বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :

নীলরং প্রজাপতি

নিউজ ডেক্স:
  • প্রকাশিত সময় : বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২
  • ৬৫৮ পাঠক পড়েছে

নীলরং প্রজাপতি
                                         আমজাদ হোসেইন

প্রচন্ড ক্ষিধেয় আয়োজন করে খাবার কেনার ইচ্ছেটা পানসে হয়ে গেছে । এখন তর সইছেনা । মুখে কিছু না দিলেই নয় । দুপুর গড়িয়ে যাওয়া চনমনে ফাগুনের রোদও সহ্য হচ্ছেনা । ভেতরটা শুকিয়ে গেছে– পানি দরকার । সামনেই পেশোয়ার হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্ট । তার ওই পাশে হোটেল রসনা বিলাস । তার ওপাশে জলযোগ । রাস্তার অপর পার্শ্বে প্যারাডাইস সুইটস । আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আবীর মোড় ঘুরে ধাঁই ধাঁই করে হেঁটে বড় রাস্তার জনসমুদ্রে মিশে গেল । হঠাৎই গেল । কি কারণ– আমি জানিনা । মুখ শুকনো করে পানের দোকানের চিপায় রাস্তা ছেড়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম । ছেলেবেলা এ রকম হলে নিশ্চিত ভয় পেতাম । এখন হলো মন খারাপ । তিন মিনিটের মাথায় আবীর ফিরে এলো একটা ঠোঙা হাতে করে । হেসে বললো, তুমি মৎস্য না মাংস ? আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলাম । কথা বলছোনা কেন ? রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি বলবো ? রাস্তায় দাঁড়িয়েই বলতে হবে । সেইম প্রাইস, ডিফারেন্ট রেষ্টুরেন্ট ডিফারেন্ট টেষ্ট । সুতরাং আগেই বলতে হবে । কি মনে করে বললাম, মৎস্য । তাহলে মোটা মজিদের হোটেল । মৎস্য স্পেশালিষ্ট । আসো । সস্তা হোটেল । আবীর আগে আগে আমি পেছনে পেছনে । প্রায় চল্লিশ মিটার হেঁটে রূপকথা সিনেমা হলের সামনে মোটা মজিদের হোটেল ‘মজিদ হোটেল এন্ড রেঁস্তোরা’য় ঢুকলাম । ঝকঝকে-তকতকে পরিবেশ । আমরা এক কোণায় বসলাম । কিশোর বয়সের একটা ছেলে দৌড়ে এসে সালাম ঠুকে বললো, ছার, মেলা দিন পরে আইলেন ।

পরিষ্কার টেবিল, তবু হাতের ডাষ্টার দিয়ে সে পুঁছে পুঁছে মুছতে মুছতে বললো, ছার তো ছালাদ– ম্যাডাম-আপা আপনে কি খাইবেন ? আবীর বললো, এখন বড় কি মাছ রান্না করেছে তোর কাকা ? চিতল, রুই, বুয়াইল, পদ্মার পাঁঙ্গাস– থাম থাম । বোয়াল কি বড় ?ছেলেটি পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বললো, ছার– এই বুয়াইলডা ছিল আমার এত বানা ! তুই তো সত্যি কথা একদিনও বলিস না । ছেলেটি মাথায় হাত দিয়ে বললো, আল্লার কিরে মাথা ছুঁয়ে কচ্চি, বিরাট বুয়াইল ! বিশ্বেস না করেন আমার সাথে আসেন, নিজির চোকি দ্যাখেন, উঠ্যা আসেন । আমি ওদের কথপকোথনে মজা পাচ্ছিলাম কিন্তু এবার থান্ডার হয়ে গেলাম । আবীর টেবিল ছেড়ে সত্যি সত্যি ‘বুয়াইল’ দেখার জন্যে উঠে গেল । এবং ফিরে এসে আমার সামনে ছেলেটির অনুকরণে দুই হাত প্রসারিত করে বললো, এ্যাত্তবানা বুয়াইল ! এই অদ্ভুত আবীরকে দেখে না হেসে পারলাম না । স্পেসে লোক গম গম করছে– এমন নয় ; হালকা ভিঁড় । আমি আবীরকে বার বার বলতে চাইলাম সে কী খাবে ? চান্স পেলাম না বলার ।

আবীর উচ্চ স্বরে ডাক দিল, রা সে ল ! রাসেল ছুটে এসে বললো, কন ছার । মন দিয়ে শোন্ । দুই বাটি পুঁই শাকের ডাল-চচ্চড়ি, একটা টাকি ভর্তা, সবচে’ বড় একটা বোয়াল-পিস, একটা ভাত আর আমার জন্যে আশ্রম । আর এই ঠোঙায় যা আছে– ভালো করে ধুয়ে-টুয়ে কেটে দিবি, বুঝেছিস ? সালাদের লেবু, কাচাঁ মরিচ, লেটুসপাতা, ধনেপাতা, পেঁয়াজ কুচি আলাদা করে দিবি । আইচ্ছা । রাসেল চলে গেল । বললাম, আপনি খাবেন না ? অবশ্যই খাবো । তবে আশ্রম । মানে কি ? মানে একটা বারকোসে একটা শসা, একটা টমেটো, একটা সিদ্ধ গাজর, ঠোঙার আপেল, কমলা আর তোমার সাথে খাওয়ার জন্যে পুঁই শাকের ডাল-চচ্চড়ি । খাওয়া শেষে ডেজার্ট হিসেবে আমরা খাবো প্যারাডাইসের দৈ আর রাজভোগ– ওরাই এনে দেবে । মেনু ঠি ক আছে তো ? বললাম, আমি খাবোনা । আপনি আশ্রম খান । আবীর সহজ ভঙ্গীতে বললো, অতি উত্তম কথা । ম্যাডাম, আর কোনদিন আমাদের একসাথে খাওয়ার ভাগ্য তো নাও হতে পারে ? জবাবের জন্যে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আবীর । আমি জবাব দিতে পারলাম না । রাগ করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম । মন খারাপ হলো আমার । অনেক্ষণ থেকে আমি ইচ্ছে করেই কথা বলছিনা । চুপচাপ বসে আছি । আবীর আরো শীতল । যেন আমাকে সে চেনেইনা । মনযোগ দিয়ে মোবাইল পড়ছে । মনেহলো এ আমরা নই ; অপরিচিত দু’জন তরুণ-তরুণী খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি । আবীরকে মনেহচ্ছে একখন্ড কাঠ । এক সময় প্রাকৃতিক নিয়মেই খাবার নিয়ে রাসেল হাজির হলো । আবীর হাসতে হাসতে বললো, রাসেল, খাবার ফেরৎ নেওয়া যায়না ? হ্যাঁ, টেকা দ্যান, লিয়ে যাচ্ছি ।

