বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :

নীলরঙ প্রজাপতি

নিউজ ডেক্স:
  • প্রকাশিত সময় : বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ৩৬৫ পাঠক পড়েছে

নীলরঙ প্রজাপতি

আমজাদ হোসেইন

আব্বুকে অফিসে ফোন দিয়েছিলাম । হতাশ কন্ঠে তিনি বললেন, এ ভাবেই তো একদিন চলে যাবি । যা: । আম্মুরও ছিল অনেক আপত্তি-অনুরোধ । সব উপেক্ষা করে আমি পাবনায় চলে এলাম । হোষ্টেলে পৌঁছুলেম–  শীতের সূর্য্য হেলে পড়েছে তখন । এসে খারাপ লাগছিল । বাসে রাস্তার ধূলো-বালি, যাত্রীদের চিৎকার-চেঁচামেচি, গা-ঠাসা-ঠাসি বারোভাজা অবস্হায় তখন বুঝতে পারিনি– এখন নোংরা লাগছে । গরম পানির দরকার ছিল । নেই । হিটারও নষ্ট । এই ঠান্ডায় বাধ্য হয়ে হিমশীতল পানিতে শাওয়ার নিলাম । ঠকঠক কাঁপুনি উঠে গেল । বহু কষ্টে ডাইনিং’এ গিয়ে দেখি, বিশাল রুম যেন গড়ের মাঠ ; কোথাও কেউ নেই । এক কোণায় টেবিলে সিলভার-ডিশের তলানীতে শক্ত কিছু ভাত এবং প্লাষ্টিকের গামলা ভর্তি গঙ্গা-ডাল শোভা পাচ্ছে । খেয়াল হলো, বড়দিনের বর্ধিত ছুটি চলছে এখন । কিচেনে যোবেদা এবং তুলি রাতের মসলা পিষছে । ডিনারের জন্যে ডবল-ডিমের বাটি, আলু ভর্তা, সব্জি আর ভাজা শুকনো মরিচের ফরমায়েশ দিয়ে রুমে চলে এলাম । রাস্তায় কেনা কমলা আর বয়ামে রাখা বাখরখানি দিয়ে লেট-লাঞ্চ সেরে নিলাম । তারপর আরামে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম–  জম্পেস ঘুম দেব একটা । সবার হয় কিনা জানিনা, তবে আমার হয়– নির্জন ঘরের আলো-আঁধারিতে লেপ মুড়ি দিয়ে শোবার পর মস্তিস্কে স্বতন্ত্র একটি জগৎ সৃষ্টি হয় । সেখানে যা ইচ্ছা ভাবা যায়,করা যায় । শুয়ে চোখ বোঁজার কিছুক্ষণ পর সকালের কথা ভেবে আমার লজ্জা করতে লাগলো । যে আম্মুর সামনে সাধারণ কথা বলতে গেলে হিসেব করে বলতে হতো, সেই আম্মু যতো সহজই হোক তাকে কাব্যি করে একটা ছেলের সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্কের বিষয়টাই তো আসলে জানান দেওয়া হলো–  আফটার অল, আমার মনের মধ্যে তো উপলক্ষ ছিল ওই আবীরই ! কি ভাবে পারলাম? আমি রসিকতার ছলে সত্য গোপন করেছিলাম । এমনি করে চলে আসায় আম্মুর আপত্তি, আব্বুর হতাশা আর মাথায় আবীরের সহসা উটকো অনুপ্রবেশ–  সব মিলিয়ে মনের মধ্যে এক রকমের স্যাঁতসেঁতে অবস্হার সৃষ্টি হলো । ঘুম আসবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আবীরের এই ‘অনুপ্রবেশ’ ভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা ম্যারমেরে উত্তেজনা সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে লাগলো । কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙলো একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে । যেমন বিশ্রী, তেমনই তা লজ্জাজনক ! লাল ইটের একটা পোড়ো বাড়ি । আশপাশে দেখছি গজিয়ে ওঠা বিক্ষিপ্ত জঙ্গল । সেখানে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি । একা । আবার দেখলাম আমি একা নই । অদূরে ন্যাংটো হয়ে ঘুরছে আবীর । দেখে খিলখিল করে হাসছি আমি । প্রলুব্ধ হলো সেও । মৃদু হেসে আবীর এগিয়ে আসতে থাকলো আমার দিকে । আমি পিছিয়ে গিয়ে ভাঙা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম । মাথা নিচু করে আছি । ভয় ভয় করছে আমার । গা শিরশির করছে ; একটু একটু কাঁপছিও মনেহয় । তারপর আর বলা যাবেনা । দেয়ালে চেপে ধরে যা করার–  আবীর করে ফেললো । বুনো মোষের মতোন ।ঠাস করে একটা চড় কষে দিলাম আবীরের বাম গালে । ঘুম ভেঙে গেল । ধরফরিয়ে উঠে বিছানায় বসলাম । গলা শুকিয়ে কাঠ । হতভ্ম্ব আমি– বিপর্যস্ত অবস্হায় অধোবদনে বিছানায় বসে রইলাম অনেক্ষণ । যদিও স্বপ্নের ব্যাপার তবুও কেবলই মনেহচ্ছিলো–  সব সত্যি । বাস্তবেই ঘটে গেছে সব । পরিচিত সমাজে এখন আমি মুখ দেখাবো কি করে — বিশেষ করে আবীরের সামনে ? দৈনন্দিন জীবন যাপন, একাডেমিক রুটিন, টিউশনি–  যথারীতি বহাল তবিয়তে চলছিল বটে কিন্তু মন থেকে কদর্য-স্মৃতিটুকু মুছে ফেলতে পারছিলাম না । অষ্টপ্রহরে অবিকল ঘটনাটি একাধিকবার মনে পড়তে লাগলো । লজ্জা এবং লোভে আমি নাকাল হতে থাকলাম । অবশেষে একদিন সন্দেহ হলো,মনে কদর্য-প্রিয়তা বাসা বাঁধছে না তো আমার ? ল্যাবের দোতালা-বারান্দার কোণে সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, পুকুর পাড়ের চারা ছাতিম গাছের ছায়ায় দৃষ্টি চলে যায়–  চমকে চমকে উঠি, এই বুঝি দেখা হয়ে যায় । শুধু শুধু লজ্জা পাই । মাথা অবনত করে থাকি অযথাই । কিন্তু আবীর আসেনা । দেখাও হয়না । প্রত্যেকবার আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঁচে যাই । এমনিভাবে প্রায় একমাস পার হয়ে গেল । ধুলো-বালির আস্তরণ পড়তে লাগলো মনে । কথায় বলে, জীবন হলো নাটক ! একদিন নাটকীয় ভাবে দেখা হয়ে গেল আবীরের সঙ্গে । সেদিন ছিল ছুটির দিন । দুপুরবেলা গোসল সেরে সেমিজ গায়ে জনালায় দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছি । বাতাসে শীত বিদায় হচ্ছে । দেখছি । জানালায় চনমনে রোদ । সরু সরু গাছের দু’একটি শুকনো পাতা উড়ে এসে জানালার গ্রিল ছুঁয়ে আমার চোখে-মুখে পড়ছে । আরাম লাগছে । দোতালা থেকে নিচের রাস্তায় তাকিয়ে আছি । এমনি এমনি । টুংটাং শব্দে মেয়েরা হঠাৎ-হঠাৎ রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে  হোষ্টেলে ঢুকছে । দেখি ভ্যান-গগ-হ্যাট মাথায় আবীর হেঁটে যাচ্ছে । আবীরই তো ! চেঁচিয়ে ডাকা যাচ্ছেনা ; কি করি–  একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল মাথায় । পড়ার টেবিলে প্রত্যেক মেয়েরই একটি করে ইমার্জেন্সি মুখদেখা আয়না থাকে । সেই আয়না হাতে করে এসে আমি জানালায় দাঁড়ালাম । শিকারি যেমন বন্দুকের তাক করে–ঠিক ক তেমনি করে ঝকমকে রোদ আমি আয়নায় রিফলেক্ট করে দিলাম আবীরের মুখে । যাদুর মতো কাজ হয়ে গেল । চোখ কুঁচিয়ে বিম্বিত আলো অনুসরণ করে আবীর উপরে তাকালো । আমি হাত বাড়িয়ে ইশারা করলাম ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে । বুঝতে পারল কিনা বুঝলাম না ।