কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নির্বিচারে চলছে গাছ নিধন।সেই সাথে প্রকাশ্যে পাচারের ঘটনা ঘটছে ।এছাড়াও সুফল বনায়ন নিয়ে চলেছে হরিলুট।স্থানে স্থানে মরে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির চারা গাছ।এছাড়াও বনভুমি বিক্রি ও পাহাড় কেটে এক প্রবাসীকে পাকা দালান নির্মাণে সহযোগীতা করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছে খোদ রেঞ্জ কর্মকর্তা সোলতান মাহমুদ টিটু ফরেস্টার।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি বৃক্ষ নিধন হচ্ছে জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জের ব্যাঙডেবা বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে।গত এক বছর ধরে জোয়ারিয়া নালা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকাগুলোতে নির্বিচারে পাহাড় কাটা,বনভুমি বিক্রি ও মূল্যবান গাছ কেটে পাচারের ঘটনা রীতিমতো পরিবেশবাদী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
এদিকে, রেঞ্জ কর্মকর্তার যোগসাজশে দিন-রাত গাছ কাটা এবং কাঠ পাচার অব্যাহত থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রহস্যজনক নিরবতা পালন করছে বলে অভিযোগ। রীতিমত বন কর্মকর্তার নিরব ভুমিকার কারণে কাঠ চোরেরা আস্কারা পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে গাছ নিধনে মেতে উঠেছেন।
জানা গেছে, জোয়ারিয়া নালা রেঞ্জের অধীনে ব্যাঙডেবা বনবিটে প্রায় ১৪’শ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে।এই বিটে শতবর্ষীয় মাদার ট্রি গর্জন,সেগুন,করই,গামারী,জারুল, জাম,মেহগনী,তেলসুর ও মিউজিয়াম,সিভিটসহ বিভিন্ন প্রজাতির মুল্যবান গাছ দিনদিন নিঃশেষ হয়ে পড়ছে।সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় কাঠ চোরাকারবারীরা দিনে-রাতে প্রতিযোগিতামুলক ভাবে মুল্যবান গাছ নিধন চালালেও বনবিট কর্মকর্তাও নিশ্চুপ।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ব্যাঙডেবা বনবিটের বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে নিধন করা মুল্যবান গাছগুলো ডাম্পার (মিনি ট্রাক) যোগে পাচার করে যাচ্ছে। এতে করে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মুলয়বান বৃক্ষ দিনদিন শুন্য হয়ে ন্যাড়া ভুমিতে পরিণত হচ্ছে।চোরাই কাঠ পাচারকারী চক্র বনের মূল্যবান গাছ কেটে অন্যত্র পাচার করে দিচ্ছে বলে স্থাণীয়রা অভিযোগ করলেও কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে নিরব ভুমিকা পালন করছেন।
বনের গাছ চুরি অব্যাহত থাকায় সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দিনদিন।ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে ‘সাসটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড (সুফল) প্রজেক্ট’ এর আওতায় সরকারের গৃহিত নতুন বনায়ন কর্মসুচী এই জোয়ারিনালা রেঞ্জে ভেস্তে যেতে বসেছে।
খোদ জোয়ারিয়া নালা রেঞ্জ কর্মকর্তা ও ব্যাঙডেভা বনবিট কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সুফল প্রকল্পের অধীনে টেকসই বনায়ন বিকল্প জীবিকায়ন প্রকল্পের সৃজিত বনায়ন বিফলে চলে গেছে।গত ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ওই রেঞ্জের দুটি বনবিটে প্রায় ১৯৭ হেক্টর সুফল বনায়ন করা হয়েছে।গত জানুয়ারী মাসে ওই সুফল বনায়নে আগাছা পরিস্কারের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।সুফল বনায়নের বেশির ভাগ বিভিন্ন প্রজাতির স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী চারা গাছ মারা গেছে।
রেঞ্জ কর্মকর্তা সোলতান ও বিট কর্মকর্তা দুইজনেই বাগানের আগাছা না কেটে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ।সংশ্লিষ্ট একটি সুত্র দাবী করেছে, ব্যাঙডেবা বনবিটে বনায়ন করার জন্য গত অর্থ বছরে ৯০ বেডের নার্সারী করা হয়েছিল। ওই বেড গুলোতে ৩৫ প্রজাতির ২ লাখ চারা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু বিনা কারণে রেঞ্জ কর্মকর্তা ৯ বেড তছনছ করে পলি ব্যাগ সহ চারা গুলো খালে ভাসিয়ে দিয়েছে।স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বনাঞ্চলের মুল্যবান গাছ কেটে পাচার সহজতর এবং দ্রুত অন্যত্র পাচারের জন্য সংরক্ষিত বনের ভেতর গাছ ও পাহাড় কেটে ব্যাঙডেবা হতে জোয়ারিয়া পর্যন্ত রাস্তা তৈরী করেছে কাঠ চোরাকারবারী সিন্ডিকেট।এসব রাস্তা দিয়ে নির্বিঘ্নে ডাম্পার যোগে দিনে ও রাতে কাঠ পাচার করা হচ্ছে।
রেঞ্জ কর্মকর্তার অফিসে পূর্বপাশে সরকারী জমিতে একতলা ছাদসহ পাকা দালান নির্মাণ করেছে পুর্ব মোরাপাড়া জোয়ারিয়া নালার রশিদ আহমদের ছেলে মো.আলম নামের এক প্রবাসী। এই অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে দালান নির্মাণে সহযোগীতা করেছে রেঞ্জ কর্মকর্তার সোলতান মাহমুদ। ওই এলাকায় এধরনে প্রতিটি অবৈধ কাচা পাকা দালান থেকে তিনি লাখ লাখ টাকা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে বলে অভিযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বনজায়গীরদার (ভিলেজার) জানান, ব্যাঙডেবা বনবিটের দলবন্যা ঘোনা, হেডম্যানের ঘোনা, মংচানুর ঘোনা, জানুর ঘোনা, দোয়ালের ঝিরি, ক্ষেতের ঘোনা, শীলের গুলা খিলা, মনির উল্লাহর ঘোনাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দিনে ও রাতে সেগুন, গর্জন ও সিভিট গাছ কাটা যাচ্ছে।আরও অভিযোগ, নিধন হওয়া চোরাই কাঠ ভর্তি গাড়িগুলো তিতুলিয়ার ঘাট, টংতলী ও জোয়ারিয়া নালা রেঞ্জ অফিসের সামনের সড়ক দিয়ে পাচার করা হচ্ছে। এমনকি মুল্যবান গাছ ছাড়াও ব্যাঙডেবা বনাঞ্চল থেকে লাকড়ী যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী রামু এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটায়।তারা আরও জানান, গত কয়েকদিন আগেও দলবন্যা ঘোনা হতে বিপুল পরিমাণ সিভিট গাছ নিধন করেছে কাঠ চোরেরা। এবিষয়ে সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) সোহেল রানাকে অবগত করেছিল স্থানীয়রা।
তাদের দাবী সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন বন কর্মকর্তারা এসব এলাকা পরিদর্শন করলে শতশত সদ্যকাটা গাছের মুথা পাওয়া যাবে।রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ মাঝে মধ্যে টহলে গিয়ে গাছ নিধন দৃশ্য দেখেও এড়িয়ে যান। কারণ হিসেবে তারা বলেন, প্রতিটি নিধন হওয়া গাছের টাকা পান রেঞ্জ কর্মকর্তা। অথচ উক্ত বনাঞ্চলে এসব গাছ বড় করতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। গাছ বড় করতে লেগেছে দীর্ঘ সময়। অতচ বনের রক্ষক রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ ও বিট কর্মকর্তা কাঠ চোরদের সাথে আতাত করে এসব গাছ অতিঅল্প সময়ে মোটা টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে।
আরও অভিযোগ, ব্যাঙডেবা বনবিটের হেডম্যান আলী আহমদ গত ৩০ বছর ধরে হেডম্যনের দায়িত্ব পালন করছে। কাঠ চোরকারবারীদের সাথে তার রয়েছে দহরম মহরম সম্পর্ক। ফলে রেঞ্জ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা ও হেডম্যন পরস্পর যোগসাজসে পাচার করে দিচ্ছে বনের মূল্যবান কাঠ। সরকারী বনের গাছ বিক্রি করে হেডম্যান আলী আহমদ বর্তমানে কোটি টাকার মালিক। রেঞ্জ কর্মকর্তাও চলে হেডম্যানের কথায়। বর্তমানে ব্যাঙডেবার ৪০ পরিবার হেডম্যানের কাছে জিম্মী , প্রতিবাদ করার সাহস পায়না কেউ।এব্যাপারে জোয়ারিয়া নালা রেঞ্জ কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ হাওলাদার ফরেস্টার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,এসব কিছু আমাদের ডিএফও স্যার জানেন, আপনি এসব বিষয়ে স্যারের সাথে কথা বলেন।
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) সোহেল রানা বলেন, ব্যাঙডেবা বনবিটের সংরক্ষিত বাগান থেকে গাছ কাটা যাওয়ার বিষয়টি অবগত হয়েছি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এব্যাপারে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো.তহিদুল ইসালামের সাথে যোগায়োগ করা হলে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।