নীলরঙ প্রজাপতি
আমজাদ হোসেইন
দুই মাস আবীরের দেখা নেই । খোঁজ-খবর কিচ্ছু নেই । পৃথিবীর সব কিছু ঠিক ছিল ;আমিই কেবল ঠিক ছিলাম না । দীর্ঘ এই সময়ে আমি শুধু হন্যে হয়ে খুঁজেছি আবীরকে ।এই দুই মাস আগের আমি আর আজকের আমি’র মধ্যে এখন বিস্তর ফারাক । দুই মাস আগের একটা ঝড়োদিন আমার দুনিয়াকে টালমাটাল করে দিয়েছিল । সেদিন থেকেই বেহুঁশে ছিলাম । কিভাবে কিভাবে যেন আবার ফিরে এসেছি কেন্দ্রে, আমার আগের দুনিয়ায় । এখন আর কোন সমস্যা নেই । ভালোবাসা একটা নেশা — অবিরাম উন্মাদনা তৈরী করে মনে। ভালোবাসা ছেড়ে আসা খুব কঠিন । ভুলে যাওয়া আরো কঠিন । আমি এখন বুঝতে পারি,শশী কেন নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিল, শ্যামা কেন পাগল হয়ে গিয়েছিল ; কেন তাকে কান্ডজ্ঞানহীন কর্মের পরিনতি ভোগ করতে হয়েছিল । প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে অন্ধ হয়ে যাবার মতোন পরিস্হিতি আমার আব্বু-আম্মুর জীবনে কখনো সৃষ্টি হয়নি ; সারা জীবন তারা বাস করে গেল ইগোয় মোড়া অহং-বোধের সংসারে– যেখানে এক অদৃশ্য ভঙ্গুর সম্পর্ক সবার মাঝে তাপ ছড়িয়েছে সর্বক্ষণ । আমার মনে আছে,এই অবস্হাত্থেকে আমরা তিন বোন সব সময়ই মুক্তি চাইতাম । পালাতে চাইতাম । আমি তখনো স্কুল পেরুইনি ; কিন্তু ওরা দু’জন স্বাধীনভাবে বিচরণের অবাধ সুযোগ পেয়ে গেল– ভার্সিটীতে ভর্তি হবার সুবাদে । খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে পেরে ওরা প্রথমেই প্রেমে পড়ে গেল এবং বলা বাহুল্য দ্রুত তলিয়ে গেল অতলান্তে । ইন্টার বয়সে শরীরীয়-সম্মোহন থেকে আর উঠে আসতে পারলো না ওরা । এই ভূলের প্রতিশোধ নিয়ে নিল সময় । ভালোভাবেই নিল । আমার ভাগ্য সেদিক থেকে বলতে হবে ভালো । আমার ভূল ছিল অবশ্যই কিন্তু অনেক ভাগ্যে আবীরের মতো একটি হৃদয় পেয়েছিলাম আমি। কোন এক সুখ-সময়ে আমার দাঁহাবাজ আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরে আমি কৌতূক করে বলেছিলাম, ‘জীবনে কখনো কোন ছেলের সাথে আমি প্রেম করবো না । তিন সত্যি করলাম । তবে আমাকে লাইফ-পার্টনার খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে ।’ কাব্যি করে আরো বলেছিলাম, ‘যে ছেলের মধ্যে পাখি বাস করে– পাখির মতো যে খাবার যোগার করে খায়, যে ছেলের মধ্যে পিঁপড়ের স্বভাব– ভবিষ্যৎটা যে মজুদ করে রাখতে জানে, যে ছেলে উঁই পোকার বাসা বানাতে পারে– আমি সেই ছেলেকে লাইফ
পার্টনার বানাবো । নাহলে ওসব পার্টনার-ফার্টনার বাদ । আমার দরকার নেই ।’ যেদিন আমরা ঠাকুর-আশ্রমে বেড়াতে গিয়েছিলাম– সেইদিন, আমি প্রতি মুহূর্তে আবীরের মধ্যে আমার সেই পাখি দেখেছিলাম, ওর দু’চোখে পিঁপড়ের ভবিষ্যৎ