এমনো হতে পারে আমাকে সে চিনতেই পারেনি । আমি দ্রুত একখানা ফুল-স্কেপ কাগজে বড় বড় করে লিখলাম– ‘দাঁড়ান’ । আমার নাম লিখতে গিয়ে থেমে  গেলাম ; আবীর আমার নাম জানেনা । যা হোক, কাগজখানাকে আমি মোয়া বানিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আবীরের কাছাকাছি । আবীর কুড়িয়ে নিল । এবার আমি হাওয়ার বেগে তৈরী হতে থাকলাম । তৈরী হওয়া মানে– এম্ব্রয়ডারী করা টুকটুকে লাল কামিজ গায়ে চড়িয়ে নিয়ে ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে নিলাম । শরীরের এখানে-ওখানে একটু স্প্রের ফুস দিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দৌড় দিলাম । আমাকে দেখে আবীর অবাক হয়ে বললো, আরে আপনি ? আমি বললাম, ভালো আছেন ভাইয়া ? এদিকে কোথায় যাচ্ছেন ? কোথাও না । আমি হাসলাম । যাচ্ছেন– আবার বলছেন যাচ্ছেন না, এইটা কেমন কথা ? আবীরও হেসে ফেললো । আসলেও কোথাও  যাচ্ছিনা । হাঁটছি আর ভাবছি, আজ খুশির দিন– এডিশন একটা সিগারেট এবং আরো এক কাপ ব্ল্যাক কফি খাবো আর ফাষ্ট-সিন কোন বন্ধুকেও খাওয়াবো । আপনি তো সিগার খান না । সুতরাং আপনাকে দিয়ে হবেনা । বলে সামনে পা বাড়ালো আবীর । এ কি অদ্ভুত কান্ড ! কি বললো, কি বুঝালো আবীর– না বুঝিয়েই নির্মোহ ভঙ্গীতে সে আমাকে পরিত্যক্ত ঘোষনা করে হাঁটা ধরলো, এটা তো হতে পারেনা ! বললাম, দাঁড়ান । কি বলছেন আপনি, ভালো করে বুঝিয়ে বলুন । আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন যে ? আবীর দুই হাত জড়োকরে বললো, সরি । আপনাকে আমি ফেলে যাবো কি করে, আপনি তো আমার সাথেই ছিলেন না । আসলে খুশিতে সামান্য টেনশনে আছি । খুশিটা কিসের, বলা যায় ? আবীর দাঁড়ালো, বললো, চলুন আমার সাথে, বলবো । যদি ভর দুপুরে আপত্তি না থাকে তো এক কাপ কফি খাবেন আমার সাথে । আমি বললাম, এখন ভাত খাবো । ভাত খাওযার পয়সা নেই আমার কাছে। আবীরের স্ট্রেইট-কাট কথায় খুশি হলাম । বললাম, আমি খাওযাবো । কিন্তু খুশি কি জন্যে– জানাতে হবে। আরে ? বলবো বলবো, এত তাড়াহুড়া করছেন কেন । আমি দুপুরে ভাত খাইনা। তাহলে কি পিঠা খান? আবীর হো হো শব্দে হেসে উঠে বললো, আসলে ভাত পাইনে তো– তাই চা খাই । আমি হাসতে চাইলাম না। অথচ হেসে ফেললাম । আপনি হাসছেন ? আমি কিন্তু আপনাকে সত্য বলেছি । বেশ । একদিন খেলে কিছু হবেনা। আজ খাবেন । ভাই, দীর্ঘদিনের অভ্যেস । হজমে সমস্যা হতে পারে । বরং আমি আবীরকে কথা শেষ করতে দিলাম না, বললাম, বরং আমরা আজ পিঠাই খাবো, রাজী ? আবীর এক গাল হেসে বললো, রাজী। এবার বলুন খুশির খবরটা কি ? এই