বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে জাহাজ পরিদর্শন (!) করে ডকিং সুপারভিশন ও ওভারটাইম ফিস দাবির চাঞ্চল্যকর বিষয়টির এখনো সুরাহা হয়নি। এ ঘটনায় নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অঙ্গ সংস্থা নৌবাণিজ্য দপ্তরের (এমএমও) বর্তমান ও সাবেক দুই মূখ্য কর্মকর্তার (পিও) মধ্যে পাল্টাপাল্টি চিঠি চালাচালিও হয়েছে। বিষয়টি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর (ডস) গত বছরের জুলাই মাসে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। কমিটির প্রধান ও অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন জসিমউদ্দীন সরকার গত ১৯ ও ২০ অক্টোবর সংশ্নিষ্ট দপ্তর পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও অদৃশ্য কারণে আজো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদেশে চিকিৎসাধীন থেকেও দেশের কয়েকটি জাহাজের সুপারভিশন ফিস দাবিকারী এমএমও’র সাবেক পিও প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম তার বকেয়া পাওনা দাবি করে গত বছরের ৫ জুলাই বর্তমান পিওর কাছে আবেদন করেন। যার অনুলিপি নৌ সচিব ও নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও দেওয়া হয়েছে। এর জবাবে বর্তমান পিও ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ আলাদা দুটি চিঠিতে সাবেক ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন না করে অবৈধভাবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ করেন। চিঠিতে এই টাকা দ্রুত সরকারি কোষাগারে জমা দিতেও বলা হয়। সাবেক পিও’র আবেদনে বলা হয়, তিনি ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ছয়টি নতুন জাহাজ ও উপকূলীয় বিভিন্ন জাহাজসহ সিটি গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপের আরও কয়েকটি জাহাজের প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন সনদ জারি করেন। এসব জাহাজের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তার তত্ত্বাবধানে হওয়ায়, তার যাবতীয় সুপারভিশন ফি পাওয়ার কথা।
ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকেও ‘জাতীয় স্বার্থে’ তাকে ওই কাজ করতে হয়েছিল বলেও আবেদনে জানান তিনি। তবে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সময় কীভাবে বাংলাদেশে ডকইয়ার্ড পরিদর্শন ও জাহাজের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সুপারভিশন করা সম্ভব, তা উল্লেখ করেননি শফিকুল ইসলাম। এই আবেদনের জবাবে বর্তমান মূখ্য কর্মকর্তা গিয়াসউদ্দিন প্রথম চিঠিতে তাকে (শফিকুল) জানান, আপনি সরেজমিন পরিদর্শন না করে সিটি গ্রুপের ১০টি জাহাজের বিপরীতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে সুপারিভিশন বাবদ প্রতি জাহাজ থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার করে মোট ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন।
এ ছাড়া বিএসসির ছয়টি নতুন জাহাজের বিপরীতে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন সনদ জারি করেছেন। গিয়াসউদ্দিনের আরেক চিঠিতে বলা হয়, সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম জাপান থেকে আমদানি করা ‘এমটি কুরেনাই মারু (সি-২০৩০)’ জাহাজের বিপরীতে সুপারভিশন ফি বাবদ ৪৩ হাজার ৯৯০ টাকা নিয়েছেন। অথচ তিনি কখনও ওই জাহাজ পরিদর্শন করেননি। এভাবে তিনি মোট ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯০ টাকা উত্তোলন করেছেন। এই ১৮ লাখসহ ওইসব জাহাজের যাবতীয় সুপারভিশন ফি তার (বর্তমান পিও) নিজের প্রাপ্য বলেও গিয়াসউদ্দিন তার চিঠিতে দাবি করেন। এদিকে, সরকারি আদেশ (জিও) নিয়ে বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকাকালে দেশে নির্মিত জাহাজের ডকিং সুপারভিশন ফিস ও রেজিস্ট্রেশন ফিস দাবি করায় সাবেক পিও শফিকুল ইসলামের ভূমিকা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নৌবাণিজ্য দপ্তরের পিও’র দায়িত্ব পালনকালে তিনি ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরেই বেতন-ভাতার বাইরে সুপারভিশন ও ওভারটাইম ফিস বাবদই এক কোটি ৭৬ লাখ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৮ লাখ (মোট দুই কোটি ৭৪ লাখ) টাকা অতিরিক্ত আয় করেছেন; যা সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছেই বিষ্ময়কর মনে হয়েছে। অন্যদিকে, সাবেক পিও তার বকেয়া টাকা দাবি করে চিঠি দেওয়ার পর বর্তমান পিও দীর্ঘদিন রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ ছিলেন। তবে নৌ অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠনের দুই মাস পর তিনি সাবেক পিও শফিকুল ইসলামের কাছে টাকা ফেরত চেয়ে একই তারিখে আলাদা দুটি চিঠি দিয়ে এবং ওই টাকা নিজের প্রাপ্য দাবি করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এছাড়া উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কার্যক্রম চলমান অবস্থায় এমন চিঠি দেয়ায় পিও গিয়াসউদ্দিনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, সাবেক পিও শফিকুল ইসলাম বিধি লঙ্ঘন করে কয়েকটি জাহাজের বিপরীতে সুপারভিশন ফি বাবদ বেশকিছু টাকা নিয়েছেন। তাকে চিঠি দিয়ে ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আজও তা দেননি। যেহেতু তদন্ত কার্যক্রম চলছে, সেহেতু তার কাছে টাকা ফেরত চেয়ে আর কোনো তাগিদ দেয়া হয়নি। জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সিএনএস ক্যাপ্টেন জসিমউদ্দীন সরকার বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা দেওয়া হয়নি। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ও নানা ব্যস্ততার কারণে বিলম্ব হচ্ছে। তবে প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে বলে দাবি করেন।