দেখেছিলাম, আর দেখেছিলাম, শ্রমের ঘামে ওর নিজ হাতে গড়া উঁই পোকার বাসা । আবীরের আচরণে গলেপড়া প্রেমের গুরুত্ব একেবারেই নেই– সারাদিন ধরে সেদিন ওর এই দর্শনে আমি মুগ্ধ হয়ে ছিলাম এবং ভিতরে ভিতরে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম । বিষয়টি বুঝতে পেরেও আবীর আমাকে বুঝতে দেয়নি । আবীরের রাজনীতি ছেড়ে আসার গল্প আমাকে অবিভূত করে দিচ্ছিল– আমি মাথা নত করে ওর সামনে ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ছিলাম । কোনও যুক্তি ছিলনা ; বেলা শেষে একসময় নির্জন ফসলী মাঠের মাঝখানে বাবলা গাছের নিচে গাঢ় সবুজ ঘাসের বিছানায় আবীরকে আমার সবকিছু বিসর্জন দিতে আমি প্রস্তুত হয়ে গেছিলাম । মনে হচ্ছিলো ওর মাঝে আমার অস্তিত্ব বিলীন হওয়াতেই আমার সব আনন্দ ।
ওর হাতের স্পর্সে মুহূর্মুহু বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছিল আমার ভিতরে । আমি উন্মূখ হয়ে চোখ বুঁজে ছিলাম । আশ্চর্য্য আবীরের ধৈর্য্য-ক্ষমতা ! ইষৎ কম্পমান ওষ্ঠ, মুদিত চোখ আর আবেগে ভেজা আমার শরীরের অসহনীয় আমন্ত্রণ কেমন করে যেন হজম করে নিল ও । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার হাত ধরে মৃদু চাপ দিয়ে সে কেবল বললো, চলো । রাত নেমে আসছে। আজ সকালে দু’টো ক্লাস ছিল– সারাদিন আর কোন রুটিন নেই । এখন দুপুর । সময়টা বেশ অলস ।শাওয়ার নিয়ে চিরুনী হাতে জনালায় দাঁড়িয়ে আজ আমি সেদিনের সেসব কথাই ভাবছিলাম আর বারবার শিউরে উঠছিলাম ।
মনে মনে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম আবীরকে । মহানুভব আর বিবেকবান মানুষটি সেদিন অপরিণামদর্শি পরিণতির হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিল । সেদিন সে’ও যদি আগুন নিয়ে আমার মতো খেলতে চাইতো তাহলে এখন কী দশাটা হতো আমার ? নি:সন্দেহে শশী-শ্যামার চাইতেও খারাপ অবস্হা হতো ! আমার ঠাঁই হতোনা কোথাও । মান বাঁচাতে শেষপর্যন্ত কি ওর কাছে আবার করুনা ভিক্ষা করতে আমায় ফিরে যেতে হতো ?এমনটি কখনোই সম্ভব হতোনা আমার পক্ষে ।
নিরুপায় আমাকে আত্নহনণের পথ বেছে নিতে হতো । অনেকের কাছেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক– রিলেশনশিপ তো সুখ উপভোগের জন্যেই– এই সময়ের আনন্দই আলাদা । এইটা তো জীবনেরই অংশ, যৌবনের অধিকার । প্রেমের সুখ যদি
উপভোগই করা না গেল তাহলে আর প্রেম কিসের ? জীবন যেভাবে যখন যেমন, প্রেম সেভাবে সেখানে তেমন– নিত্য আনন্দের উপকরণ । তাই কি ? ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল আমার– সে রকম কিছু কখনোই মনে হয়নি আমার । আমার ধারণা, সুখ সম্ভোগে মানব জীবন চতুষ্পদ প্রাণির মতো নয় । মানুষকে পরষ্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে দীর্ঘস্হায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভোগের বিষয়টিও বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করতে হয় । তাকে ইতর প্রাণির মতো শুধু প্রাকৃতিক হলে চলেনা । স্বতস্ফুর্ত আনন্দের মধ্যে সেদিন সারাদিন একসঙ্গে কাটালাম অথচ আবীরের ফোন নাম্বারটা নিতে ভুলে গেলাম কেন — মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা নিজেকে করি । ক’দিন খুব মনোস্তাপে ভুগিয়েছে বিষয়টা । আবীরকে তখন কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা । পুকুর পাড়ে দৈনিক দুইবার করে যাই । ক্যাম্পাসে খুঁজি । সম্ভাব্য পরিচিত জনকে জিজ্ঞাসা করি– কোথাও, কোনও মাধ্যমেই আবীরের হদীস পাচ্ছিলাম না । কেউ কেউ বললো, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, ওর একটা চাকরি দরকার, ঢাকায় যেতে পারে হয়ত । সে দিনগুলোতে একটা বিরহ বেদনায় মনটা ভরে থাকতো সব সময় । এখন টের পাই, সম্পর্কটি একদিনের হলেও অন্তর জুড়ে এক রকমের একাকীত্ব তৈরী হয়েছিল আমার মনে । আশপাশের বাস্তব সব ভুল হয়ে যাচ্ছিল আমার । আত্ননিমগ্নতায় ফোন নম্বরটিও তাই নিতে ভুল হয়েছিল সেদিন । মূলত সব কিছু ছাপিয়ে আমার ভালোবাসাটিই আমাকে ভোগাচ্ছিলো । গেল কয়েকটা দিন সন্ধ্যায় এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসে যখনই জানালার সামনে
দাঁড়িয়ে আবছায়া গাছগুলোর দিকে চেয়েছি– তখনই একটা ভারী মিষ্ট কন্ঠের ডাক যেন কানে বেজে উঠেছে, সীমু …
একটা বিভ্রম । বিভ্রমটি ভালো লাগতো আমার । এখন আর শুনতে পাইনা সেটি । আমার নাম নিয়েও আবীর নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিল । তার ধারণা, সিমি হলো গিয়ে আভিজাতিক একটা ধনাঢ্য নাম আর সীমু হলো আটপৌরে, আন্তরিক। সীমু নামের আন্তরিক-মাহাত্ন্য বুঝেছি আমি নীতু-মিতুদের বাড়ি গিয়ে । মেয়েদেরকে আদুরে নাম ধরে এভাবে প্রান ভরে ডাকা যায়, ওদেরকে না দেখলে সে কথা আমি বুঝতেই পারতাম না । বোধহয় নামের অন্ত:মিলের কারণে আবীরের মুখে তাই ‘সীমু’ ডাকটি আমার এত ভাল লেগেছিল । চিরুনী হাতে জানালায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ এসব কথাই ভাবছিলাম । মন খারাপ হচ্ছিলো । হঠাৎ মনেহলো, শুধু শুধু এসব ভেবে আর কি হবে ! দরকার কি । জীবন সম্পর্কে আমার নিজের কনসেপসনে স্হির থাকাই ভাল । প্রেম এবং পছন্দকে আলাদা করে রাখাই উত্তম । এতেকরে অন্তত এইটা মনেকরে সান্ত্বনা পাওয়া যাবে যে, মনপুরা থেকে তো রেহাই পেলাম ! চুল আঁচড়ে রেডি হলাম– প্রশাসনিক ভবনে যেতে হবে । ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে; হাত একেবারে শুন্য । ক’দিন ধরে নীতু-মিতুদের ওখানে যাওয়া হয়না । ওদের জন্যে আজ মুখরোচক কিছু নিয়ে যেতে হবে । ওরা খুশি হবে । ওরা খুশি হলে পাখির মতো কলধ্বনি করে । মন ভরে যায় । ভরদুপুরে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং’এর সামনে ভিঁড়– ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে-সেখানে জটলা করে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, খোসগল্পে মেতে আছে । ব্যাপার কি ; দেখার জন্যে উৎসুক হয়ে এগিয়ে গেলাম । মনেহলো সবাই সিনিয়র । ফার্মেসী ফাইনালের রেজাল্ট হয়েছে । কিন্তু নোটিস বোর্ড প্রায় ফাঁকা । দু’একজন আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার মতন নোটিস বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে । তাদের আর দেখার কিছু নেই । তাছাড়া হয়তো রেজাল্ট নিয়ে কৌতূহল ইতোমধ্যে মিটে গেছে সবার । ভাগ্য যাদের সুপ্রসন্ন হয়েছে তারা এখন জটলা করে প্রেম, পরিণয়, পরিণতি, অথবা পরবর্তি উচ্চাভিলাষ নিয়ে গসিপে হারিয়ে গেছে । আমার চোখ সর্বত্র বনবন করে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে– কোথাও আবীর নেই । ওর রেজাল্ট কি হলো সেটা নয় ; রেজাল্ট একটা কিছু হবে । কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার এটাই যে শেষ সুযোগ । এরপর নিখোঁজ মানুষ হয়ে যাবে আবীর । আজ দেখা হলে ভাল হতো — অন্তত এই সোর্সে একটা শুভেচ্ছা-অভিনন্দন জানানোর সুযোগ তো হতো । এবং সে ভাল আছে, না মন্দ আছে মুখোমুখি তা নিশ্চিত হওয়া যেত । আমার সব সময় মনে হয় কোথায়ও যেন একটা দায় আছে আমার । সেটা পরিশোধ করা দরকার । এখন না হলে সেইটা আর কোনদিন শোধ হবেনা । অসম্পূর্ণর অস্বস্তি একটা যন্ত্রণাদায়ক ব্যপার । শেষমেষ অযথাই নোটিস বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম । তালিকা খুব দীর্ঘ নয় । সাইত্রিশ জনের সিরিয়াল । তের নম্বরেই পেয়ে গেলাম আবীর আব্দুল্লাহ মীর । আশ্চর্য্য, ওর মতো কেয়ারলেস ছাত্রের রেজাল্ট এ রকমটি হবে কখনো ভাবতেই পারিনি ! প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল । শরৎ কালের কড়া রোদ্দুপুরের আকাশটা কেমন গভীর নীল– নি:সীম নিরিবিলিতে খেই হারা ।কাছেই– কৃষ্ণচূড়ার ডালে দুটো শালিক বসা ছিল, খেয়াল করিনি– হঠাৎ
পাখায় শব্দ তুলে উড়ে গেল । বহুদূর–দৃষ্টিসীমার বাইরে । সে দিকে তাকিয়ে যেন একটু মন খারাপ হলো আমার । দাঁড়িয়ে ছিলাম । হঠাৎ ইন্দ্রিয় সজাগ হলো, আমার নাম ধরে কে ডাকছে । পিছন ফিরে দেখি, শিরিষ গাছের নিচে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাতোয়ারা এলিজা হেসে কুটিপাটি হচ্ছে — হাত ইশারায় আমাকে কাছে ডাকছে । প্রচন্ড ধনাঢ্য পিতার একমাত্র কন্যা । সাদাসিধে, নিরঅহংকার মিশুক মেয়েটি ক্যাম্পাসে ‘ইজা’পা নামে খ্যাত । হৈহুল্লোর-আনন্দ-অনুষ্ঠানগুলো ইজা’পার
স্পন্সরড-পার্টিসিপেশন ছাড়া জমেনা । চলতে ফিরতে ওর সঙ্গে দেখা হলে স্যারেরা পর্যন্ত বলে, কি লিজা, কেমন আছো ?
