বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :

বনের জমিতে হচ্ছে রোহিঙ্গার বহুতল ভবন ॥ দেখার কেউ নেই

কক্সবাজার থেকে ফিরে বিশেষ প্রতিনিধি:
  • প্রকাশিত সময় : শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ৩৭৫ পাঠক পড়েছে

বনের জমিতে হচ্ছে রোহিঙ্গার বহুতল ভবন ॥ দেখার কেউ নেই

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ডিএফও’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে চলছে অবাধে বনভূমি দখল

নিত্যনতুন পদ্ধতিতে বনের জমি জবর দখল হচ্ছে। কোথাও কোথাও বনভূমি কেটে সমতল করে পাকা দালান থেকে শুরু করে পোলট্রি ফার্ম ও নানা স্থাপনাসহ বনভূমির প্রায় সিংহ ভাগ জায়গায় দখলবাজরা নিয়মিত পাহাড় কেটে পাকা ঘর নির্মাণ ও পাহাড়ি মাটি অবৈধভাবে বিক্রি করছে। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ঈদগাঁও এবং ফুলছড়ি রেঞ্জ অফিসসহ ডিএফওকে ম্যানেজ করেই বনের জমিতে অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মোহাম্মদ নাঈম নামের এক রোহিঙ্গা। শুধু রোহিঙ্গা নাঈম নয়।

ভূমিদস্যুরা নির্বিচারে ধ্বংস করছে বনভূমি। পাহাড়ি খুটাখালী খাল, মধুর শিয়া, হরিণা ঝিরি, তাজ্জুক কাটায় বনবিভাগকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করে চিহ্নিত ভূমিদস্যুর একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অবগত হলেও অজ্ঞাত কারণে উদাসীনতা প্রদর্শন করে আসছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফুলছড়ি ও ঈদগাঁও রেঞ্জের সীমানায় গড়ে তোলা হচ্ছে বহতল ভবনটি। দুই রেঞ্জের সীমানা নিয়ে রশি টানাটানির সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে রোহিঙ্গা নাঈমের পরিবারটি। এই নাঈম পরিবারটি ইসলামাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়ায় তার পরিবারের ১৩ জন রোহিঙ্গা বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৭ জুন দুদক চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বাতিলের সুপারিশ করা হয়।

অভিযোগে জানা যায়, পাহাড়খেকো রোহিঙ্গা মো. নাঈমুল ইসলাম সিন্ডিকেট কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের নাপিতখালী বনবিট ও ঈদগাঁও রেঞ্জের ভোমরিয়া ঘোনা বনবিটের সীমানায় আওলিয়াবাদ দারুস সালাম মাদ্রাসা গেইটে গত কয়েক মাস আগে বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করে। শুরু থেকেই বনবিভাগকে ম্যানেজ করে ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠে আসছিল। অভিযোগে প্রকাশ, নাপিতখালী বনবিটের অধীনে ২০০৭-২০০৮ সালে সৃজিত সামাজিক বনায়নের ১ নম্বর প্লটেই নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বনবিভাগের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের বিষয়টি উঠে আসায় ম্যানেজের ঘটনা ধামাচাপা দিতে নাপিতখালী ও ভোমরিয়াঘোনা বনবিটের মধ্যে শুরু হয় বাকযুদ্ধ। রহস্যজনক কারণে দুই বনবিটের কোন বনবিট কর্মকর্তাই অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে রোহিঙ্গাকে বহুতল ভবন নির্মাণ কাজে উৎসাহ দেন বলে অভিযোগ।

জীববৈচিত্রও ধ্বংস হচ্ছে। পরিবেশের এই বিপন্নতা নিয়ে বন বিভাগ একেবারেই উদাসীন। বনজমি দখলদারদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ জিরো টলারেন্সে থাকার ঘোষনা দিলেও মাঠপর্যায়ে এ ঘোষনা তেমন কার্যকর হচ্ছে না। বনকর্তাদের গুটিকয়েক ভূমিদস্যুদের সাথে আতাত করায় বনজমি দখলের হিড়িক আগের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ। চিহ্নিত এই বনভূমি দখলবাজরা ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিলেও সংশ্লিষ্ট বনকর্তারা তাদের আইন প্রয়োগে রহস্যজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সুত্রে জানা গেছে, বনভুমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের ঘটনা একে অপরের উপর দায় চাপিয়ে শেষ পর্যন্ত সার্ভেয়ারের মাধ্যমে পরিমাপ করে বিট চিহ্নিত করণ ও সীমানা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত আসে। শেষ পর্যন্ত তাও থমকে গেছে।

বনবিভাগের একটি সুত্রে জানা গেছে, ওই বনভুমির সীমানা নির্ধারনে সহকারী বন সংরক্ষক ফুলছড়ি (এসিএফ), দুই রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ বনবিভাগের সার্ভেয়ার রবিউল আলম সরেজমিনে বনভুমি পরিমাপের কথা ছিল। একাধিকবার সময়ও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্ত কোন এক অদৃশ্য কারণে বনকর্তারা ব্যস্ততা দেখিয়ে পরিমাপ না করায় সীমানা বিরোধ সার্ভে অমিমাংসিত রয়ে গেছে। এদিকে শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা (ডিপ্লোমা ফরেস্টার) একেএম আতা এলাহীর হাতেই জিম্মি রয়েছে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগ। অফিসের দাপ্তরিক কাজ এবং হিসাব খাতও রয়েছে তার নিয়ন্ত্রনে। তার নেতৃত্বে ডিপ্লোমা ফরেস্টারেরা শক্তিশালী সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর জিম্মি করে রেখেছে উত্তর বন বিভাগ।

জানা গেছে, ২০২০ সালে শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা ইমদাদুল হক অন্যত্র বদলী হওয়ার পর মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করে বাঘখালী রেঞ্জ থেকে শহর রেঞ্জে পোস্টিং নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আসলে তাও ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।এমনকি তার ক্ষমতার দম্ভে বন অধিদপ্তরের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাদেরও তিনি পাত্তা দেন না। শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা আতা এলাহীর দখলে রয়েছে বনজদ্রব্য, আসবাবপত্র চলাচল পাশ (টিপি), করাতকল (স’মিল) ফার্নিচার মার্ট ও দোকানের লাইসেন্স প্রদান।এখাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। অবৈধ করাতকল, ফার্নিচার দোকান থেকে তালিকা করে মাসিক কয়েক লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলণের অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন।

সরেজমিনে জানা যায়, ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরে নাপিতখালী বনবিটের অধীনে সামাজিক বনায়ন সৃজন করা হয়েছিল। এই বনায়ন উজাড় হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বহুতল ভবন। ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ফুলছড়ির রেঞ্জ কর্মকর্তা ফারুক আহমদ বাবুল বলেন, জায়গাটি ঈদগাঁও মৌজার ভোমরিয়াঘোনা বনবিটের অধীনে। ঈদগাঁও রেঞ্জ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, জায়গাটি জঙ্গল খুটাখালী মৌজার নাপিতখালী বনবিট অধীনে। অবৈধদখলদার মো. নাঈম জানান, সার্ভেয়ার রবিউল ও ফুলছড়ির এসিএফ এর সাথে কথা বলেই ইসলামাবাদ ফকিরা বাজারের পাশেই বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। এটা বনভুমি হলেও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে দখলীয় জমি হিসেবে কেনা হয়েছে।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) ড. প্রভাষ চন্দ্র রায় জানান, জায়গাটি যে বনবিটের অধীনে হোক না কেনো, এটা বনবিভাগের জমি। কাউকেই বন বিভাগের জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করতে দেয়া হবে না। অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সুত্রে জানা গেছে, নাঈম ও তার অপরাপর ভাইয়েরা বিদেশী সংস্থার সাথে জড়িত ! তাদের কয়েকজন ভাই সৌদি আরবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ফান্ড কালেকশন করে। তা স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মাঝে বিভিন্ন কৌশলে বিতরণও করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসাদর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে বলে গুরুতর অভিযোগও রয়েছে স্থানীয়দের।

স্থানীয়দের সুত্রে জানা গেছ, রোহিঙ্গা নাঈম ও তার ভাই তৈয়ব রোহিঙ্গা পারিবারিক সিন্ডিকেটের পরিচালনা করে। নাপিতখালী বিট এবং ভোমরিয়াঘোনা বিটের আওতাধীন বহুস্থানে বনবিভাগের জমিতে তারা পারিবারিক ভাবে একযোগে পাকা বাড়ী নির্মান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে ১৩ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের বাসিন্দা পরিচয়ে পাসপোর্টের জন্য প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগে এই রোহিঙ্গা নাঈম পরিবারের ১৩ জন সদস্য,৩ পুলিশ পরিদর্শক, ১ নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।২০২১ সালের ১৭ জুন দুদক চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে নিজ কার্যালয়ে মামলাটি করেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন মামলার এজাহারে বলা হয়, কক্সবাজার জেলা সদর উপজেলার ইসলামাবাদ এলাকাটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে রোহিঙ্গারা সরকারি খাস জমি, বন বিভাগের জমি দখল করে বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছেন।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন সরকার’র সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপকালে তিনি বিষয়টি অনুসন্ধান করবেন বলে জানান। তবে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত একজন ফরেস্টার জানান প্রতিটি এলাকায় বন ভূমি দখলকারীরা স্থানীয় বিট অফিসার, রেঞ্জ কর্মকর্তার মাধ্যমে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে মোটা অংকের নজরানা দিয়ে বন ভূমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ সহ অবৈধ দখলে নিয়ে থাকেন। তবে এই বিপুল পরিমাণ বেদখলী বনভূমি উদ্ধারে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন বলে বন বিশেষজ্ঞগন মনে করেন।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580