রাসেল একটা রোবট । একটুও হাসলো না । এক্সপার্ট ভঙ্গীতে সে বিদায় হলো । আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে রসিকতাটুকু করা হলো । তারপর আবার সেই নিরবতা । এক সময় শুনতে পেলাম আবীর মৃদু মৃদু হাসছে আর বলছে, এখন কি অনুমতি দেওয়া যায় ?অনুমতি দিলে খাই ! ফিক করে হেসে দিলাম আমি । বললাম, খান । এবং কথাটা বলেই আমি পরাজয় মেনে আবীরের আগে খাওয়া শুরু করলাম । একটা ছোট্ট অভিমান একটা ছোট্ট ঘূর্ণি বাতাসে মুহূর্তে যেন বাঁশ পাতার মতো উড়ে গেল । আমারা স্বাভাবিক হয়ে গেলাম । প্রশান্ত মনে দৈ-মিষ্টি খাওয়া হলো । কিন্তু গোল বাধলো বিল পরিশোধের সময় । ভেজিটেরিয়ান আবীরের হাত-মুখ ধুতে হলোনা । সে আগে আগে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টার ক্লিয়ার করে দিল । হোটেল থেকে বের হয়ে আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা । চাঁদি গরম হয়ে গেছে আমার ।এই সময় আবীর আবার অগ্নিতে ঘি ঢেলে দিল । ম্যাডাম-আপা, এক খিলি পান দেই– মিষ্টি পান ? আমি দিগ্বিদিক ভুলে সামনে হাঁটা ধরলাম । গট গট করে । আরে আরে– ওদিকে নয় ; হেমায়েতপুর তো এই দিকে — দাঁড়িয়ে পড়লাম । আবীর এগিয়ে এসে আরো বিনয়ের সঙ্গে বললো, আসেন । আমার সাথে আসেন আপা ।

একটু সুস্হ হোন । ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, হেমায়েতপুর পাগলা গারদে যাবেন, নাকি ঠাকুরের ‘সৎসঙ্গে’ ? আসলে আপনি একটা ফ্যাসিষ্ট মানুষ । খুবই সত্য । আপনি না বললেন আপনার কাছে ভাত খাবার পয়সা নেই ?আবীর হেসে আপত্তিটি উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলো, একেবারে না থাকলে কি চলে ? ইমারজেন্সি বলে তো একটা বিষয় আছে ? মানি ব্যাগের কোণায় সেটা সবারই থাকে ম্যাডাম । এই সহজ স্বীকারোক্তির বিপরীতে কী প্রতিবাদ করা যায়, কী কথা বলা যায় ?যা-ই বলবো মানা হবেনা । তাই চুপ করে রইলাম । মনেমনে ধন্যবাদ দিলাম আবীরকে । আবীর বুঝতে পারলোনা । কম বয়সী একটা রিক্সাঅলাকে দাঁড় করিয়ে আবীর পানির বোতল ও ফ্লাস্ক হাতে করে আমাকে বললো, সিমু, ওঠো । অনুগত-বালিকার মতো আমি উঠে বসলাম। সংকোচ হলোনা । খেয়াল করে দেখলাম, আমাকে সিমি না বলে সিমু বলা হলো । আপত্তি করা উচিত ছিল । করলাম না । ইচ্ছে করেই তো আবীর ‘সিমু’ বলেছে ! প্রতিবাদ করলে হয়ত ‘সিমি’ ফিরে আসবে কিন্তু ওর একান্ত ইচ্ছের অপমৃত্যু হবে । দরকার কি ! অটোতে আমরা মুখোমুখি বসেছিলাম । রিক্সায় এখন পাশা-পাশি, ঠাসা-ঠাসি করে গা ঘেঁষে বসেছি ।

আমার মনে পড়েনা– কোন পুরুষ মানুষের সঙ্গে আমি কখনো রিক্সায় এভাবে কোনদিন বসেছি । শিহরিত হচ্ছিলাম । আবীর নির্বিকার । বললো, এই সিমু, একটা ভুল হলো । কি ? কয়েকটা ডিসপোজাল কাপ নিতে হতো, কফি খাবো কি করে ? পিছনে তাকিয়ে ফট করে রিক্সাঅলা বলে ফেললো, আপা, সামনে দুকান আছে– ‘ফ্যাসাং গিট মাট’ । হোনে কাগজের কাপ পাওয়া যায় । কিনবেন ?আবীর বললো, এই রিক্সা — সাইড কর্ । রিক্সাঅলা রিক্সা সাইড করে দাঁড়ালো । সিট থেকে নাম । সে নেমে এলো । আবীর বললো, তোর নাম কি ? বিল্লাল । এখন তোর সাথে কি আপা কথা বলছিল ? না । আমি কি বলছিলাম ? না । কাগজের কাপ পাওযা যায় কিনা ‘ফ্যাসাং গিট মাটে’ — তোর কাছে আমরা কেউ জানতে চাইছিলাম ? না ।আবীর রাগে কটমট করে বললো, এখন তোর গালে একটা কষে চড় বসানো উচিৎ ছিল আমার, মারলাম না ; কারণ, হাত দিয়ে ছুঁচো মারা উচিৎ নয় । যা এখন । আর শোন, যতক্ষণ না আমরা তোকে ডেকে কথা না বল্ছি,ততক্ষণ তুই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন-ফিরে তাকাবি না, কথা বলবিনা, বুঝেছিস ? যা । কিছুক্ষণ পরেই দোকানটা দেখলাম । রাস্তর ডাইনে, উত্তর দিক । সাইন বোর্ডে লেখা ‘ফ্যাশন গিফট মার্ট’ । দোকানে এক ঝাঁক কবুতরের মতো এক দঙ্গল স্কুলের মেয়ে অনবরত বাকবাকুম করে যাচ্ছে । আমি বললাম, কাপ কেনার প্রয়োজন নেই । আবীর অবাক হয়ে বললো, তাহলে ? তাহলে আর কি । ফ্লাস্কের কাপেই হবে । আবীর আবার বিস্মিত হলো ।