খবরটা এ ভাবে হাঁটা পথে বলা যাবেনা । কিছু আনন্দ আছে যার পটভূমি বলতে  হয় । কিছু বেদনা আছে যার শানে নজুল জানাতে হয়, তবেই বিষয়টি পূর্ণতা পায় । আমি বললাম, বাব্বাহ্! একচোট মাষ্টারি ফলালেন ? আমি মনেপ্রাণে মাষ্টার যে ? নির্ঝঞ্ঝাট পেশা– ঘুষ নেই । কর্তৃত্ব নেই । আমি মাষ্টারিই করবো– এটাই আমার ইচ্ছে । মহান ইচ্ছে আপনার । আমার কথার ধরণ গ্রাহ্য  করলো না আবীর। সে বলেই চললো, যদি সুযোগ পাই– বিদেশ’অলারা আমাকে যদি তাদের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে সেখানে পড়বার সুযোগ দেয়, আমি যাবো এবং ফিরে এসে দেশে মাষ্টারিই করবো । আবীরকে আর ঘাঁটানো যাবেনা ; ও সিরিয়াস। আমি বললাম, খুশি হওয়ার কথা আর পিঠা খাওয়ার কথা কিন্তু আমি ভুলতে পারছিনা ভাইয়া । দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, তড়িৎ ব্যবস্হা করা দরকার । আবীর বোকার মতো বললো, কি করা যায় তাহলে? আমি পুরাই চান্স পেয়ে গেলাম এবার । বললাম, এক কাজ করা যায়, পিঠা এবং পটভূমির জন্যে যেহেতু নিরিবিলি জায়গার দরকার– হাতে সময় থাকলে ভাইয়া আজ নাহয় এক বেলা ক্যাম্পাস এক্সিট করলাম,কি বলেন ? আবীর মনযোগ দিয়ে আমাকে দেখছে । কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা । আমি আর একটু আন্তরিক হবার চেষ্টা করলাম । বললাম, জীবনে শুধু হাঁফিয়ে উঠে লাভ কি– শ্বাস ফেলারও তো দরকার আছে, তাইনা ? আবীর খটমট করে উত্তর দিল, এসব আমাদের আর হলো কই ! আমি আর কথা বাড়ালাম না । এক ধরণের মানুষ আছে, যারা সব সময় নিজেকে ‘মীন’ করে কথা বলে । শুনে রাগ হয় । জোরে জোরে হেঁটে আমি ওকে পাশ কাটিয়ে আগে যাবার চেষ্টা করলাম । সেই সময় আবীর পাশ থেকে আমাকে টীজ করে বললো, ঠিকক আছে, বলছেন যখন নুন খেয়ে দেখা যায়– বিস্বাদ, না স্বাদ !তারপর অস্বাভাবিক শব্দে হো হো করে হেসে উঠলো ও । এমন বেহায়া হাসিতে আমার লজ্জা করতে লাগলো । অস্ফুট স্বরে বললাম, অসভ্য !ও শুনতে পেলনা। তখনো হাসির শব্দ হচ্ছিলো গমগম করে । আমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে । কি বলবো আমি । আবীর এত ফাজিল হতে পারে, আমার জানা ছিলনা । সে এবার হেঁটে এসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, লস করে লাভ নেই । চলুন আমি রাজী । আমিও দ্বিগুন উৎসাহে বললাম, আমিও রাজী । চলুন, আমি যেখেনে নিয়ে যাই, চুপচাপ অনুসরণ করবেন শুধু, ঠিক আছে ? তথাস্তু । আমরা মেইন গেইট পার হয়ে এসে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালাম । দুই ধারে পাঁচিল ঘেঁষে রেঁস্তোরা । দোকান-পাট । নাস্তা-পানি-মিষ্টি, ভাত-মাছ-মাংস, ড্রিংস সবই মেলে এখানে । কখনো কখনো নেতাদের রুমে দোকানীকে সিক্রেট অর্ডার পৌঁছে দিতে হয় । ওরা বাধ্য । তাছাড়া এগুলা ওদের মোটা আয়ের উৎস । আবীরও মনেহয় মার্কিং-সারির নেতা । আমার অনুমান । আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আবীর জানতে চাইলো, যাত্রা কি শহরে, না পল্লীতে ? মানে কি ?