সারা দেশে চলাচলরত নৌযানের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কোনো দপ্তরে নেই। বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেও নেই এ তথ্য। তবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র মতে, বৈধ নৌযানের চেয়ে অবৈধ নৌযানের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এতে নৌ নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে, সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং সেবাগ্রহীতা তথা সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। আর এ অবস্থার মধ্যেই আগামী মাসের (এপ্রিল) প্রথম সপ্তাহে পালিত হতে যাচ্ছে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ ২০২১। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে নৌ শুমারি শুরু এবং আগামী বছর নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালনের আগেই নৌযানের সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এক সময়ে অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌ পরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু নানা কারণে নৌখাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। এর ফলে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত ব্যয়- দুটোই বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও পরিবেশ দূষণ; যার খেসারাত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তবে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদেই জনবান্ধব নৌখাত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, পর্যাপ্ত নদী খননের মাধ্যমে নৌপথ সচল, বিলুপ্ত নদ-নদী উদ্ধার এবং অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে সরকার। লক্ষ্য পূরণে একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত আছে। কিন্তু নৌখাতের উন্নয়নে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী আন্তরিক হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না; যা নৌ নিরাপত্তা এবং সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে নৌপথ ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থা কখনও জনবান্ধব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ভাষায়, সারা দেশে বিপুলসংখ্যক অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল করছে, যেগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। এর ফলে একদিকে যেমন অহরহ নৌ দুর্ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে সরকার বিপুল অংকের টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের মতে, যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে বৈধ নৌযানের চেয়ে অন্তত আটগুণ বেশি রয়েছে অবৈধ নৌযান। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, দেশে অভ্যন্তরীণ নৌযানের প্রকৃত সংখ্যা কতো? নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্য বলছে, যাত্রী ও পণ্যবাহীসহ সব ধরনের অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংখ্যা ১২,৯৫৯। এর মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযান (লঞ্চ) ৮৩৯, যাত্রীবাহী নৌকা (ট্রলার বা ইঞ্জিনচালিত নৌকা) ৪১৭, মালবাহী নৌযান ৪,০৮৮, ফেরি ৪০, তেলবাহী নৌযান (অয়েলট্যাংকার) ৩৩৩, টাগবোট ১৪৭, ডামবার্জ ৪৫৩, স্পিডবোট ৩০৩, পরিদর্শন বোট ২৬, বালুবাহী নৌযান ৪,৯১০, ড্রেজার ১,২৬৯ এবং অন্যান্য ১৩৪টি। তবে যে সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেই সংস্থারই সাবেক দুই মহাপরিচালক (ডিজি) এই তথ্যের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোরালো দ্বিমত পোষণ করেছেন। এমনকি তাঁরা আলাদা আলাদা সময়ে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালেই ভিন্নমত দিয়েছেন। ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ আয়োজিত ‘হাউ টু প্রিভেন্ট লঞ্চ ডিজাস্টার?’ শীর্ষক সেমিনারে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর (অব.) যোবায়ের আহমেদ বলেছিলেন, “নিবন্ধিত ৮,২৩০টি (তৎকালীন সংখ্যা) নৌযানের বিপরীতে প্রায় দুই লাখ অবৈধ নৌযান চলাচল করে।” এর আগে ২০১০ সালে নৌসচিবকে এক চিঠিতে অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল (অব.) বজলুর রহমান লেখেন, “২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ খাতে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১১,৩০৮; যার মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক সার্ভে হয় আনুমানিক ছয় হাজারের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে যন্ত্রচালিত অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। বিপুলসংখ্যক নৌযান ২/৪ জন ‘ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার’ দিয়ে সার্ভে করে ফিটনেস সনদ প্রদান করা অসম্ভব। ফলে অভ্যন্তরীণ নৌ নিরাপত্তা সর্বদাই হুমকির মুখে রয়েছে এবং প্রায় প্রতিনিয়তই নৌযান দুর্ঘটনা ঘটছে। সার্ভে ছাড়া অবৈধভাবে নৌযান চলাচল করায় একদিকে যেমন নৌ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, অপরদিকে তেমনি সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে।” বৈধ নৌযানের চেয়ে অবৈধ নৌযানের সংখ্যা অনেক বেশি- সাবেক দুই মহাপরিচালকের এ মতামত সমর্থন করে নৌযান শ্রমিকদের একাধিক সংগঠন এবং সামাজিক সংগঠনের নেতারাও বলছেন, জনবান্ধব নৌ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে অবৈধ নৌযানগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নৌখাতসহ সমগ্র পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশের (জিসিবি) সভাপতি নুরুর রহমান সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেই যেখানে নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে আন্তরিক ও সচেষ্ট, সেখানে হাজার হাজার অবৈধ নৌযান চলাচল করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য অবিলম্বে নৌ শুমারি শুরুর তাগিদ দেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, সরকার প্রতি বছর বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করে। এ বছরও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এমন আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু নৌযানের সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও অবৈধ নৌযানগুলোকে আইনের আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে নৌ শুমারি শুরু এবং আগামী বছর নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালনের আগেই নৌযানের সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশের আহ্বান জানান হাজী শহীদ মিয়া। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের সাবেক প্রধান ড. মীর তারেক আলী বলেন, বহু আগে থেকেই নৌযানের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নৌ শুমারি না হওয়ায় এর সঠিক সংখ্যা সরকারের হাতে নেই। তবে নিবন্ধিত নৌযানের চেয়ে প্রকৃত নৌযানের সংখ্যা যে অনেক বেশি তা সহজেই অনুমান করা যায়। অধ্যাপক মীর তারেক আলী বলেন, সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করতে হলে অবশ্যই নৌ শুমারি প্রয়োজন। এতে অভ্যন্তরীণ নৌ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা যেমন কমে আসবে, তেমনি সরকারের রাজস্ব আদায়ও বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে অভিমত দেন এই বিশেষজ্ঞ।