আমি হেসে বললাম, তাতে কি । এই কাপেই হবে । কি, খাওয়া যাবেনা ? আবীর আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু হেসে বললো, এইটা হলো সাশ্রয় । আবীর জানালো, শহর থেকে হেমায়েতপুরের রাস্তা তিনটি । আমরা সর্ব দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরেছি । পদ্মার পাড় ঘেঁষে । পদ্মার পাড় ঘেঁষে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা এই দিকের গ্রামগুলো পাচীন হলেও এখনো নুতন রেশ ধরে রেখেছে । তার একটি কারণ হতে পারে, প্রতিটি বাড়ির অবকাঠামো এখনো অস্হায়ী, পরিবর্তন হচ্ছেই । পলি মাটির আস্তরণে বারবাড়ান্ত ফসলে প্রতিটি বাড়ির বহিরাঙ্গন সবুজ ।লাউ মাচায় আমার জীবনে এত ঝুলন্ত লাউ আমি কখনো দেখিনি ।প্রায় প্রতিটি বাড়ির সাথে একটা করে ডোবা । ডোবার পানি অবধি তালগাছের খন্ডে পাতা সিড়ি । গ্রামের এমন দৃশ্য ছোটবেলায় বইতে পড়েছি । আজ দেখলাম । ফাল্গুনের এই বিকেলটা আজ আসলেই অন্যরকম । অনেক্ষণ আগে পুকুরে ডুব দেওয়া বালকের শুকনো গা’এর মতোন । ধূলো ধূলো । আবছায়া আনন্দের সব অদৃশ্য অনুসঙ্গগুলো পরিবেশের সর্বাঙ্গে মাখা যেন । মাঝে মাঝে ন্যাড়া শিমূল গাছের মাথায় রক্তিম আগুন– যেন আকাশ জোড়া ক্যানভাসে সৌখিন চিত্রকরের আঁকা ছবি, দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে । ধূ ধূ প্রান্তরের কড়া রোদ, ফুরফুরে হাওয়া ; গাছ-গাছালির ছায়ার ভিতর দিয়ে এসে চোখেমুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে । রিক্সাঅলার মুখে কুলুপ আঁটা । মনেহয় তার মন খারাপ । সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গজগোবিন্দ গতিতে রিক্সা গড়িয়ে চলেছে । আমাদেরও তাড়া নেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা । পাশের মানুষের গায়ে হেলান দিয়ে আরামে চোখ বুঁজে থাকতে ইচ্ছে করছে ।

হঠাৎকরে আবীর বললো, দ্যাখো দ্যাখো, ওই দ্যাখো– এস এম সুলতানের শিল্পকর্ম ! তাকিয়ে দেখলাম নারীদেহের অপূর্ব সৃষ্টি শৈলী । ডোবা থেকে গোসল সেরে ভেজা কাপড়ে ভরাট বুকের এক যুবতী সিড়ি ভেঙে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে । কলস কাঁখে বাঁকা কোমরে উপরে উঠে আসার এই দৃশ্য বড়ই মোহনীয় । জীবন্ত চিত্র । সত্যিই পটে আঁকা ছবি । ঠিকই বলেছে আবীর, এ দৃশ্য চিত্রকর এস এম সুলতানের আঁকা বিখ্যাত ছবি ‘মানবী’র । আবীর বললো, সিমু, তুমি কখনো বিদেশীনির ন্যাংটো ছবি দেখেছ ? লজ্জাকরে বললাম, হ্যাঁ । একদম ন্যুড, না স্বল্প বসনা ? দু’টোই । আবীর বললো, অশ্লীল ন্যুড ঘৃনা জন্মায় । আর প্রায় নিরাভরণ নারী তৃষ্ণা বাড়ায়, ঠিক ক না ?অস্পষ্ট করে বললাম, হুঁ । কিন্তু দেখবে গ্রামীন ললনার বিষয়টিই আলাদা ।

জীবন যাপনে ওরা প্রায় ন্যাংটা কিন্তু ন্যুড নয় সে জন্যেই ওরা ভয়ঙ্করভাবে চিত্তাকর্ষক । আমি আবীরের মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম । ওর দেখার চোখ আছে । আবীর খেয়াল করলো না । বেলা গড়িয়ে গেছে । আকাশ জুড়ে সাদা মেঘ । আমারা পৌঁছে গেছি শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুক‚ল চন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রম-আঙিনায় । আশ্রম বলতেই যে ছবি আমার মনের মধ্যে ফুটে উঠতো– আঙিনায় ঢুকে সে রকম কিছু চোখে পড়লো না । সাদামাঠা চৌকোণা লম্বা দালান । দালানে সংযুক্ত হয়েছে ঠাকুরের পূঁজোর মন্দির । উপরে কয়েকটা গোম্বুজ, দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় পুরোনো একটা ছাপাখানা । ঠাকুরের আবক্ষ আদুর-গা এবং ভক্তি প্রতিম মায়ের বিশাল পোট্রেট দেখতে পেলাম ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে । আলমারীতে ও এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়নো -ছিটানো কিছু বই চোখে পড়লো । প্রায় সবই ঠাকুর রচিত হিতোপদেশ পুস্তক । আবীর জানালো, মূলত সৎসঙ্গ আশ্রমে বৎসরে দুইবার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, ঠাকুরের আবির্ভাব তিথি ও মহাপ্রয়াণ দিবসকে কেন্দ্র করে । যুগে যুগে মহামতি মণিষীরা মানব জীবনের কল্যাণ কামনায় যে হিতোপদেশ এবং বাণী প্রচার করে গেছেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুক‚ল চন্দ্র তার ব্যতিক্রম নয় ।