মানে আপনাকে অনুসরণ করে কোথায় যেতে হবে– ঢেলের ভূঁইতে, না দালান- কোঠায়, সেখানে কি চা-কফি পাওয়া যায় ? ঠিক জানিনা । আমি আগে কখনো যাইনি । তাহলে জায়গাটা কোথায় ? এই গেইটে কিন্তু চা-কফি ফ্লাস্কসহ ভাড়া পাওয়া যায় । জানা দরকার জায়গাটা কোথায় ?আমি বললাম, জায়গাটি হেমায়েতপুর । আবীর চোখ কপালে তুলে বললো, মানে পাগলা গারদ, মেন্টাল ? সে গেলেই বুঝবেন । আপনি ভাড়া করা ফ্লাস্ক নিয়ে আসেন । আবীর চলে গেলে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম । জলযোগ, রসনা বিলাস, তৃপ্তি, পিঠা-পুলি ঘর, লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্যারাডাইস সুইটস, হোটেল পেশাওয়ার– এসব হলো পাবনা শহরের নাম করা প্রতিষ্ঠান । খানা-পিনার স্হান । মনেমনে একটা ছক এঁকে নিলাম– কোথায় কি কিনবো । শুনেছি সেকালে নেমতন্ন-বাড়িতে ‘কলাপাতায়’ খাওয়া-দাওয়া হতো । এ জিনিস এখনো পাওয়া যায় লক্ষ্মীতে । চালের আটার রুটি– পিঠা-পুলি ঘরে । হাঁসের মাংস ভূণা– রসনা বিলাসে । লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারের রাজভোগ, সন্দেশ আর পেশাওয়ারীর অষ্টভাঁজি সাদা নরম পরেটার কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো । আবীর দুটো ফ্লাস্ক হাতে করে এসে বললো, ব্ল্যাক কফি আর দুধ কফি । আমার কিন্তু দায় শোধ । আমি বললাম, আপনার জন্যে ব্ল্যাক আর আমার জন্যে দুধ কফি, তাইনা ? হ্যাঁ, ব্ল্যাক কফি আপনি পছন্দ করবেন না জানতাম ।ধন্যবাদ– আপনি জানলেন কি ভাবে ? আবীর নাক উঁচু করে হেসে বললো, আপনার মুখ দেখে । একটা কথা — আপানাকে আমি কিন্তু আর আপনি-আপনি বলতে পারবোনা । আপনি ছোট মানুষ । না হেসে আর পারলাম না, মনে মনে বললাম, বড় মানুষ বলে কি ! মাথা নেড়ে বললাম, মনে কষ্ট নিয়ে আপনি বলার দরকার কি, তুমি বলাইতো ভালো । আবীর সুযোগ পেয়ে বললো, আপনাকে  কিন্তু আমায় আপনিই বলতে হবে । আমি বয়সে মুরব্বি, ঠিকক আছে ? ঠিক আছে । আবীর আবার বললো, আরো একটি কথা । নাম না জেনে নাজেহাল হচ্ছি, নাম কি ? আবীরের কথা বলার ধরন স্ট্রেইট । আমার ভাল্লাগলো । সহজ, সরল, সাদামাঠা । এবং কিছুটা সেকেলে । বললাম, আমি সিমি । ওয়াও ! বড়লোকি নাম । মানে ? মানে-টানে কিছু নেই । যে শ্রেণির যে নাম । সিমি হলো আভিজাতিক । আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘হুল ফুটানো’র সুন্দর বাংলা কি ? হুল ফুটানোই তো সুন্দর বাংলা । এরচে’ আর সুন্দর বাংলা হয়না । হুল ফুটানোর দরকার পড়লো কেন ? আপনি সুন্দর বাংলা জানেন– আভিজাতিক, তাই ।আবীর অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো । রাস্তার মানুষগুলো সচকিত হয়ে আমাদের দিকে তাকালো । একটু নজর কাড়া হয়ে গেলাম কিনা– সন্দেহ হলো আমার।