বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ১৯৭৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিল লালঝান্ডাবাহী বামফ্রন্ট। ফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিআই (এম) নেতা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল সরকার। এরপর দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর একটানা রাজ্য শাসন করেছে বামফ্রন্ট; যার মধ্যে জ্যোতি বসু একাই ২২ বছর মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এরপর প্রায় ১২ বছর মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু গত এক দশক ক্ষমতার বাইরে থেকে সেই বামফ্রন্ট এখন অস্তিত্ব সংকটে। সদ্যসমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর রোববার ভোট গণনার ফলাফলে বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয়ই শুধু নয়, অকল্পনীয় বিপর্যয়ের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত শতকের শেষদিকে সাবেক সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসহ (রাশিয়া নামে পরিচিত) বিশ্বের ১৮টি রাষ্ট্রে (কিউবা বাদে) কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতাচ্যুতি তথা সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পরও পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে কমিউনিস্ট শাসন বহাল ছিল। তবে ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মসনদ দখল করে জাতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি)। টানা ১০ বছর রাজ্য শাসনের পর মমতার নেতৃত্বাধীন দলটি তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বাংলা দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, এই রাজ্যে ভোটের রাজনীতি থেকে দৃশ্যত: হারিয়ে গেলো টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী এই ফ্রন্ট তাদের ‘হারানো রাজ্য’ ফিরে পাবার আশায় গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেধেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আর এবার কংগ্রেসের সঙ্গে ফুরফুরা দরবার শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দীকির নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেছিল সংযুক্ত মোর্চা। কিন্তু সব চেষ্টায় বিফলে গেছে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ধরাশায়ী হলেন মহাম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী, অশোক ভট্টাচার্য, আভাস রায় চৌধুরী, সুশান্ত ঘোষের মতো হেভিওয়েট বাম প্রার্থীরা। ঐশী ঘোষ, সৃজন ভট্টাচার্য, দীপ্সিতা ধর, সায়নদীপ মিত্র প্রমুখ নবীন প্রজন্মের বামকর্মীরাও এবারের ভোটে কোনোরকম আলোচনাতেই উঠে আসতে পারলেন না। প্রচার পর্বে বামেরা অনেকটা দাগ কাটতে পারলেও বাম কর্মী-সমর্থকদের ভোট তারা নিজেদের পক্ষে ধরে রাখতে পেরেছেন কি না, এই প্রশ্ন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এই প্রশ্নও রয়েছে যে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে একটা বড় অংশের বামপন্থী কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপির প্রতি সমর্থন দেখিয়েছিল, সেই অংশের একটা বড় অংশের মানুষ কি বিধানসভাতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে? কংগ্রেসের সঙ্গে বামফ্রন্টের সমঝোতার নিরিখে এই প্রশ্নটা তীব্র হচ্ছে যে, উভয় দলই কি আন্তরিকভাবে ভোট শেয়ারিং করেছে? ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে (আইএসএফ) ঘিরে ভোটের প্রচারপর্বে যে ধরনের আবেগ তৈরি হয়েছিল, ভোটবাক্সে সেটি যে রূপান্তরিত হয়নি- তা এখনই স্পষ্ট করে বলা যায়। একটা বড় অংশের বামপন্থী, যাদের ভেতরে গত ১০ বছরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়েছিল, ২০২০ সালের লকডাউন ঘিরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ও বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষের প্রভাব অনেকটাই পড়েছিল, তারা মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে বামপন্থীদের জোটকে কতোটা মন থেকে মেনে সেই অনুযায়ী ভোট দিয়েছিল- সেই প্রশ্নটাও ক্রমশঃ তীব্র হতে শুরু করেছে। এই জোট তৈরির ক্ষেত্রে যেহেতু মহাম্মদ সেলিমের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল, তাই একটা বড় অংশের বাম কর্মী-সমর্থকদের ভেতর থেকেও সেলিমের বিরুদ্ধে অরাজনৈতিক অভিযোগ ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হচ্ছে। মীনাক্ষী, সৃজন, ঐশী, দীপ্সিতা প্রমুখ নয়া প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মী ও শতরূপ ঘোষের মতো পরাজয়ের হ্যাট্রিক করা লোকেরা বাম আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্নে কতখানি পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছে- এই প্রশ্নটি ভোটের সময়েই ওঠতে শুরু করেছিল। ভোটের পর এই প্রশ্ন আরো তীব্র হবে। বিমান বসুর মতো বর্ষীয়ান নেতা মীনাক্ষী মুখার্জীর জনপ্রিয়তার তুলনা করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। এই ধরনের তুলনা কতোটা আত্মতৃপ্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সেই প্রশ্নটিও তীব্র হতে শুরু করেছে।