এইটা নুতন কোন বিষয় নয় । বেশির ভাগ মানুষ — তাদের ভক্তরাই এখন এইসব মহামূল্যবান হিতপোদেশ মানেনা ; আচার পালন করে সাড়ম্বরে ।আমি হয়তো পূন্যিপ্রার্থী মানুষ নই– ঠাকুরাশ্রমে আমি তাই আকর্ষিত হলাম না । আবীরকে বললাম, চলুন অন্য কোথাও যাই । কোথায় ? এবার আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন । আবীর বেঁকে বসলো, কথা কিন্তু এইরকম ছিল না । কথা ছিল তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে আমি শুধু তোমাকে অনুসরণ করবো । আমি হেসে ক্ষমা চাইলাম, বললাম, আপনার এলাকা– আমি কোথায় চিনি বলুন, বেটার হয় পদ্মায় সূয্যি মামা ডোবার আগে রাঙা আকাশ দেখে ডেরায় ফিরে যাই । পদ্মায় ? হুঁ । আবীর বললো, যাওয়া যাবেনা । দুই কিলোমিটার তেতে ওঠা বালির চর । আগুন । আমি তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে বললাম, অত দূরে নয় ; ওই যে ওইখানে– সরষে ক্ষেতের মাঝখানে যেখানে সারি সারি বাবলা গাছ দেখা যাচ্ছে, সেইখানে । ওখান থেকেই সূর্য্য ডোবা দেখা যাবে । আবীর তাকিয়ে দেখে বললো, তবুও হাফ কিলোমিটার । ব্যাপার না । চলুন, আমাকে অনুসরণ করুন । বেশ । তোমাকেই অনুসরণ করলাম । বলে আবীর নিজেই আগে আগে চললো ।

আমরা হাঁটছি দক্ষিণ দিকে– পশ্চিমের নারকেল বিথীর ভিতর দিয়ে । তার পশ্চিমে বসতি । একদা প্রমত্তা পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়ে নদী-ভাঙা মানুষগুলো এই এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছিল । ফারাক্কার ছোবলে পদ্মা মরে গেছে । এদিকে প্রবল ভাঙনের বিভীষিকা নেই বটে কিন্তু জীবন-জীবিকা হয়ে গেছে রসহীন । পোড়া পোড়া । নারকেল বিথীর পূর্বে বিস্তৃত ফসলের মাঠ । মাঠখানিতে গম, সরিষা, কলাই, ছোলা-মশুর, পেঁয়াজ-রসুন প্রভৃতি ফসলের আবাদ– বাহারি রঙের মিশেলে ছবি হয়ে আছে । তারই মাঝে সারি সারি বাবলা গাছগুলো যেন বাইচের নৌকার রূপ ধারন করে স্হির দাঁড়িয়ে আছে । হু হু করে বয়ে যাওয়া বাতাসের উজান ভেঙে আমরা সেখানে পৌঁছুলেম– তখন একেবারেই পড়ন্ত বিকেল ।গাঢ় ছায়ায় ঘাসের বিছানায় পাশাপাশি আমরা হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে ঠাসঠাসা বসে পড়লাম । পানি আর চা’য়ের তৃষ্ণা পেল খুব ।

অবাক হলাম, আমার সাথের মানুষটির কথা ভেবে । চা-কফি-সিগারেট– হ্যাভিচুয়েটেড জিনিস গুলো এখনো এই শেষবেলা পর্যন্ত অস্পর্সিতই রয়ে গেছে ! আবীর ছুঁয়েও দেখেনি । ধৈর্য্য ধারনের কি যাদুমন্ত্র আছে তার কাছে ? মনের কথা মনেই রয়ে গেল– আবীর বলে বসলো, সিমু, কফি ঢালো তো, খাও । আমাকেও দাও । আর সিগার-প্যাকেটটা দিও । আমি ফ্লাস্ক-কাপে কফি ঢেলে এগিয়ে ধরলাম, নিন ।আবীর বললো, প্লিজ, টেক ইট । নিনতো । আমি পরে নিচ্ছি । কেন ? আমি হেসে বললাম, ধরেন । কেন ধরবো ? অত কথা বলতে পারবোনা, ধরেন । তুচ্ছ ব্যপারটিতে ছোটবেলায় দেখা আমার নানির কথা মনেপড়ে গেল । মন্ত্রী নানাজান ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে হয়ত কোথাও বেরুচ্ছেন, নানি পান বানিয়ে সেই কখন থেকে হাতে ধরে রেখেছেন, নানাজানের সময় হচ্ছেনা পান হাতে নেবার– হঠাৎ নানি বিরক্ত হয়ে নানাজানকে মৃদু ধমক দিয়ে বলতেন, ধরেন তো ! নানাজান তখন ল²ী নানুর মতো পানটি হাতে নিয়ে গালে মুচড়ে দিতেন । ঠিক আবীরও এই কাহিনী করলো দেখে আমি ফিক করে একটু হেসে দিলাম । আবীর না বুঝে হাসলো । আমি বুঝে হাসলাম । এক বোতল পানি মুহূর্তেই শুষে নিলাম আমরা । সিগারেট ধরালো আবীর । চুপচাপ দুজনেই । লক্ষ করলাম সিগারেটের সেই নিমগ্নতা নেই । একাগ্রচিত্ত ভাবনার সেই পরিচিত স্টাইলও অনুপস্হিত ।মাথা তুলে আচমকা প্রশ্ন করলো আবীর, তোমার কি রিলেশনশিপের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে ? বাক্যটা পরিষ্কার শুনতে পেলাম । তবু অবাক হয়ে বললাম, কিসের অভিজ্ঞতা ? রিলেশনশিপের । গায়ে আগুন ধরে গেল । তবুও আবীরের মতো নির্লিপ্ত থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে আমি বললাম, অভিজ্ঞতা কি ভাবে হবে– এইসব সব সময়ই আমি অপছন্দ করি । মনেহয় ঘৃনাও করি । গুড ।