বেপরোয়া গোছের এলিজা’পাকে আমি এ ভাবেই জানতাম । আমার সঙ্গে তার কখনো কথা হয়নি । কিন্তু যেদিন, যখন আবীরের মুখে শুনলাম মেয়েটা তার সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আবীরকে পেতে চায়, প্রয়োজনে কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিতে চায়– সেদিন থেকে এলিজার প্রতি আমার বিদ্বেষ । ঘৃনার জন্ম হয় । আবীর বলেছিল, এলিজা তার চব্বিশ ঘন্টার খবর রাখে । প্রয়োজনে তার খোঁজ এলিজার কাছেই পাওয়া যাবে । আমি সে পথ মাড়াইনি । এক সময় হন্যে হয়ে খুঁজেছি আবীরকে । এর-ওর কাছে জিজ্ঞেসা করেছি, ফোন নম্বর তালাশ করেছি — চব্বিশ ঘন্টা মনোবেদনা ও ইর্ষা কাতরতায় ভুগেছি তবুও এলিজার কাছে যাইনি । এখন মনেহলে হাসি পায়, লজ্জাও লাগে– ওই সময় বরং সর্বক্ষণ মনে মনে এলিজার
মৃত্যু কামনা করেছি, ডাইনীটা মরেনা কেন– মরলেইতো পথের কাঁটা দূর হয় ! হাসিতে উচ্ছল ইজা’পাকে দেখে আজ সেরকম কিছু মনে হলোনা আমার । তবে অতটা আগ্রহও দেখানোটা উচিৎ হবেনা ভেবে নরমালি আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে । কাছাকাছি পৌঁছুলে তিনি হাসি মুখে বললেন, কেমন আছো সীমু ? থমকে গেলাম । এ নাম তো তার জানবার কথা নয় ? ফলে ‘ভাল আছি’ এই সহজ কথাটি সহসা মুখে এলোনা আমার । এরই মধ্যে আবার প্রশ্ন, রেজাল্ট কেমন হলো — খুশি হয়েছ তুমি ? আশ্চর্য্য তো ! এসব কেমন কথা — অপমান-টপমান করতে চাইছে নাকি ? এলিজা’পার অভিন্ধিটা কি, বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি ।অভিসন্ধি-টন্ধি যা-ই হোক, আমার ভাল লাগছিল না । আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম । সটকে পড়তে চাইলাম, বললাম, আপা, আমি পাঁচ মিনিট পরে আসছি । লাঞ্চ ব্রেকের আগে ব্যাংকের কাজটা সেরে আসি । মুহূর্ত কয়েক চুপ করে থেকে আপা গম্ভীর কন্ঠে বললেন, যাও । আমি অপেক্ষা করবো । আমি চলে এলাম । কিন্তু মনে শঙ্কা জেগে থাকলো । কাজ সেরে বোধহয় ফিরতই হবে আবার ।অন্যথা করা যাবেনা । ব্যাংক মানে এটিএম বুথে যাবো । এ মাসের খরচের টাকা তুলতে হবে । ফিরে আসবার সময় ব্যালান্স-বাটনে চাপ দিতেই হতবাক হয়ে গেলাম । এত টাকা এলো কোত্থেকে ? সাকুল্যে তিনহাজার টাকার বেশি থাকার কথা নয় ; অথচ ডিসপ্লে শো করছে একচল্লিশ হাজার টাকার বেশি । মাথার মধ্যে বিস্ময় দাঁড়িয়ে গেল । এডমিন বিল্ডিং’এর প্রশস্ত বারান্দার এক সিড়ি ভেঙে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম । কিছুক্ষণ ভীমরি খেয়ে আঁতি-পাঁতি করে স্মরণ করবার চেষ্টা করলাম ঘটনাটি ঘটলো কি ভাবে । আব্বু আমার একাউন্ট নম্বর জানেনা । আর কোনও রকম ভাবে তিনি যদি তা জেনেও থাকেন — তবে আমি সিওর, এ ব্যাপারে তিনি এত অল্পে তুষ্ট হতেন না । একাউন্টে এক কাঁড়ি টাকা জমা করে দিতেন । তাহলে ? মনে পড়লো, নীতু-মিতুকে পড়ানোর প্রথম মাস — তখন প্রায় শেষ শেষ । প্রথম মাসের বেতন গৃহকর্ত্রী ‘আপা’ আমাকে হাতে দিলেন না । হেসে বললেন, সামান্য ক’টি টাকা