকালীন হাতে গুনা কয়েকজন বাড়িওয়ালা ছাড়া বাকি কেউই ভাড়া মওকুফ বা কমায়নি। বছর এলেই ভাড়া বৃদ্ধির সিডর নামে ভাড়াটিয়াদের ওপর।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ৩০ বছর আগে আইন করা হলেও কোনদিন তা প্রয়োগ হয়নি। বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তারপরও বাড়িভাড়া নৈরাজ্য রোধে সরকারের কোন উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার রসিদ না দেয়া, ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি, জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের বেশ কিছু ভাড়াটিয়া জানিয়েছেন, অগ্রিম ভাড়া, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ,কাজের খরচ, ইউটিলিটি বিল নেয়ার ক্ষেত্রেও আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছেন না বাড়ির মালিকরা। অন্য বছরের মতো এ বছরও প্রায় সব বাড়িওয়ালাই ডিসেম্বর থেকে ভাড়া বৃদ্ধির নোটিস দেওয়া শুরু করছে। ভাড়া বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়ারা। এই শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে প্রায় ষাটভাগ ভাড়াটিয়া এবং মধ্যবৃত্ত। আর তাই প্রতি বছর ভাড়ার যাঁতাকলে পড়ে গ্রামে ফিরে যায় বহু পরিবার।
সরকার ১৯৯১ সালে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগেরও বিধান রাখা হয়েছে আইনে। আইনটি প্রণয়নের পর প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। কিন্তু পরে এসব কিছুই আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণ চিহ্নিত করতে ২০১৫ সালের ১ জুলাই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ছয় মাসের মধ্যে এই কমিশন গঠন করতে বলে উচ্চ আদালত। কিন্তু এ বিষয়েও সরকারের কোন পদক্ষেপ নেই।
বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়ার রসিদ দেন না। চুক্তি করেন না। কোন বাড়ির মালিক চুক্তি করলেও সব শর্ত থাকে নিজের পক্ষে। জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ, ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো সবার চোখের সামনে হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। বাড়িভাড়া এখন লাভজনক বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বাড়ির মালিকরা সর্বনিম্ন্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধি করছেন এ অবস্থা নিরসনে সরকার পদক্ষেপ না নিলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার বিরোধ বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নেবে।
চট্টগ্রাম হালিশহর এলাকার বাসিন্দা মো.মনসুর বলেন, ‘আমি এখন যে বাসায় আছি সেখানে তিন বছর আগে ৮ হাজার টাকা ভাড়ায় উঠেছি। এখন ভাড়া বেড়ে ১২ হাজার টাকা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘জানুয়ারি হচ্ছে ভাড়া বৃদ্ধির মাস। প্রতিবছর বাড়িভাড়ার সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাড়াটিয়া হিসেবে টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে ।
২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বাড়িভাড়া নৈরাজ্য নিয়ে একটি রিট আবেদন করে। এরপর ২০১৩ সালে রুলের শুনানি শেষ হয়। ২০১৫ সালের ১ জুলাই রায় দেয় আদালত।
কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়ে আদালতের আদেশে বলা হয়, কমিশনের প্রধান হবেন একজন আইনজ্ঞ। কমিশনে সদস্য থাকবেন ৭ জন। সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধের কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় সুপারিশ করবে কমিশন। এই কমিশন বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মতামত নিয়ে প্রয়োজনে গণশুনানি করে এলাকা ভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে।
যা আছে বাড়িভাড়া আইনে: বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ অনুযায়ী প্রতি দুইবছর পর (নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে) ভাড়া পুনর্র্র্নিধারণ করা যাবে। কিন্তু চট্টগ্রামে বছরে দুইবার ভাড়া বৃদ্ধির নজিরও আছে। ভাড়ার রসিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিসের কথা বলা হয়েছে আইনে। বাড়িভাড়া আইন অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া কোন অগ্রিম ভাড়া আদায় করা যাবে না। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একমাসের অগ্রিম ভাড়া গ্রহণ করা যেতে পারে।
আইনে বলা হয়েছে, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্ত মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া যত চাইবেন ততদিন থাকবেন, তাকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন, তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
আইন অনুযায়ী, ভাড়ার আগে দুই পক্ষের মধ্যে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার রসিদ দিতে ব্যর্থসহ নানা অপরাধের জন্য জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে।