ভূমি ও ভূমির মালিকানা বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নকশা প্রস্তুত, মালিকানা সংক্রান্ত রেকর্ড ও পরিসংখ্যান প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে ভূমি জরিপ বলা হয়। সহজ ভাষায় জরিপের সময় পুরাতন তৈরিকৃত নকশা (map) ও রেকর্ড সংশোধন করা এবং জমির আকৃতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে থাকলে অর্থাৎ মালিকানার পরিবর্তন হয়ে থাকলে সেই মোতাবেক সামঞ্জস্য রেখে মৌজা বা সিমানার মধ্যে জমির নকশা এবং কাগজ পত্রের রেকর্ড তৈরি করাকে বুঝায়।
দ্যা সার্ভে অ্যাক্ট – ১৮৭৫ এর ২ ধারা অনুযায়ী জরিপের অন্তর্ভূক্ত হবে সীমানা চিহ্নিতকরণ নদীতীর বরাবর ক্ষয়প্রাপ্ত বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমি নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে পুনঃউদ্ভব বা নতুন উদ্ভবকৃত জমির পরিমাণ নির্ধারণ এবং জরিপের সহিতযুক্ত পূর্ববর্তী সকল কার্যক্রম। প্রসঙ্গত, রেকর্ড বা জরিপ প্রচলিতভাবে খতিয়ান বা স্বত্ত্বলিপি বা (Record of Rights) নামেও পরিচিত।
আমাদের দেশে ভূমি জরিপ বা রেকর্ডগুলো হচ্ছে-
১. মসী জরিপ ১৮৩২-১৮৪৮ সালে জরিপ করা
২. সি.এস জরিপ (Cadastral survey -1888)
৩. এস. এ জরিপ (state acquisition survey)
৪. পি.এস জরিপ (Pakistan survey)
৫. আর. এস জরিপ (Revisional survey)
৬. বি.এস জরিপ (Bangladesh survey 1970-1985)
৭. সিটি জরিপ (City survey 1999-2000)
ভূমি জরিপ চলাকালীন সময়ে মালিকের করণীয়
ভূমি জরিপ চলাকালে ভূমি মালিকের সর্বোচ্চ সতর্কতা স্বরূপ তার জমি নিজের নামে রেকর্ড করা বলে জরিপের সময় ভূমি মালিকের নিন্মোক্ত বিষয়সমূহ অনুসরণ করতে হবে নয়তো জমি নিয়ে ভবিষ্যতে নানা রকম হয়রানির শিকার হবেন।
১. ভূমি জরিপ চলাকালীন সময়ে দখলের ভিত্তিতে নকশা তৈরি করা হয়। তাই ভূমি জরিপে আগেই জমির আইন বা সীমানা নির্ধারণ করে রাখা।
২. মালিকানা প্রমাণের জন্য সকল প্রকারের কাগজপত্র সংরক্ষণ করা।
৩. জমি নিয়ে যদি কোন মামলা থাকে মামলার কাগজ প্রমাণাদি সংরক্ষণ করা।
৪. মাঠ পর্যায়ে আমীনকে (ভূমি পরিমাপক) প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রদর্শন করে সঠিকভাবে রেকর্ড করাতে সহায়তা করা।
৫. প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে যথা সময়ে দিসপুট (dispute)/ আপত্তি/আপিল দায়ের করা।
৬. জমির মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র তপসিল অফিসারকে দেখিয়ে নিজ আনুকূল্যে তসদিক (attestation) করে নেওয়া।
৭. জমির পরিমাণ কম বেশী হলে বদর ফি দিয়ে পুনরায় পরিমাপের জন্য বদর দরখাস্ত দাখিল করা।
৮. কোন বৈধ মালিকের নাম বাদ পড়লে বা অবৈধভাবে কারো নাম খতিয়ানে উঠানো হলে বা কারণিক কোন ভুল। জমির পরিমাণে ভুল থাকলে তসদিক অফিসারকে অবহিত করে রেকর্ড করে নিতে হবে।
৯. খসড়া প্রকাশ করা হলে বা ডিপি চলাকালে রেকর্ড পরিদর্শন করে যদি রেকর্ডে ভুল থাকে তবে নিয়ম অনুযায়ী আপত্তি কেইস দাখিল করতে হবে।
১০. ডিপির সময় ভূমি মালিকের উচিৎ সংশ্লিষ্ট ভূমি কার্যালয়ে উপস্থিত থাকা।
১১. আপত্তি কেসের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে সময় মতো রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি (certified copy) তুলে ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে আপীল দায়ের করতে হবে।
১২. মুদ্রিত রেকর্ড চূড়ান্ত প্রকাশনার সময় মালিক তার প্রতিনিধি পুনরায় রেকর্ড দেখার সুযোগ পাবে। এসময় ভূমি মালিক মুদ্রিত খতিয়ানের কপি এবং নকশা নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন। যদি মুদ্রিত রেকর্ড কোন জালিয়াতি, কারণিক, গাণিতিক বা মুদ্রণ ভুল থাকে তবে এসএস ম্যানুয়ালের ৫৩৩/৫৩৪ ধারায় তা সংশোধনের জন্য চূড়ান্ত প্রকাশনার সময় সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট আবেদন (application) দাখিল করতে হবে।
১৩. আপীল রায়ে কেউ সন্তুষ্ট না হলে মৌজা গেজেট হওয়ার ১-৩ বছরের মধ্যে ২০০ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা যাবে।
সবশেষে জরিপ চলাকালীন সময়ে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে ভূমি মালিকের সচেতনতা বাড়ানো উচিৎ। তা না হলে কষ্টের উপার্জিত টাকায় কেনা জমি রক্ষা করা সম্ভব হবে না। জরিপ চলাকালে নানা ধরণের দালাল, টাউট, বাটপার আর অসাধু লোক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে না বুঝলে এদের খপ্পরে না পড়ে আইনজীবীর (সিভিল ল’ইয়ার) পরামর্শ নিতে পারেন।
রীনা পারভিন মিমি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। Email- [email protected]