কলা একটি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি থাকায় তা দীর্ঘসময় পর্যন্ত শরীরে শক্তি জোগায়। জ্বর কিংবা ওজন কমে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় কলা খেলে শরীরে দ্রুত শক্তির সঞ্চার করে দুর্বলতা হ্রাস করে। কলায় প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকায় এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কলা মূলত অ্যান্টাসিডের মতো কাজ করে হজমে সহায়তা করে এবং পেট ফাঁপা সমস্যা রোধ করে। এ ছাড়াও কলা পাকস্থলিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি রোধে ভূমিকা রাখে। এতে প্রচুর পরিমাণ আয়রন থাকায় রক্তের হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে। সবমিলিয়ে একটি কলায় অন্তত ১২টি প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ রয়েছে। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু সব কলায় কি এমন পুষ্টিগুণ থাকে? প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরটা বেশ জটিল। হাট-বাজারে পাওয়া অধিকাংশ কলায় পুষ্টিগুণের তুলনায় ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে বহুগুণ। যা মানবদেহে বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারক মারাত্মক রোগব্যাধি উপাদান। কলা পাকাতে প্রকাশ্যে ব্যবহার হচ্ছে কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।
কলা নিয়ে ছলাকলার এমন রহস্যময় ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন কলার পাইকারি হাট-বাজারে। কাঁচা কলা পাকাতে প্রকাশ্যে এমন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মেশাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে মাত্র ১২ ঘণ্টায় কাঁচা কলা হলুদ রঙে পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকাশ্যে কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর এমন একটি গোপন ভিডিও কালের কণ্ঠের কাছে পাঠিয়েছে এক সচেতন পাঠক। ওই পাঠকের মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিওচিত্রের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে আরো চাঞ্চল্যকর ও ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ২০টি পাইকারি কলার আড়তে এমন বিষক্রিয়াযুক্ত ভেজাল কলা বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের হাসানগঞ্জ, মনমথ গ্রামের ব্রীজমোড়, স্লুইস গেট, সাতগীরি, সর্বানন্দ ইউনিয়নের লিটনমোড়, আনন্দ বাজার, কামেমবাজার, রামজীবন ইউনিয়নের ডোমেরহাট, বালারছিরা, ঢোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের নতুন বাজার, হাতিয়া চৌরাস্তা, ছাপরহাটী ইউনিয়নের মজুমদারহাট, শান্তিরাম ইউনিয়নের শোভাগঞ্জ, কালিতলা, শ্রীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর, বাইপাসমোড়, মাঠেরহাট, বেলকা, চন্ডিপুর ও কঞ্চিবাড়িন ইউনিয়নসহ প্রায় ২০টি স্থানে এমন ভেজাল বিষক্রিয়া কলা বিক্রি হয়। এসব কলা পাইকারি কিনে নিয়ে স্থানীয় হাট-বাজার ছাড়াও জেলা শহর হয়ে রাজধানী ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কলাগুলো দেখতে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় রঙের হলেও প্রতিটি কলা বিষে ভরা।
ব্যবসায়ীরা কলার বাগানে প্রথমে একটি কেমিক্যাল পানিতে মিশিয়ে কলার কাঁদিতে স্প্রে করেন। এরপর সেই কলার কাঁদি বাগান থেকে কেটে এনে সংরক্ষণ করেন আড়তে। পরে এসব কলা শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার করে কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ মেশানো পানিতে চোবান। অপরিপক্ক কলা সবুজ রঙ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই হলুদ ও আকর্ষণীয় হয়ে যায়। আর কেমিক্যালে পাকানো এসব কলা যাতে পচে না যায় সে জন্য ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো এসব কলা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও স্বাচ্ছন্দ্যে বাজারজাত করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। গত একসপ্তাহ ধরে উপজেলার অন্তত ১০টি পাইকারি কলার মোকাম ঘুরে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
কলার কাঁদিকাটা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে দেওয়া হয় কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক বিষ। বাগানে থাকা অবস্থায় হরমোন স্প্রে করা হয়। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভে রাইপেন ও কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হয়। দেখতে সুন্দর এবং হলুদ রঙ ধারণ করানোর জন্য বিভিন্ন নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা। স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে প্রফিট, মার্শাল, হিলডন, রাইজার, বাসুডিন, ইথিলিন, রাইপেনসহ অনেক ধরনের ওষুধ ছিটানো হচ্ছে অপুক্ত কাঁচা কলায়। যা গ্রাম থেকে সহজে পৌঁছে যাচ্ছে শহর-বন্দরে। আর এসব ভেজাল পণ্য প্রকাশ্যে বিক্রি হলেও নির্বাক স্থানীয় প্রশাসন।
পুষ্টিবিদের তথ্যমতে, প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ কলায় আছে ১১৬ ক্যালরি, ক্যালসিয়াম ৮৫মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৫০ মিলিগ্রাম, পানি ৭০.১%, প্রোটিন ১.২%, ফ্যাট/চর্বি ০.৩%, খনিজ লবণ ০.৮%, আঁশ ০.৪%,শর্করা ৭.২%।
কিন্তু কার্বাইড-মিশ্রিত এসব কলায় কলায় রয়েছে অসংখ্যা রোগব্যাধি। যা সুস্থ ও সবল মানুষকে চিরতরে অসুস্থ করে রাখে। বিষাক্ত কলা খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। মূলত কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ শরীরে গেলে লিভার ক্যান্সার, কিডনিজনিত সমস্যা, ডায়াবেটিস ও গর্ভবতী নারীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এমনকি গর্ভেও শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে। তাদের মতে, এসব ভেজাল খাদ্যের কারণে দেশে প্রতিবছর তিন লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ। আর গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। তাই দ্রুত ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সচেতন মহলের।
কলায় কেমিক্যাল বিষ প্রয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো ব্যবসায়ী মন্তব্য করতে রাজি হননি। গণমাধ্যকর্মীদের উপস্থিতি জানতে পেরে সেখান থেকে সটকে পড়েন তারা। তাই তাদেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বিষযুক্ত এসব কলার স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশরাফুজ্জামান সরকার বলেন, কেমিক্যাল-মিশ্রিত এসব কলা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব কলা খাওয়ার সাথে সাথে বমিবমি ভাব ও ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। আর রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের পর তা দাহ্যে পরিণত হয়ে নিঃসারণ ঘটে লিভার ও কিডনির মাধ্যমে। মূলত কার্বাইড জাতীয় কেমিক্যালের প্রভাবে গর্ভবতী নারীদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এমনকি গর্ভজাত শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে। তাই এসব খাবার পরিহার করার পরামর্শ এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী লুতফুল হাসান এ ব্যাপারে বলেন, কলার মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো গুরুতর অপরাধ। আমি এসব কলার আড়তে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।