মন্তব্য প্রতিবেদন===
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে প্রতিদিন যখন মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তখন আচমকা ঘটে গেলো আরেকটি বিয়োগান্ত ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমএল সাবিত আল হাসান’ দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি এসকে-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ২৮টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ওই লঞ্চের যাত্রীদের স্বজনেরা দাবি করেছেন, আরো অন্তত ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা সমাপ্ত ঘোষণার পরও লাশের খোঁজে শীতলক্ষ্যার পাড়ে স্বজনদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে এবং শোনা গেছে গগনবিদারী আহাজারি-আর্তনাদ। বেদনাদায়ক এ ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। এরপর সেখানে যোগ দেয় বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। ১৮ ঘন্টা রুদ্ধশ্বাস অভিযানের পর সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ এমএল সাবিত আল হাসান লঞ্চটি উদ্ধার করা হয় দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা শুরু এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করার জন্য বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ ঘটনায় আর যাই হোক, নদীতে ভেসে হারিয়ে যাওয়ার আগেই স্বজনেরা অনেক মরদেহ হাতে পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সশরীরে দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে উদ্ধারকাজ তদারকি করেছেন। দুর্ঘটনা তদন্তে তিনি একটি কমিটিও গঠন করেছেন। তবে যাঁকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে তিনি একজন বিতর্কিত কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা নদীতে এমএল পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬ অনুযায়ী, নৌ দুর্ঘটনা তদন্ত করার দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর নয়; এ ক্ষেত্রে নৌ মন্ত্রণালয় তথা সরকার তাদের সুপারিশ ও রিপোর্ট গ্রহণও করবে না। তাই সংস্থাটির কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের দায়দায়িত্ব বা বাধ্যবাধকতাও নেই। অন্যদিকে রোববারের লঞ্চ দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে; যার আহ্বায়ক হয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) খাদিজা তাহেরী ববি। তাঁর নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তবে যে সংস্থাটির ওপর তদন্ত কমিটি গঠনের আইনি দায়-দায়িত্ব রয়েছে, সেই নৌ পরিবহন অধিদপ্তর কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অথচ আইএসও-১৯৭৬ অনুযায়ী, যেকোনো নৌ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন, সরকারের কাছে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন পেশ এবং নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের। আমরা তথা আমজনতার একটাই চাওয়া; তা হচ্ছে এ ধরনের লঞ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বন্ধ হোক। আর এ জন্য দরকার দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করা এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা। সে ক্ষেত্রে লঞ্চসহ যেকোনো নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস প্রদান, রুট পারমিট ও টাইমটেবিল প্রদান, নিয়মনীতি মেনে চলাচল করছে কিনা তা তদারকি এবং মাস্টার ও ড্রাইভারের (চালক) দায়িত্ব ও দক্ষতা- সবকিছুই তদন্তের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু একজন গণমাধ্যমকর্মী ও নৌখাতের সেবক হিসেবে আমার অতীতের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। গ৩ বছরের ২৯ জুন সকালে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে সদরঘাট টার্মিনালের কাছে ‘এমভি ময়ূর-২’ লঞ্চের ধাক্কায় ‘এমভি মর্নিং বার্ড’ লঞ্চ ডুবে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। ওই ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যসচিবকে এবারের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করেছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান। যাত্রীবাহী লঞ্চ মর্নিং বার্ড দুর্ঘটনার পর ওই তদন্ত কমিটি যে সুপারিশগুলো করেছিল, সেগুলোই শুধু গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে। এর বাইরে তদন্তের আর কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। সুপারিশ আর প্রতিবেদন এক জিনিস নয়। ঘটনা তদন্তে যেটা বেরিয়ে আসে সেটাই প্রতিবেদন। আর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় সুপারিশমালা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে গিয়েছিল- এটা যেমন সত্য; নানা ধরনের ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও বার্ষিক ফিটনেস সনদ দিয়ে মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল- এটাও তেমন সত্য। কিন্তু চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় ফিটনেস প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ারকে তদন্তের আওতায় আনা হয়নি। অর্থাৎ দায়সারা কিংবা লোক দেখানো তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে রক্ষা করা হয়েছে। এরপর ওই শিপ সার্ভেয়ার মেঘনায় ডুবে থাকা একটি জাহাজকে ফিটনেস সনদ দিয়েও পার পেয়ে গেছেন। রোববার দুর্ঘটনাকবলিত এমএল সাবিত আল হাসান লঞ্চটির ফিটনেস সনদও দিয়েছেন একই কর্মকর্তা। তাই জোরালো সন্দেহ জাগে, প্রকৃত অপরাধীরা আদৌ কী শাস্তি পাবেন? তবে সব সন্দেহকে পেছনে ঠেলে জনস্বার্থে একটি কথাই বলতে চাই, শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবি ও প্রাণহানির ঘটনায় দায়ীদের কঠোর শাস্তি চাই।
আশীষ কুমার দে : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও নৌখাত বিষয়ক গবেষক।