খামে ভরে তোমার হাতে ধরিয়ে দিতে আমার ভাল্লাগছে না । ছোটলোকি মনেহচ্ছে । তাছাড়া কর্তা বললেন, মেয়েটির একাউন্ট নম্বর চেয়ে নিও, যা দেবার সেখানেই দিও । এতে অসন্মান হবেনা ওর । আমি আপত্তি করলাম না । বরং খুশিই হলাম — একটা এলিট পরিবারের সামান্য একজন গৃহ শিক্ষিক আমি । আমার সম্পর্কে এ রকম ভাবনা আশাতীত বৈকি ! আমার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিনা । দেখতে পেলে বোধহয় দেখতাম সেখানে ঠোঁটের কোণে একটু মিষ্টি হাসি লেগে আছে । ভালোবাসার হাসি । আমার সব বিস্ময়বোধ তিরোহিত হলো । আমি নিশ্চিত হলাম, মানুষের জীবনে ভালোবাসাই সব । ভালোবাসা পেলে বেঁচে থাকার জন্যে তার আর কোন উপকরণের দরকার হয়না । উপকরণ তো ভালোবাসারই অনুসঙ্গ ! কালো ক্যাম্বিসের পার্সব্যাগে অনেক্ষণ ধরে রিংটোন বেজে যাচ্ছে । তাড়াহুড়া করে ধরতে গেলাম । মিসকল হয়ে গেল । আব্বু ফোন করেছে । কল ব্যাক করলাম না আমি । হেসে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম — এখনই আবার বেজে উঠবে সেটি । বলতে না বলতেই খোলা জায়গায় শুরু হয়ে গেল সেতারের টুংটাং ডিংডং … হ্যালো, আব্বু ।
হ্যাঁ,কেমন আছিস মা ? অনেক আনন্দে আছি আব্বু — দিনগুলি মোর সোনার হরিণ …ব্যাস ব্যাস, বুঝতে পেরেছি । কোন অকাম-টকাম করে বসে আছিস না তো ? মোটেই নয় । আম্মুর কাছে তিন সত্যি করে এসেছি, শুনে দেখো আম্মুর কাছে ।
আব্বু তারপরও অবিশ্বাস নিয়ে বললো, বোঝা দায় । সে জন্যেই তো সবাই তোরা আমাদেরকে পর করে দিয়েছিস । খবর নিসনা । খেয়াল করে দেখলাম, আব্বু এখন ‘আমি’ থেকে বের হয়ে ‘আমাদের’ বলা শিখেছে । আনন্দ হলো আমার । বললাম, মেয়ে কখনো পর হয় আব্বু ? হয় হয় । ওরা দুইজ্ন তো হয়েছে । তুইও হয়েছিস । জোর করে দোষ চাপাচ্ছো কেন ? আব্বু এবার জোর দিয়ে বললেন, এটা জোরের কথা নয় মা । যুক্তির কথা । মেয়েরা বিয়ে হয়ে গেলেই যে পর হয়ে যায়, তা হয়না । দিনে দিনে তারা ঘরণী হয়ে উঠলে একদিন পর হয়ে যায় । শশী-শ্যামার বিয়ে হয়েছে বটে কিন্তু এখনো ওরা ঘরণী হয়ে ওঠেনি । অথচ আমরা ওদের কাছে পর হয়ে গেছি । বিষয়টা নট ন্যাচারাল — বুঝে আসেনা । আব্বু মন খারাপ করে থামলেন । কিন্তু থেমে গেলেন না । তিনি এবার আমাকে আক্রমণ করে বসলেন, কিন্তু তোর ব্যাপারটি খুবই রহস্যজনক । তুই কেন বাপ-মা’কে পর করে দিলি বল্ তো ? আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম । এত জোরে হেসে উঠলাম যে, পরক্ষণেই বোকা বনে গেলাম । আবার বোকার মতোই আসপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম — এই অতিপ্রাকৃত হাসি কেউ দেখে ফেললো কিনা । আব্বু ধমকে উঠলেন, আ্যই — এ রকম হাসছিস ক্যান্, হাসির কি হলো ? হাসির কথা হলে হাসবো না ? বলে আবার খানিকটা হাসলাম । আব্বু চুপ করে আছেন । কিছু বলছেন না । রাগ হয়েছে । আমি তাঁকে খুশি করতে বললাম, আব্বু, আমার তো বিয়েই হয়নি, আমি ঘরণীও হইনি, তাহলে আমি কেন পর হবো ? আমি পর হবোনা । আলামত তো তা বলেনা । তুই আমাদের টাকা নিসনা, ফোন করিস না, ভুলেও বাসায় যাওয়ার নাম মুখে আনিসনা — এইসব কি — এগুলা কি আলামত নয় ? আমি জুলুবুলু হয়ে বললাম, এ সব ঠিক নয় ; এ সব মিথ্যে — আমি পর হয়ে যাইনি আব্বু, কক্ষনো আমি পর হবো না — তুমি বিশ্বাস করতে পারো, তোমার নাতি-পুতি জন্মদিয়ে আমি বুড়ি হয়ে গেলেও পর হবো না । সেদিন দেখো সব আলামত তোমার ভুল প্রমানিত হবে আব্বু । একদম সত্যি কথা । আমার কথা শুনে ফোন কানে ধরে আব্বু মিটি মিটি হাসছেন, বোঝা যাচ্ছে । মৃদুস্বরে বললেন, তাই ? অবশ্যই তাই । আব্বু আরো খুশি হয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মাই বেবী ! শোন্ মা, একটা গুড নিউজ আছে। আব্বুর গুড নিউজ, ব্যাড নিউজ তৈরী হয় আম্মুর নন-কোঅপারেশন মুভমেন্টের উপর । যদি মুভমেন্টের ফল হয় আম্মুর জন্যে যথেষ্ট যন্ত্রণার তবে সেইটা হলো গুড নিউজ আর আম্মুর জন্যে খুশি হওয়ার ব্যাপার ঘটলে সেইটা হয় ব্যাড নিউজ । তখন সেই নিউজের গল্প শোনাবার জন্যে একনিষ্ঠ শ্রোতা হিসেবে আব্বু বেছে নেন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যাকেই । বুদ্ধির পর থেকে এ রকমটাই দেখে আসছি । মনে হচ্ছে, এই রকম একটা গুড নিউজ আব্বুর মনে তৈরী হয়েছে আবার — যা আমাকে শোনানো জরুরী । আসলে ওই সব আপন-পর, আলামত-টালামত কিছু নয় । এ হলো মেলা কথা বলার একটা প্লট মাত্র । অসহ্য হলেও সময় নিয়ে আমাকে শুনতেই হবে এখন । আমি সিড়ির রাস্তা ছেড়ে বিল্ডিং’এর পেছন-কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম । দূর থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলাম লীজা’পাকে । সে মৌজে আছে । আরো সহচরী জুটেছে । টিস্যু দিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরে সবাই তারা এখন শর্মা খাচ্ছে । হাত নেড়ে নেড়ে গল্পের তুফান তুলেছে লীজা’পা । এই আড্ডা ছেড়ে সহসা চলে যাওয়া তার জন্যে সহজ হবেনা । আমার মনটা আরো ক্ষানিকটা খারাপ হয়ে গেল । হ্যালো সিমি, মা — শুনতে পাচ্ছিস ? হ্যাঁ, আব্বু বলো, তোমার গুড নিউজ বলো । কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আব্বু হুট করে বলে ফেললেন, আমি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছি । সে কি ! কেন আব্বু ? আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, এবার আসল জীবনে ফিরতে চাই ।আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না । বললাম, আম্মুর সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে তোমার ? আরে না না । তোর আম্মুই তো আমাকে বললো, চাকরি ছেড়ে দাও ।