আবীর আরো বললো, আমার কিন্তু প্রচন্ড অভিজ্ঞতা– পারলে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্হা আমার । ভার্সিটিতে প্রেম হলো ব্যবহারিক পণ্য । সেক্স বিজনেস আর ব্রেক-অফ’এর মধ্যে রোলিং হচ্ছে এখন । আমার বেলায় হয়েছে উল্টো–জোঁকের মতো লেগে আছে একজন । লবন দিয়েও ছাড়ানো যাচ্ছেনা । সেদিন একটা রুমে আটকে চড়াও হলো আমার উপর, তার সখ মেটাতে হবে । কানের গোড়া দিয়ে বেঁচে গেছি । এখন সে আমাকে টেন্ডারে তুলেছে কোটি টাকায় । অফার দিচ্ছে তার বাবার ফার্মা-ফার্মের এক্সকিউটিভ কেমিষ্ট পোষ্ট । আমি সর্বক্ষণ তার গোয়েন্দা নজরে আছি । আমি সহজ করে বললাম, মন্দ কি ? অফার বিবেচনা করা তো যায়ই । অনুমান করলাম, এই মেয়েটার নাম এলিজা ।

ভার্সিটির চেনা মুখ । ওর বাবা দেশের বরেণ্য ঔষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা । এলিজার টার্গেট আবীর — শুধু এই বিষয়টা আমি জানতাম না । আবীর মাথা দুলিয়ে বললো, অবশ্যই মন্দ নয় ; রাজ্য আর রাজকন্যা এক সাথে দু’টো ক’জনের ভাগ্যে জোটে । কিন্তু আমি হলাম অজাত ইডিয়ট । ভাগ্য বস্তুটিকে আমি পায়ে মাড়াতে চাই । সিমু, আমি সহজে টাকা কামাতে চাইলে আজ খুশির সংবাদ বলে যে ঘটনার কথাটি তোমাকে বলতে চেয়েও এখনো বলা হয়নি– সেই ঘটনাটি ঘটাবার দরকার হতোনা, মারামারি করে আহত হতাম না । এই দ্যাখো — আবীর শার্টের বাম হাতা গুটিয়ে কনুইয়ের নিচে ছড়ে যাওয়া একটা দগদগে কাটা ঘা দেখালো । টিনচার আয়োডিন দিয়ে পোড়ানো । কালো । আঁতকে উঠলাম আমি । কিছু বললাম না । খুশির সংবাদ শোনবার ইচ্ছে আমার তিরোহিত হলো । বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মন । অবশেষে হতাশ হয়ে বলেই ফেললাম, এই আপনার খুশির সংবাদ ? না, এটা খুশির সংবাদ নয় । এইটা দু:খের সংবাদ । খুশির সংবাদ হলো, আমি একদল জানোয়ারের দূরবীন থেকে মুক্তি পেয়েছি । ক্যাম্পাসে এখন আমি স্বাধীন । রাজনীতি না করেও ক্যাম্পাসে থাকতে পারবো ।

আমরা যারা নিরিহ শিক্ষার্থী — রাজনীতির সাতে-পাঁচে থাকতে মন টানেনা ; তারা শুধু দেখি, ক্যাম্পাসে গন্ডগোল হচ্ছে, ছাত্রদের মধ্যে লাঠি-সোটা, অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হচ্ছে । গুলি হচ্ছে । তখন অবাক হই । গভীরের খবর রাখিনা । ইচ্ছেও হয়না । রাজনীতি যে এখানে শুধু একটা ধান্ধাবাজির হাতিয়ার– কিছুটা আন্দাজ করতাম, আজ আরো স্পষ্ট করে জানলাম আবীরের কাছে । ভার্সিটিতে রুলিং পার্টির ছাত্র শাখায় বদ মেজাজী, নিষ্ঠুর এবং বেপরোয়া চরিত্রের কতিপয় নামধারী ছাত্র একটানা দীর্ঘদিন যাবৎ নেতৃত্ব দিয়ে আসছে । তারা এ্যাকশন কমিটি অব অল আসপেক্টস ফর দ্য স্টুডেন্টস (একাস), পিইউএসটি’র নাম ভূমিকায় সরেজমীনে উপস্হিত থেকে ছাত্র কল্যাণের নামে হেন কাজ নেই — যা করেনা । এই কমিটির মূল কাজ হলো টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা । তাদের আর একটা গুরু দায়িত্ব হলো ক্যাম্পাসে যেন কোন অবস্হাতেই অন্য কোন পার্টির ছাত্র সংগঠন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারে ; শুরুতেই তাদের ছাল-বাকলা তুলে নিয়ে কোমর ভেঙে দেওয়া । চৌকস আর মেধাবী ছাত্র যারা– পছন্দ হলে– বাধ্যতামূলক তাদেরকে সংগঠনের সদস্য করা ; এবং সংগঠনের কার্যক্রমে ( মিছিল-মিটিং ) নিয়মিত তাদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা । না হলে টার্গেটের জন্যে বিপদ ; সমূহ বিপদ । সবাই জানে । সম্ভবত মানেও ।

