আশীষ কুমার দে: নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অঙ্গ সংস্থা নৌ বাণিজ্য দপ্তরের সাবেক ও বর্তমান দুই মূখ্য কর্মকর্তার (পিও) মধ্যে ওভারটাইম (ওটি) এবং নতুন জাহাজ রেজিস্ট্রেশনের ডকিং সুপারভিশন ফি’র ১৮ লাখ টাকা নিয়ে চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছে। সাবেক মূখ্য কর্মকর্তা (পিও) প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম তাঁর বকেয়া পাওনা দাবি করে গত বছরের ৫ জুলাই বর্তমান পিও’র কাছে আবেদন করেছেন; যার অনুলিপি নৌসচিব ও নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও দেয়া হয়েছে। এর জবাবে বর্তমান পিও গিয়াসউদ্দিন আহমেদ আলাদা দুটি চিঠিতে সাবেক ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন না করে অবৈধভাবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ তুলে অবিলম্বে তা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলেছেন। ঘটনাটি জানাজানির পর নৌ সেক্টরে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। শফিকুল ইসলামের আবেদনের পর বিষয়টি তদন্তের জন্য নৌ পরিবহন অধিদপ্তর গত বছরের জুলাইয়ে একটি কমিটি গঠন করে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) জসিমউদ্দীন সরকারকে। সূত্র মতে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা গত ১৯ ও ২০ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট দপ্তর পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও এখনও প্রতিবেদন জমা দেননি তাঁরা। তবে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শফিকুল ইসলাম তাঁর আবেদনে উল্লেখ করেন, তিনি ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ছয়টি নতুন জাহাজ ও উপকূলীয় বিভিন্ন জাহাজসহ সিটি গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপের আরো কয়েকটি জাহাজের প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন সনদ জারি করেন। এসব জাহাজের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তাঁর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়ায় যাবতীয় সুপারভিশন ফি তিনি পাবেন। ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে (?) তাঁকে ওই কাজ করতে হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কীভাবে বাংলাদেশে ডকইয়ার্ড পরিদর্শন ও জাহাজের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সুপারভিশন করা সম্ভব, তা উল্লেখ করা হয়নি আবেদনে। এদিকে শফিকুল ইসলাম পাওনা টাকা দাবি করে গত বছরের ৫ জুলাই নৌ বাণিজ্য দপ্তরের পিও’র কাছে আবেদন করলেও তিনি (পিও) এ বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলেন। আবেদনপ্রাপ্তির তিন মাস সাতদিন এবং নৌ অধিদপ্তর কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠনের প্রায় আড়াই মাস পর ১২ অক্টোবর শফিকুল ইসলাম বরাবর আলাদা দুটি চিঠি ইস্যু করেন পিও গিয়াসউদ্দিন। একটি চিঠিতে বলা হয়, তিনি (শফিকুল) সরজমিন পরিদর্শন না করে সিটি গ্রুপের ১০টি জাহাজের বিপরীতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে সুপারিভিশন বাবদ প্রতি জাহাজ থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার করে মোট ১৭ লাখ ৫০ টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন। এছাড়া বিএসসির ছয়টি নতুন জাহাজের বিপরীতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন সনদ জারি করেছেন। তবে সেসব জাহাজ তিনি সরজমিন পরিদর্শন করেননি। গিয়াসউদ্দিনের অপর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম জাপান থেকে আমদানি করা ‘এমটি কুরেনাই মারু (সি-২০৩০)’ জাহাজের বিপরীতে সুপারভিশন ফি বাবদ ৪৩ হাজার ৯৯০ টাকা হস্তগত করেছেন। অথচ তিনি কখনও সরজমিনে জাহাজটি পরিদর্শন করেননি। এভাবে তিনি মোট প্রায় ১৮ লাখ (১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯০) টাকা উত্তোলন করেছেন; যা বেআইনি। সব টাকা অবিলম্বে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য শফিকুল ইসলামকে অনুরোধ করেন গিয়াসউদ্দিন। এছাড়া এই ১৮ লাখসহ উল্লেখিত জাহাজগুলোর সুপারভিশন ফির যাবতীয় টাকা তিনি নিজেই (বর্তমান পিও) পাবেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। বিদেশে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে ডকিং সুপারভিশন ফি ও রেজিস্ট্রেশন ফি দাবি করায় সাবেক পিও শফিকুল ইসলামের ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি নৌ অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠনের দুই মাস পর শফিকুল ইসলামের কাছে টাকা ফেরত চেয়ে একই তারিখে আলাদা দুটি চিঠি দেয়ায় এবং ওই টাকা নিজে পাবেন বলে উল্লেখ করায় বর্তমান পিও গিয়াসউদ্দিনের ভূমিকাও রহস্যের সৃষ্টি করেছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের পর সেই কমিটিকে পাস কাটিয়ে অধস্তন কোনো কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এমন চিঠি দিতে পারেন কি-না, তা নিয়েও জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে অনুসন্ধানে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের অভ্যন্তরে আরো বেশকিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার তথ্য পাওয়া গেছে। শফিকুল ইসলাম ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে বেতনের বাইরে ওভারটাইম ও সুপারভিশন ফি বাবদ দুই কোটি ১০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করেছেন; যা রীতিমতো বিস্ময়কর। এছাড়া তিনি ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার পর ওই বছরের ১ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত পিও’র অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট প্রকৌশলী সাজিদ হোসেন। সে সময় তিনিও বিভিন্ন জাহাজ সার্ভে দেখিয়ে ওভারটাইম ও সুপারভিশন ফি নিয়েছেন। অথচ তিনি পেশাদার সার্ভেয়ার নন। বিধি অনুযায়ী, অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি শুধুমাত্র ‘দায়িত্বভাতা’ পাবেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী অপেশাদার কোনো সার্ভেয়ার জাহাজ সার্ভে করতে পারেন না। বকেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই আমি প্রাপ্য সুপারভিশন ফি চেয়ে আবেদন করেছি। এরপর নৌ পরিবহন অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি করেছে। এছাড়া নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা আমাকে দুটি চিঠি দিয়েছেন। আমি সে চিঠির জবাবও দিয়েছি। পিও গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম বকেয়া টাকা চেয়ে যে আবেদন করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তিনি বিধি লঙ্ঘন করে কয়েকটি জাহাজের বিপরীতে সুপারভিশন ফি বাবদ বেশকিছু টাকা নিয়েছেন। তাঁকে চিঠি দিয়ে ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি আজও তা দেননি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমার পর বিষয়টি নিস্পত্তি হবে বলে মন্তব্য করেন গিয়াসউদ্দিন। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জসিমউদ্দীন সরকার বলেন, নানা ব্যস্ততার কারণে তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা দেয়া হয়নি। প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে এবং খুব শিগগির মহাপরিচালকের কাছে জমা দেয়া হবে বলে তিনি জানান।