নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনার পর আটক একটি কার্গো জাহাজ এসকেএল-৩ এর রঙ পরিবর্তনের স্থান নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। আটক কার্গো জাহাজের মাস্টারসহ অন্য শ্রমিক-কর্মচারিরা বলছেন, দুর্ঘটনার পর পালিয়ে গিয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় থ্রি এ্যাঙ্গেল মেরিণ লিমিটেডের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে জাহাজটির রঙ পরিবর্তন করিয়েছেন তারা। এরপর কোস্টগার্ড জাহাজসহ তাদেরকে আটক করে। তবে এ বক্তব্য সঠিক নয় বলে থ্রি এ্যাঙ্গেল মেরিণ কর্তৃপক্ষ জোরালো দাবি তুলেছে। জাহাজটি আটকের আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরেও বলা হয়, সর্বশেষ বরিশালে এ্যাঙ্কর সিমেন্ট কার্যালয়ের কাছে দেখা গেছে জাহাজটিকে এবং বরিশাল থেকে রঙ পরিবর্তন করে হাল্কা বাদামী রঙ করা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে বরিশালের চরমোনাই এলাকায় সেটি অবস্থান করছিল। এছাড়া অপর একটি সূত্রও বলছে, বরিশালের কোনো ডকইয়ার্ডেই কার্গোটির রঙ বদলের সম্ভাবনা বেশি। প্রশ্ন উত্থাপন করে সূত্রটি বলছে, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় থ্রি এ্যাঙ্গেল ডকইয়ার্ড থেকে রঙ পরিবর্তন করলে জাহাজটি কেনো বরিশাল যাবে? সূত্রটি আরো বলছে- তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, এসকেএল-৩ জাহাজটি থ্রি এ্যাঙ্গেল ডকইয়ার্ড থেকে রঙ বদল করেছে তাহলে সেটি দ্রুত দূরে কোথাও চলে যেতে পারতো; মুন্সিগঞ্জ এলাকায় অবস্থান করার কথা নয়। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, দুর্ঘটনার সকল দায় কার্গো জাহাজটির ওপর চাপিয়ে দিয়ে ডুবে যাওয়া ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসানকে সার্ভে (ফিটনেস সনদ) প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ারকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য একটি মহল অপচেষ্টা চালাচ্ছে। লক্কড়ঝক্কড় এই লঞ্চকে ফিটনেস সনদ দিয়েছেন নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার মো. শাহরিয়ার হোসেন। তিনি লঞ্চের সনদধারী মাস্টারকে সশরীরে না দেখেই চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে মুঠোফোনে আলাপকালে ইঞ্জিনিয়ার শাহরিয়ার হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। প্রসঙ্গত, নারায়ণগঞ্জের ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার মো. শাহরিয়ার হোসেন কয়েক মাস আগে পরিদর্শন ছাড়াই এমভি গোলাম রহমান (নিবন্ধন নং এম- ৭২৪১) নামের একটি কার্গো জাহাজের সার্ভে সনদ দিয়েছিলেন। অথচ জাহাজটি ২০১৮ সালে মেঘনায় দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ডুবে যায় এবং পরবর্তী সময়ে মালিক জাহাজটি উত্তোলন করেননি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলে জাহাজটির সার্ভে সনদ বাতিল করা হয়। তবে ভৌতিক জাহাজের সার্ভে দেয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে অভিযুক্ত কর্মকর্তা শাহরিয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মো. শহীদ মিয়া বলেন, দুর্ঘটনার পর কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে এবং কমিটিগুলো কাজ করছে। এই মুহূর্তে আগাম মন্তব্য করা সমীচিন নয়। বড় কার্গো জাহাজটি ছোট একটি লঞ্চকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে, এটাই যে দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ- তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। যাত্রীবাহী লঞ্চটির চলাচলের উপযুক্ত ও এর সব কাগজপত্র সঠিক ছিল কিনা, লঞ্চে দক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার ছিলেন কিনা, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লঞ্চটিকে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়েছিল কিনা- এর সবকিছুই পরিস্কার হবে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। তাই আগেভাবে অযাচিত কথাবার্তা বলা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন হাজী শহীদ মিয়া। তবে নৌ রিাপত্তার স্বার্থে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের দাবি জানান তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি যেভাবেই ঘটুক না কেনো- দুর্ঘটনাকবলিত সব ক’টি নৌযানকেই তদন্তের আওতায় আনতে হবে। এগুলোর অবকাঠামো পরীক্ষাসহ সকল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে ছোট লঞ্চ ‘এমএল সাবিত আল হাসান’ ডুবে গিয়ে ব্যাপক প্রাণহানির মূল কারণ যদি ‘এসকেএল-৩ কার্গো জাহাজের ধাক্কা’ই হয় তাহলেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের স্বার্থে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মাস্টার ও ড্রাইভারের সনদ এবং নকসা, বুকলেট ও অবকাঠামো নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করতে হবে। গত ৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ থেকে ১৪ জন শ্রমিক-কর্মচারিসহ এসকেএল-৩ নামের জাহাজটি আটক করেছে কোস্টগার্ড। ওই মামলায় তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলে বিচারক পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিন করে পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করে এবং অন্য ৯ জনকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। এসকেএল-৩ জাহাজের শ্রমিক-কর্মচারিরা বলেছেন, আটক এড়াতে তারা মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় থ্রি এ্যাঙ্গেল মেরিণ ডকইয়ার্ডে নিয়ে জাহাজটির রঙ বদল করেছেন। জানতে চাইলে থ্রি এ্যাঙ্গেল মেরিণ ডকইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, এসকেএল-৩ এর মাস্টার ও অন্য কর্মচারিদের বক্তব্য মোটেও সঠিক নয়। জাহাজটি তাদের ডকইয়ার্ডে আনা হয়নি। ৪ এপ্রিল রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি এসকেএল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল টি ডুবে যায় বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৪ যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পরেরদিন বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবুলাল বৈদ্য অজ্ঞাতনামা জাহাজটির বিরুদ্ধে বন্দর থানায় একটি মামলা করেন। দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে এ পর্যন্ত চারটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আব্দুছ ছাত্তার শেখকে আহ্বায়ক ও বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে সাত সদস্যের কমিটি করেছে নৌ মন্ত্রণালয়। নৌ অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার এহতেসানুল হক ফকিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি করেছে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর; যার অপর দুই সদস্য হলেন অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আরা ও পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমান। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরী ববির নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করেছে। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।