চট্টগ্রামে সম্প্রতি হাসপাতালে বিয়ে হওয়া ক্যানসার আক্রান্ত ফাহমিদা কামাল (২৭) আর নেই। সোমবার সকালে নগরীর ও আর নিজাম রোডের মেডিকেল সেন্টারের এইচডিইউতে মারা যান তিনি।গত ৯ মার্চ রাতে মেডিকেল সেন্টারের বেডে জীবন মৃত্যুর সন্নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষ ফাহমিদাকে বিয়ে করেন হাসান। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে গণমাধ্যমসহ সারা দেশব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফাহমিদা ও বর হাসানের জন্য সবাই দোয়া করতে থাকে এবং দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী তাদের ত্যাগে ও অমর প্রেমের ইতিহাস গড়ায় তারা প্রশংসায় ভাসতে থাকে।মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফাহমিদার মামা এস এম আশরাফুল আরিফ।
তিনি বলেন, বিয়ের পর শুধু একদিনের জন্য বাসায় আনা হয়। পরে ১৫ মার্চ আবারও চট্টগ্রাম মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোববার দুপুরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ফাহমিদাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। আজ সকাল সাড়ে ৭টায় আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায় ফাহমিদা।তিনি আরও বলেন, ফাহমিদার মরদেহ চট্টগ্রামের দক্ষিণ বাকলিয়ায় নিজ বাড়িতে নেয়া হয়েছে। বিকেলে বাদ আছর তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
কক্সবাজারের চকরিয়ার ছেলে মাহমুদুল হাসান নর্থ সাউথ থেকে এমবিএ আর চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ বাকলিয়াতে জন্ম নেয়া ফাহমিদা কামাল ইইউবি থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেছে।শিক্ষাজীবনে তাদের দুজনের পরিচয়।
লাবণ্যময়ী স্মার্ট সুন্দরী তরুণী ফাহমিদাকে ভাল লাগতে শুরু করে হাসানের। এর পর আস্তে আস্তে দুজন প্রেমে জড়িয়ে পরে। ভালবাসার মায়াবী বন্ধনে হয়ে উঠে দুজন দুজনার। হাতে হাত ধরে স্বপ্নেবিভোর রঙিন ভুবনে উড়তে থাকে অচেনা হাজারো পথে। সুখ আনন্দ সবই যেন ভরপুর। বিয়ে সংসার কত না মধুর সুখ চোখের কোনায়।কিন্তু একি এমন স্বপ্ন সুখের রঙিন উঠোনে ঘনকালো অন্ধকার। সপেদ আকাশ মেঘে ঢাকা বৈরী ঝড়ো হাওয়া সব তচনচ করে দিতে উদ্যত। ফাহমিদার স্বপ্নরাঙা মায়াবী শরীরে বাসা বাধে মরণব্যাধি ক্যান্সার। ধরা পড়ার পর সাথে সাথে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা এভারকেয়ার পরবর্তীতে ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে নেয়া হয়। সেখানে দীর্ঘ একবছর চিকিৎসার পর ডাক্তাররা সাফ জানিয়ে দেয়- ফাহমিদার চিকিৎসা আর সম্ভব নয়, ইঙ্গিত দেয় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই।
পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে পরিবারের লোকজন ২০ বছর বয়সী ফাহমিদাকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসে মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করায়। সেখানে চলতে থাকে চিকিৎসা। কিন্তু ক্রমাগত ফাহমিদার শারীরিক অবস্থায় অবনতি হতে থাকে।
ফাহমিদার অসহ্য কষ্ট, যন্ত্রণা প্রেমিক হাসানের সহ্য হয় না। ফাহমিদার কষ্ট হাসান ভাগ করে নিতে চান। কপালে হাত রেখে বলতে চান- আমি আগের মত এখনো তোমার পাশে আছি। তুমিই আমার জীবন, তুমিই আমার সব। বুকে জড়িয়ে নিয়ে কষ্টগুলো নিজের করে নিতে চান। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! হাসান ফাহমিদার প্রেমিক হলেও সমাজের চোখে পরপুরুষ। মৃত্যুযন্ত্রণায় ফাহমিদা নিঃশেষ হতে চলেছে।এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন হাসান। ফাহমিদাকে যদি মরতে হয়, তাহলে তার বুকে মাথা রেখেই মরবে। নিজের পরিবারকে নিয়ে এসে প্রস্তাব দিল সে সহসা ফাহমিদাকে বিয়ে করবে। মৃত্যু পথযাত্রী ফাহমিদাকে হাসানের বিয়ে করার প্রস্তাবে সবাই হতবিহ্বল। হাসানকে বুঝানোর ব্যর্থচেষ্টা করা হয়। কিন্তু হাসান তার সিদ্ধান্তে অটল।অবশেষে উভয় পরিবার সম্মত হয়।
বিষয়টি জানানো হয় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহমিদাকে। অবিশ্বাস্য প্রস্তাব শুনে অপলক তাকিয়ে থাকে প্রিয় হাসানের দিকে। ফাহমিদার মুখে ফুটে উঠে নির্মল স্বর্গীয় হাসি।অবশেষে বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়। গত ৯ মার্চ রাতে মেডিকেল সেন্টারে তাদের বিয়ের আয়োজন হয়। কনে ফাহমিদাকে পরানো হয় লাল বেনারসি শাড়ি, গলায় সোনার হার। বর হাসান পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। আকদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। দুজন মিলে কেক কাটে, মালাবদল হয়। খেজুর, মিষ্টি খাওয়ানো হয়।ক্ষণিকের জন্য মরণব্যাধি ক্যান্সারকে জয় করে ফাহমিদা হয়ে উঠেন অন্য এক পৃথিবীর বাসিন্দা। সমস্ত স্বর্গীয় সুখ তাকে ঘিরে রাখে। হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলো আবার যেন ফিরে পান।