কেন ? আব্বু বললেন, বেশ কিছুদিন আগে একবার তোর মা’কে বলেছিলাম, চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি মনোহরদিপুর চলে যাবো । সেদিনের কথাটা তোর আম্মুকে ভিতরে ভিতরে ভাবিয়েছে অনেক । শেষ অব্দি তার সিদ্ধান্ত এলো গত সপ্তাহে । ব্যস, আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম । মা, তুই নিশ্চিত থাক, সামনের রোববারে আমরা এতক্ষণে থাকবো মনোহরদিপুর । তার আগে একটা বড় কাজ করতে হবে আমাদেরকে । নরিন্দা কারিকর পাড়ায় শ্যামার শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে । এটি একটি ভালো কাজ হবে, তাইনা মা ? এ বড় বিস্ময় । বিষয়টি আমাকে শুধু হতবাকই করলো না, আকাশ থেকে ফেলে দিল । কিছুতেই মেলাতে পারছিনা ঘটনা — আকাশ কুসুম কি বাস্তব হয় ? বললাম, তোমরা দু’জনেই ভাল মানুষ, হঠাৎ পাগল হলে কি করে ? তোমাদের এত অর্থ-সম্পদ, ইজ্জত-সন্মান সে সবের কি হবে এখন ? আব্বু তড়িৎ জবাব দিলেন, ওসবের এক পয়সা দাম নেই রে মা । সব অনর্থ । আব্বুর কথা শুনে আমি হাসলাম । ফোড়ন কাটতে ইচ্ছে হলো খুব । বললাম, তাহলে কি আব্বু সবই লস প্রোজেক্ট ? শশীর শ্বশুরকে ইঙ্গিত করে আমার কথাটি বলা । কিন্তু আব্বু বুঝলেন না । হাসলেন। বললেন, সব কি আর লস হতে দেব মা । যতটুকুন পারি সদ্ব্যাবহার করে তবে বিদেয় হবো । সে জন্যেই তো তোর মা’কে নিয়ে আবার আমার গাঁয়ে যাওয়া । চেষ্টা করে দেখি, সবার সঙ্গে সেখানকার কাদামাটি চটকে আবার আদি মানুষ হওয়া যায় কিনা ! আমি থোম ধরে চুপ করে রইলাম । কি বলবো । আমার কী’ইবা বলার আছে । প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা একটি জগৎ আছে । সেখানে সে একা এবং লুকিয়ে লুকিয়ে গোপনে তার একলা বেঁচে থাকা । একা পথ চলা । অনিশ্চিত সেই দীর্ঘ যাত্রা পথে সহযাত্রী পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার । সবার ভাগ্যে জোটেনা । আবাল্য একা আমার বাবাকে অভিনন্দন । তাঁর ভাগ্য খুবই ভালো । অবশেষে দুর্গম যাত্রাপথে শেষবেলা হলেও তিনি তাঁর জীবন সঙ্গীকে সহযাত্রী রূপে পেয়ে গেছেন । অভাবনীয় এই প্রাপ্তিতে আব্বুর মুখখানা এখন কেমন আলোকোজ্জল হয়ে উঠেছে — আমার
খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে । ভীষণ ভাল লাগছে আমার । হ্যালো, সিমি মা, শুনতে পাচ্ছিস ? হ্যাঁ আব্বু, তোমার গুড নিউজ শুনলাম– অনেক গুড । অনেক , অনেক, অনেক গুড । আব্বু হাসলেন একটু । কিছু বললেন না । আমি বললাম, আচ্ছা আব্বু, তোমরা সত্যিই কি কারিকর পাড়া যাবে আর রোববারে মনোহরদীপুর যাবে ? হ্যাঁ মা, কেন বলতো ? আমিও যাবো । শুক্কুরবার সকাল বেলা ঈশ্বরদী থেকে খুলনা মেইলে ধরবো আমি । ওয়েলকাম মা। আয় আয় । আয় মা । আমি হাসি দিয়ে বললাম, তাহলে আজ রাখি আব্বু ? এপাশ থেকে আমি আর আব্বুর মোলায়েম হাসির শব্দটুকু শুনতে পেলাম না ।
মনেহলো আব্বুর খুশি হওয়া হাসিটি আমি চোখে দেখলাম । একটি সুখের সংসার দেখতে কেমন হয় আমি জানিনা । অচিরেই আমি তা দেখতে পাবো ভেবে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো আমার । দুপুরের খাবার আজ আর ডাইনীং’এ পাওয়া যাবেনা । বেলা গড়িয়ে গেছে । বাইরে খাবো । দামী খাবার । অবশেষে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম লীজাপা’র দিকে । যেতেই হলো । লীজা’পা আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে ।