বাংলাদেশ গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীন এবং পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় কোনো ধরনের সেন্সর ছাড়াই সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা যায়। এতে কোনো বাধা নেই। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম: ভূমিকা ও সংকট’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘বাংলাদেশ গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীন এবং তারা পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে। দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে টকশো, অনুষ্ঠানে আলোচকরা কোনো ধরনের সেন্সর ছাড়া সরকারের কর্মকাণ্ডের যথেচ্ছা সমালোচনা করেন। এ ধরনের স্বাধীন মতপ্রকাশে সরকার কখনো হস্তক্ষেপ করে না, কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করে না’। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম নীতিমালা হওয়া জরুরি। ছোট দেশে ৩০টির বেশি টেলিভিশন, কয়েকশ দৈনিক পত্রিকা আছে। এসবের ধারণক্ষমতা আছে কি-না ভাববার বিষয়। গণমাধ্যমের করপোরেট কালচার ডেভেলপ করা দরকার।’
বেগম জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে সকাল-বিকাল বিএনপি অযৌক্তিক দাবি তুলে যাচ্ছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘২০০৭ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা আত্মসাতের কারণে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সন্দেহাতিতভাবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে দণ্ড দিয়েছেন। নৈতিক স্খলনের কারণে তার শাস্তি হয়েছে। বিএনপি নেতারা বেগম জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে সকাল-বিকাল অযৌক্তিক দাবি তুলে যাচ্ছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিদেশে চিকিৎসা দেশের আইনের মধ্যে পড়ে না। দণ্ড স্থগিত অবস্থায় কেউ দেশের বাইরে যেতে পারে না।
একমাত্র দণ্ড মওকুফ হলে বেগম জিয়া বিদেশে যেতে পারেন জানিয়ে হানিফ বলেন, ‘দোষ শিকার করে রাষ্টপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আছে। রাষ্ট্রের অভিভাবক দয়ালু মানুষ। তিনি চাইলে ক্ষমা করে দিতে পারেন।’ এদিকে বৈঠকে উপস্থিত গণমাধ্যমের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা জানান, জনগণের ভরসার এখনও শেষ ঠিকানা গণমাধ্যম। এটা জাতির জন্য আয়নাস্বরূপ। যে আয়নায় ভেসে ওঠে জাতির ও দেশের প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবি যারা ফুটিয়ে তুলেন তারা কেমন আছেন? প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাদের সাংবাদিকতা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও সংকট নিরসনে গণমাধ্যমের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হওয়া জরুরি।
সভায় কি-নোট স্পিকারের বক্তব্যে জিটিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম নাগরিকের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে, তথ্য জগতে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। মানুষ জানতে চায়, মানুষ সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। আর সেখানেই গণমাধ্যমের ভূমিকা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ঐতিহাসিক ঘটনায়, মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দুর্নীতি, সহিংসতার ইস্যুকে অনেক সময় গণমাধ্যমই সবার আগে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে।’
আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক কিছুই বলছি, লিখছি কিন্তু আমরা অনেক কিছুই প্রকাশ করছি না। এর মানে হচ্ছে আমাদের নিজেদের ভেতরেই অনেক ধরনের স্ববিরোধীতা আছে। আমরা নিজেরাই অনেক সময় বাংলাদেশ বেতার বা বাংলাদেশ টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমের সমালোচনা করি, যখন দেখি গণমাধ্যম জনমুখী ভূমিকা রাখছে না।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক দিতে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে যেমন অনেক বেশি তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশন করা যায়, ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে খুব দ্রুত গুজবও ছড়িয়ে দেয়া যায়। যারা এর সুষ্ঠু ব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশ করছেন তারা কিন্তু ঠিকই সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিচ্ছেন এবং সেটার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে।’
ডিবিসি নিউজ সম্পাদক প্রণব সাহা বলেন, ‘সাংবাদিকদের তথ্য প্রবাহের জন্য প্রতিদিনই পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সাংবাদিকরা হচ্ছেন কাঁটা বিছানো পথে হাঁটা মানুষ। প্রতিনিয়ত তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হচ্ছে।’ ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার জানান, দেশের ডিজিটাল প্লাটফরম এগিয়ে নিতে ফেসবুক এবং ইউটিউবের একচেটিয়া মনোপলি ব্যবসা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন ফেসবুক ও ইউটিউবের বড় বিজ্ঞাপন বাজার। সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো বিজ্ঞাপন পাবলিশ করা হয় কিন্তু আমাদের সবচেয়ে কম রেট দেয়া হয়। দেশীয় বিজ্ঞাপন ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচার হচ্ছে। স্থানীয় পত্রিকা কিছু বিজ্ঞাপন পায়, টেলিভিশনে ধীরে ধীরে এ খাত থেকে আয় সংকুচিত হয়ে আসছে। দেশে ফেসবুক এবং ইউটিবের এ একচেটিয়া মনোপলি ব্যবসা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোনো উদ্যোগ না নেয়া হয় তাহলে দেশের ডিজিটাল মিডিয়া এগোতে পারবে না।’
নিউজ২৪ এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি বলেন, ‘মূলধারার সাংবাদিকতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়া। বর্তমানে গণমাধ্যম নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় যে উদ্বেগ, সেটা হচ্ছে সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীরা একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আস্থার সেই জায়গাটা সাধারণ মানুষের কাছে আর নেই।’
সভাপতির বক্তব্যে বিবার্তা২৪ ডটনেট সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি বলেন, ‘সাংবাদিকতা হচ্ছে থ্যাংকলেস জব। এখানে ভালো কাজ করলে কেউ ধন্যবাদ দেবে না। আবার নাম আগে-পরের জন্যও অনেকে চার্জ করার জন্য বসে থাকে। এ সেক্টরে সংকট রয়েছে, সংকট থাকবে। তবে এটাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হবে। আর যদি এ পেশার চাপের কথা বলি, তাহলে এ চাপটা সরকার ও রাজনৈতিক দল থেকে না, এটা নিজের ভেতর থেকে আসে।’বিবার্তা২৪ ডটনেট ও জাগরণ টিভির আয়োজিত বৈঠকে জাগরণ টিভির প্রধান সম্পাদক এফএম শাহীনের সঞ্চালনা করেন।
সভায় অন্যদের মধ্যে আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট কুহেলী কুদ্দুস মুক্তি, মাহমুদ সালাউদ্দিন চৌধুরী, হাবিবুর রহমান রোমেল, নাজমুল হক সিদ্দিক, বরিকুল ইসলাম বাঁধন, এস এম রাকিবুল হাসান, রবিউল রূপম সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিশিষ্ট জন উপস্থিত ছিলেন।