প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, তার সরকার ৯০ শতাংশ মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের আওতায় আনার লক্ষ্যে তৃণমূল থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিচ্ছে। আজ বুধবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বাস্তবায়িত ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-২’ এর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি’র ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চট্টগ্রাম হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। খবর বাসসের
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে নয়, বরং ইউনিয়ন পর্যায়ের ৯০ শতাংশ মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ বাংলাদেশ ভূমিকম্প দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়ার কারণে এ সময় তিনি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর থেকে চাপ কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারে উদ্যোগী হওয়ার এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সময় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে জলাধারের ব্যবস্থা রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের বাণিজ্যিক নগরীই হচ্ছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। সেই চট্টগ্রামের উন্নয়ন করা আমরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলেই মনে করি, কারণ চট্টগ্রাম উন্নত হলে সমগ্র বাংলাদেশই উন্নত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি সবকিছুতেই চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সুপেয় পানির যে সমস্যা তা সমাধানে সরকার গঠনের পর থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের (ফেস-২) আওতায় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় নির্মিত পানি শোধনাগার-২ এর উদ্বোধন হচ্ছে। এরকম আরো কয়েকটি প্রকল্পও তার সরকার করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই চট্টগ্রামের পানি সমস্যা সমাধানে পানি শোধন এবং পাইপলাইনে সরবরাহের বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয় তার সরকার। ’৯৯ সালে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ‘জাইকা’ কর্ণফুলী নদী থেকে পানি শোধন করে চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহের প্রকল্প গ্রহণ করে ও সমীক্ষা করে এবং ২০১১ সালে ‘কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-১)’ এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। কারণ, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসতে না পারায় এই প্রকল্প ব্যাহত হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এরপর ২০২০ সালে চট্টগ্রাম শহরের ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণে মদুনাঘাটে দৈনিক ৯ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন শেখ রাসেল পানি শোধনাগার উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর পশ্চিমতীরে কাফকো, সিইউএফএল, কোরিয়ান ইপিজেড, আনোয়ারাস্থ চায়না ইকোনমিক জোন, গড়ে ওঠা শিল্প এলাকাসহ আবাসিক এলাকার পানির চাহিদা মিটাতে দৈনিক ৬ কোটি লিটার সরবরাহ ক্ষমতাসম্পন্ন পানি সরবরাহ প্রকল্প চলমান রয়েছে।
তার সরকার চট্টগ্রামে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর জনগণকে আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দিতে ড্রেনেজ ও স্যানিটেশন মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ণের পর তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আরও ৫টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হবে।
তিনি বিশেষ করে কর্ণফুলী এবং হালদা ও সাঙ্গু প্রভৃতি নদীগুলো যাতে দূষণ মুক্ত থাকতে পারে সে বিষয়েও জোর দেন। এ সময় প্রত্যেকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে তার সরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে এগুলো যেন ভালোভাবে চলে সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
এখন ঢাকা ওয়াসার দৈনিক ২৩৫ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে দৈনিক সরবরাহ ক্ষমতা ২৪৫ কোটি লিটার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে এখন আর পানির সমস্যা নেই। সায়েদাবাদ-১ প্রকল্প দিয়ে শুরু এবং ধীরে ধীরে আমরা অনেকগুলো শোধনাগার করেছি। এখন ঢাকা ওয়াসার দৈনিক ২৩৫ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে দৈনিক সরবরাহ ক্ষমতা ২৪৫ কোটি লিটার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ যাতে সুপেয় পানি পেতে পারে এবং তাদের জীবন মান উন্নত করার জন্য তার সরকার পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ১শ’ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার সারা দেশে সুপেয় পানি এবং আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যাবস্থার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে উল্লেখ করে তিনি একে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি চট্টগ্রাম উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, অতীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক অফিসের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে থাকলেও ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো এগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক করে ফেলায় চট্টগ্রাম অবহেলিতই থেকে যায়। তবে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথমবার সরকার গঠনের পরই চট্টগ্রাম যেন প্রাণ ফিরে পায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছুতে উন্নত হয়।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে প্রথম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে। আজকে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থারও বিশেষ উন্নতি করা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রায় সমাপ্তির পথে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে- এভাবেই চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের দিকে আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ইপিজেড এর পাশাপাশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, মিরেরসরাই, বাঁশখালি, আনোয়ারা, মহেশখালি ও কক্সবাজার- বিভিন্ন জায়গায় শিল্প নগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির পরে সে এলাকার অর্থনীতিও যথেষ্ট গতিশীলতা পেয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করার ব্যাপারেও তার সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে, যাতে ওই অঞ্চল সুরক্ষিত থাকবে আবার পর্যটনের দিক থেকেও সুবিধা হবে। এই সুন্দর এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করে এর সার্বিক উন্নয়নই তার লক্ষ্য, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি এ সময় কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ কাজও প্রায় সমাপ্তির পথে জানিয়ে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মহিউদ্দীন চৌধুরীকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন এবং তার সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
আজকের প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তার সরকার সুপেয় পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ যেসব নাগরিক সুবিধাগুলো সৃষ্টি করে দিচ্ছে সেসব জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে যেন সামঞ্জস্য রেখে চলমান থাকে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেন তিনি। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঞ্চালণায় অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ স্বাগত বক্তব্য দেন। চট্টগ্রাম ওয়াসার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্রও পরিবেশিত হয়।