আবীরকে এই প্রক্রিয়াতেই ‘একাস’এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সে কৌশলে নিজেকে ওদের সঙ্গে মানিয়ে নেয় । হুড়-হাঙ্গামা, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পারিপার্শ্বিতার মধ্যেও দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছিল বাঘা বিড়ালের মতোই । নিরবে । নিরুপদ্রপে ।দিনে দিনে সংগঠনের প্রভাবশালী নেতা যুবায়ের আলমের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে । হয়তো তখনো উভয়ের মধ্যে ভালো ছাত্রের একটা প্রবণতা অবশিষ্ট ছিল । একদিন জানা গেল তাকে বেনিফিসিয়ারী সদস্যপদে উন্নীত করা হয়েছে । একাস’এর মিটিং কল করা হয়েছে । এই মিটিং’এ আবীরকে উপস্হিত থাকতে বলা হলো । ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে ছিল আবীর । নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো সে, এই প্রথম কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সভায় আমার আমন্ত্রণ । কৌতূহল তো ছিলই ; পরিবেশের বিরুদ্ধ প্রভাবেও আমি ছিলাম মনমরা । আমার জন্যে কী বেনিফিট অপেক্ষা করছে সেইটা দেখার আগ্রহে আমি সময় মতো সভাস্হলে উপস্হিত হলাম । সভা আহবান করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হলের চতুর্থতলার পশ্চিম কর্ণারের রুমে । গিয়ে দেখি রুমের দরজা বন্ধ ।

দরজায় টুল পেতে বসে আছে এক খোকসা-যুবক । অশিক্ষিত গোঁয়ার-টাইপ চেহারা তার । ভাবলেশহীন কর্কশ কন্ঠে বললো, দাড়াঁন । নাম কন । অসহ্য রকমের বেয়াদব মনে হলো । তবু নাম বললাম । সে হাতের মুঠোয় মোচড়ানো এক টুকরো কাগজ মেলে ধরে দেখে নিল এবং দরজায় তিনটি টোকা দিল । সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল । ভিতরে গিয়ে দেখলাম, ওপাশে আরো একজন দাড়াঁনো । সেন্ট্রি । সে বললো,স্যার আসেন । এই ছেলেটি পরিচিত । অজ্ঞাত কারণে সে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শাখার কনভেনার মঞ্জুর এলাহীর সাথে থাকে সবসময় । রুমের চৌকাঠ পার হতেই মদের গন্ধে নাকতেলে জ্বলে উঠলো । পেট গুলিয়ে গেল । দশ-বারো জন বড় বড় ছাত্র নেতা– বড় একটা গোল টেবিলের চারপাশে এলো-মেলো চেয়ারে ততোধিক এলো-মেলো হয়ে বসে আছে । টেবিল ভর্তি পোড়া মাংস, চানাচূর, সিগারেটের প্যাকেট, কাঁচের জগে ডাবের পানি, গেলাস আর ডজনখানেক রঙিন মদের বোতল । বেশিরভাগ শ্যাম্পেন, ভোদকা এবং বীয়ার ক্যান । সবার চোখ আমার দিকে । আমার চোখ ছানাবড়া । জোসনার মতো হালকা আলোয় বসা কে একজন আনন্দিত হয়ে বললো, ওয়েলকাম । ওয়েলকাম আওয়ার নিউ-ব্রান্ড লিডার ।

বি সীটেড আ্যন্ড এনজয় দ্য টাইম । পাশ থেকে আর একজন প্রসংশা করলো আমার, ইউ আর পাঞ্চুয়াল গাই– রাইট টাইমে এসেছ । আমরা শালার লোভে পইড়া আগেই চইলা আইছি– মাল খাওন আছে বইলা । টেবিলে পা তুলে বসে ছিল মঞ্জুর এলাহী । নামিয়ে নিল। লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ভারী কন্ঠে ঘড়ঘড় শব্দ করে বললো, আ্যাই ছেলে দাঁড়িয়ে কেন, বসো বসো । বসো ।শেষের শব্দটি সে ধমক দিয়েই বললো মনেহয় । আমি চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম । সেই চেয়ারেই বসে পড়লাম । আমার ডানপাশে জুবায়ের আলম, বামপাশে খালি চেয়ার, তার ওপাশে জগলু– বুনো ষাঁড় । তার স্বভাব হলো অন্যকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো, গুঁতো দেওয়া এবং সুযোগ বুঝে মেয়েদেরকে উত্যক্ত করা । আমি পারতপক্ষে জগলুকে এড়িয়ে চলি । নিজেকে এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না । হাসফাঁস লাগছিল ।

আমার অবস্হা বুঝতে পেরে মঞ্জুর এলাহী প্রায় জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বক্তৃতা শুরু করলো, আ্যাই ছেলে, তোমার ভাল না লাগলে তুমি চলে যাও । বুজলা, এইডারে তুমি যেই রহম মিটিং মনে করতেছ এইডা সেই রহম মিটিং না । এইডা বেনিফিসিয়ারীদের মইদ্যে ডিভিডেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন সিটিং । গেল তিন মাসে সার্টেইনড সোর্স থেইকা সংগঠন যা আয় করছে– ডাইহার্টেড কর্মীদের মইদ্যে কন্ট্রিবিউশন রেসিওতে এইডা হইল গিয়া ফিক্সিং, লগে একটু আমুদ অনুষ্ঠান আর কি, বুজলা, এইডা মিটিং নয় ; এইডা সিটিং । আর তুমি কিন্তু ডাইহার্টেড কর্মী নও আর সংগঠনের জন্যে তুমি কোন কন্ট্রিবিউটরও নও, মনে রাইখো । তুমি হলো ফাউ । যুবায়েরের কথায় আমি বায়াসড হইছি । তুমি যাইতে চাও — এহন যাইতে পারো । যাওনের আগে সিহাব সরকারের কাছ থেইকা তোমার ভাগের চল্লিশ হাজার টেকা লিয়া যাও । শোন ছেলে, কাম ভাল দেখাইলে ভবিষ্যতে বেশি টেকা পাইবে । এহন যাও । কাম দেখাও, কাম দেখাও– সিহাব সরকার উঠে এসে আমার হাতে টাকার প্যাকেটটা তুলে দিল । আমি নিলাম । টাকার লোভ সামলানো কঠিন । অসাধ্য প্রায় । হরিবোলের টাকা ।