ত্যক্ত হয়ে বললাম, এভাবে হাসবেন না তো, আসেন, রাস্তার মধ্যে হা হা করতে হবেনা । বলে ফুটপাথ ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম আমি । আবীর অটো ধরলো । আমরা উঠে বসলাম । অটো-ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করলো না আমরা কোথায় যাবো । ভাবখানা এমন যে, ‘ইডা আবার কওয়া লাগে নাকি ?’ ঝড়ের গতি অটোর । আবীর আদর করে বললো, ভাই, আস্তে যা– যোস দেখাচ্ছিস ক্যান্ ? আমি আবীরকে বললাম, আপনি নাটক করতেন নাকি ?আবীর ভ্রু নাচিয়ে বললো, করতাম মানে ? এখনো করি । আমি এখনো পাবনা থিয়েটার-‘৭৭এর সদস্য । অভিনয়, মারামারি সবই করি । এ নরুণ দেখছি সব কাজেই লাগে ! তো ? এই যে তোমার সাথে দেখা হয়ে বললাম একটা আনন্দ-সংবাদ আছে– তোমাকে কফি খাওয়াতে চাইলাম, সে তো ওই মারামারির ঘটনা নিয়েই রচনা ! আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, থাক । শুনতে চাইনা । আবীর জেঁকে বসলো, য়ুঁ হুঁ, শুনতেই হবে । তুমি শুনতে চেয়েছ– এখন না করলে চলবেনা । আমি আর কথা বললাম না । সাদামাঠা নিরিহ এই ছেলে দেখি মারামারিও করে ! দেখে তো তা মনে হয়না । আজব চিজ । অটো মুজাহিদ ক্লাব পার হয়েছে । আবীরের হাতে ধরা গোল্ডলীফ সিগারেটের প্যাকেট । সে চট করে প্যাকেটটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, প্লিজ, এইটা তোমার সংরক্ষণাগারে রাখো । প্যান্টের পকেটে রাখা যাচ্ছেনা । আমি প্যাকেটটি হাতে নিলাম অবলীলায় । হাতে ধরে রাখলাম । একটা সলজ্জ সংকোচ বোধ মনে জড়ো হলো । একবার চোরা চোখে ওর দিকে তাকালাম । এবং দ্রুত সে চোখ আবার নামিয়েও নিলাম ।  অবশেষে কথা খুঁজে না পেয়ে বললাম, আপনি না বলেছিলেন দৈনিক একটা করে সিগারেট খান । এখন দেখছি প্যাকেট-প্যাকেট । আবীর মুচকি হেসে বললো, এডিকশন জিনিসটা খারাপ । এইটা কখনোই কমেনা, শুধু বাড়ে । তবে আশার কথা এই যে, আমার এত পয়সা নেই ভাই । আমি রেন্ডাম এ ব্রান্ডের সিগারেট খাবো কি ভাবে ? আমি বললাম, নেশার টাকা নাকি ভূতে যোগায় ? তা সত্যি । গুনে দেখো এই প্যাকেটে চারটি সিগারেট আছে । এবং আজই প্রথম একসঙ্গে চারটি সিগারেট কিনলাম । কেন কিনলেন ? আবীর হাসতে হাসতে বললো, কি জানি । আমি না বুঝেই কিনে ফেললাম । আমার মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, যা হবার হয়েছে । এখন থেকে কখনো সীমা লঙ্ঘন করা যাবেনা । আবীর আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবশেষে অমায়িক সৌন্দর্য্যে হেসে ফেললো । আমি লজ্জা পেলাম । আমার মনেহলো কি যেন একটু বেশি বলে ফেলেছি । ঠোঁট কামড়ে ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম । চলমান অটোতে আমি আর কথাই বললাম না। মধ্য শহরে ইন্দারা মোড়ে এসে অটো থামলো । আমরা নেমে এলাম ।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580