রাজার হালে প্রাপ্তি– মাথা নষ্ট করে দেয় । ঝিম ছেড়ে মঞ্জুর এলাহীর ঘোলা চোখের দিকে তাকালাম আমি । গভীর করে কিছু ভাবলাম না, বলে ফেললাম, ভাই, আমি এ টাকা নিতে পারবোনা । আমাকে মাফ করবেন । পাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে জগলু লাফিয়ে উঠে বললো, ভাই, আমি আগেই কইছিলেম, এই শালা একটা রাজাকার । মুক্তি যুদ্ধের চেতনা বিরোধী– স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে এর আঁতাত আছে । একে বিশ্বেস কইরবেন না । এবার প্রমাণ পাইলেন তো ? আমার সহ্য হলোনা । আমি শাসিয়ে বললাম, জগলু– মুখ সামলে কথা বল্ । চিৎকার করে বললো জগলু, এই শালা রজাকারের বাচ্চা, বেশি ফালাফালি করিসনে, চোপা ভেঙে দেবো কিন্তুক । দেখলাম ওর হাতে রিভলবার । কোমরে গোঁজা ছিল । বের করেছে । আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল । আমার বাবার কথা আমার মনে নেই । বুদ্ধি হবার আগেই আমি তাকে হারিয়েছি । পাড়াপড়শির কাছে, মা’র কাছে প্রতিনিয়ত আমার বাবার গল্প শুনেছি। তিনি ট্রেইনড মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না । কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, সাধারন মানুষের কাছে তিনি খুব জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন । বার বার তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে গোয়েন্দার কাজ করেছেন ।

‘রানু মামা’ বললে এখনো এলাকায় আমার বাবাকে চেনে সবাই ‘বাঘ মামা’ বলে । আমার সেই বাবাকে আজকের একটা পোংটা ছেলে ‘রাজাকার’ বলে গালি দিচ্ছে– ঔদ্ধত্যের একটা মাত্রা আছে । আমি ক্ষিপ্ত হয়ে ওর ঐ রিভলবার’অলা হাত গুঁড়িয়ে দিতে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম । শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেয়াল বরাবর প্রচন্ড একটা ঘুঁসি বসিয়ে দিতে চাইলাম । কিন্তুমুহূর্তে জগলু সরে গেল, টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে সে উপুর হয়ে পড়লো । হাতের রিভলবার ছিটকে টেবিলের নিচে চলে গেল । আমি পড়লাম গিয়ে সাইড-ওয়ালের কোণা বরাবর পিলারের ওপর । বাম হাতের কনুইয়ের নিচে চামড়া খানিকটা ছড়ে গেল । জামা চুঁইয়ে ফোটায় ফোটায় রক্ত ঝরতে লাগলো ।

জগলু শোয়া অবস্হায় রিভলবারের দিকে হাত বাড়ালে যুবায়ের তড়িৎ বেগে উঠে গিয়ে জগলুর কব্জির উপর পাঁড়া দিয়ে ধরলো । সাউট করে বললো, সিহাব, সিহাব– রিভলবারটা ওঠা । সিহাব রিভলবার হাতে নিয়ে সীটে ফিরে আসছিল– যুবায়ের পা সরিয়ে নিতেই জগলু স্প্রিং’এর মতো লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং ক্ষ্যাপা কুত্তার মতো সিহাবের দিকে এগিয়ে যেতেই যুবায়ের কষে এক থাবড়া ঝেড়ে দিল তার ঘাড়ে । জগলু বেসামাল হয়ে ধাক্কা খেল দরজার সঙ্গে গিয়ে । ভিমরী খেয়ে স্হির দাঁড়িয়ে রইল সে । যুবায়ের শ্লেষের সঙ্গে বললো, বায়েন চোৎ, মাস্তানি করার জায়গা পাওনা ? সংগঠনে আর তোর কোন জায়গা হবেনা । বেরহ’ কুত্তার বাচ্চা । গেট আউট । রোষকষায়িত চোখে যুবায়ের ফের জগলুর দিকে এগিয়ে গেল আবার ।

জগলু আস্তে করে দরজা খুলে বের হয়ে গেল । হঠাৎ হাত তালির শব্দে সবাই চকিত হলো । অবাক কান্ড– ফোলা ফোলা লাল চোখে হাত তালি দিচ্ছে মঞ্জুর এলাহী । সে নেশায় বুঁদ ।ভঁত ভঁত করে বললো, ওয়েল । ওয়েলডান লীডার । জগলুকে মাইর দিয়া খুব ভাল করলা বন্ধু ।ব্রাভো ব্রাভো । আমি হলে শালাকে মূতায়া ফেলাতাম । সহসা আমার দিকে নজর পড়লো তার । আ্যাই, আ্যাই ছেলে– কে যেন তুমি, কি যেন নাম তোমার– তুমি এহনই কাইটা পড়ো, তোমাকে দিয়ে এসব কিচ্ছু হবেনা, বুয়েছ ? যুধীষ্ঠির– লেখাপড়া করোগে যাও । যাও । যুবায়ের আমার দিকে এগিয়ে এলো ।

মাথা নিচু করে অনুচ্চস্বরে বললো, যা: ডাক্তার দেখাগে যা: । একটু থেমে আবার বললো, তোর জন্যে এই ভালো হলো । সন্ধ্যার পূর্বরাগে চারদিকে সোনালী আলোয় ভরে গেছে । সুনসান নির্জনতায় গাছে গাছে শুধু পাখির কলরব । আর কোন শব্দ নেই । চুপচাপ আমরা দু’জনেই । কারো মুখে কোন কথা নেই । আসলে কথা বলার ভাষা নেই– আমার তো নেই-ই । নির্জনতায় দুর্বোধ্য সময়টুকু এক আশ্চর্য্য রকমের শুন্যতায় পার হয়ে যাচ্ছিলো– কিন্তু আবীর ফস করে একটা সিগারেট ধরালো । আমি চমকে তাকালেম । সিগারেট ধরানোর জন্যে নয় ; শুন্যতার নি:সীম অতলান্ত থেকে অকস্মাৎ ফিরতে হলো বলে । সিগারেট হাতে আবীর বাবু হয়ে বসেছে । সেই নিমগ্নতা– সেই গভীরে ডুব দেওযা । সেই একই রকম ভাবের মূর্তি । আজ এখন আবার দেখলাম ।হঠাৎ মনেহলো আমার, অসময়ে কেন এই সিগারেট– এমন তো হবার কথা নয় ? এ নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যায়, কথা বলাই যায় ! কিন্তু বললাম না । কেন যেন কি ভেবে থেমে গেলাম ; মনেহলো, কখনো কখনো পৃথিবীতে বাক স্বাধীনতা উপভোগ করতে নেই । যা ইচ্ছে বলতে নেই । বলা বোধহয় উচিৎও নয় ।চুপ করে গেলাম ।

আবীর টের পেলনা– খেয়ালই করলো না, আমি ওর দিকে চেয়ে আছি অনেক্ষণ । যখন শেষ টান দিয়ে সিগারেটের ওয়েস্টেজটা দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে টোকা দিয়ে সে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল তখন আমি বললাম, চলেন– উঠি আজ । সন্ধ্যে হয়ে আসছে । রহস্যের হাসি হাসলো আবীর । আমার চোখের দিকে কেমন তাকিয়ে থাকলো । কথা বলতে গিয়ে অনেকবার আবীর আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু এভাবে কখনো তাকায়নি । আমি কিছু বলার আগেই সে হেসে বললো, আজ না হয় উঠলাম কিন্তু তারপর ? মাথা নিচু করে আমি মৃদু স্বরে বললাম, আপনি যেদিন বলবেন, সেইদিন আবার দেখা হবে । আবীর কেমন মন খারাপ করে বললো, আমি আর কোনদিন বলবোনা । এভাবে আর আমাদের দেখা হবেনা । কেন ? দিনদিন এ রকম করেই তো মনের তৃষ্ণা বাড়ে । এর শেষ কোথায় জানো ? কোথায় ? লজ্জাস্হান বিনিময়ে । আমি শরমে মরে গেলাম । চোখ দু’টো যে কোথায় আমি লুকোব ভেবে পেলাম না । মাটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ছি : ছি: বলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবে না তুমি । আজকাল এগুলো ডালভাত– ইচ্ছে হলেই হয় । যৌবন রোমান্স করবার জন্যেই ।

আমি আর কথা বলতে পারলাম না । জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে রইলাম । শরীরের সেনসিটিভ জায়গাগুলো ওড়না দিয়ে ফের ঢেকে দিলাম । আবীর নির্লজ্জের মতো হা হা করে হাসলো, বললো, তুমি খামাখা লজ্জা পাচ্ছো সিমু অথবা ভয় পাচ্ছো । আমাদের মধ্যে ঐ রকম মূর্মূষ অবস্হার সৃষ্টি হয়নি । তবে এটা সত্যি যে, আমি যুধীষ্ঠির নই । তোমার মতো অনিন্দ্য সুন্দরীকে রোজ রোজ নিরিবিলিতে এত কাছে পেলে ফেনোমেনোটিভ আকর্ষণ আমার তো বেড়ে যেতেই পারে ! তখন কি ধৈর্য্য ধরা কঠিন হবেনা ?আমি এবার ঠোঁট টিপে হেসে মাথা নিচু করে বললাম, আপনি চাইলে আমার কোন কিছুতেই সমস্যা নেই । অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেও আমি বুঝতে পারলাম, আবীর রাক্ষসের মতো আমার দিকে চেয়ে আছে ।পরিবেশ হঠাৎ করেই কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল । অস্বস্তিকর । টের পেলাম, আমারও শ্বাস-প্র:শ্বাস গরম হয়ে উঠেছে । ভিতরের ধুকপকানি বেড়ে গেছে । শক্ত হয়ে বসে আমি চোখ বুঁজে রইলাম । মুহূর্মুহূ শিহরণ জেগে উঠছে ভিতরে । অস্হির মুহূর্তগুলো দ্রæত ফুরিয়ে যাচ্ছে । খারাপ লাগছে খুব ।

এমন সময় আবীর গমগম শব্দ করে বলে উঠলো, তোমার সাহসের তারিফ করি– আমাকে বিশ্বাস করে তুমি আজ জিতে গেলে । অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে । আমি চোখ খুলে বিস্ময়ে বললাম, জিতে গেলাম ? হ্যাঁ, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিলো তুমি একখন্ড জমাট বাঁধা বরফ । এই বরফ এখন ছোঁয়া যাবেনা । ছুঁলেই গলে যেতে পারো । আমি খুশি হয়ে বললাম, ভয় পেয়েছিলাম খুব। পশ্চিম আকাশে আগুন রঙের মেঘ– অনবরত ওলট-পালট হচ্ছে । নিচে চিরচেনা পৃথিবীর আবাস– আবছায়া আঁধারে ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যাচ্ছে । শংকর সময়ের এই সন্ধ্যাকে আজ মনেহচ্ছে সে সত্যিই রহস্যময় । তার অস্তিত্বের সবকিছুই অনিশ্চত এবং অপূর্ণতায় ছাওয়া। আবীর উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার উঠতে ইচ্ছে করছেনা। ক্লান্ত আর অবসন্ন শরীরে এক রকমের অসারতা পেয়ে বসেছে আমায়। আবীর হাত বাড়িয়ে দিল হাত ধরে উঠে আসার জন্যে। আমি হাত এগিয়ে দিলাম। শক্ত করে চিপে ধরে সে হেঁচকা টান দিয়ে আমাকে তার বুকের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। ওর গরম নি:শ্বাস আমার নাকে-মুখে ছড়িয়ে পড়ছে । একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ সহ্য করে আমি পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আবীর আমার হাত ছেড়ে দিল। শান্ত স্বরে বললো, চলো । রাত নেমে আসছে ।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580