বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ১১ ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি নওরোজ হীরা সিকদারকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর ভুক্তোভোগী সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা বাদী হয়ে নওরোজ হীরার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে বাকেরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় ধর্ষণে সহায়তাকারী হিসেবে নওরোজ হীরার ভাতিজিকেও আসামি করা হয়েছে। মামলার পর আত্মগোপন করেন নওরোজ হীরা।
পুলিশের গ্রেফতার থেকে রক্ষা পেতে অনেকটা গোপনে বৃহস্পতিবার (০৫ নভেম্বর) দুপুরে বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নওরোজ হীরা ও মারিয়া আক্তার হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। তবে বিচারক এসএম মাহফুজ আলম তাদের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
নওরোজ হীরা বাকেরগঞ্জ উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ফরিদপুর গ্রামের মৃত আব্দুল খালেক সিকদারের ছেলে। নওরোজ হীরা ফরিদপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য। তিনি ফরিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। তাছাড়া কারকধা একেএম ইনস্টিটিউশন নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যও তিনি।
হীরা দুই সন্তানের বাবা। তবে একাধিক মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণে কয়েকবছর আগে তার স্ত্রী তাকে তালাক দিয়েছেন। মামলার অপর আসামি মারিয়া আক্তার একই গ্রামের নুরু সিকদারের মেয়ে। মারিয়া সম্পর্কে নওরোজ হীরার ভাতিজি হন।
গত ২৮ অক্টোবর নওরোজ হীরা বিরুদ্ধে বাকেরগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া মামলা সূত্রে জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রীর বাড়ি ও নওরোজ হীরার বাড়ি একই এলাকায়। ওই ছাত্রীর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল। এজন্য মেয়েকে প্রাইভেট পড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। তখন মারিয়া আক্তার তার চাচা নওরোজ হীরার কাছে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়ার কথা বলেন।
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর সকালে মারিয়া আক্তার ওই ছাত্রীকে তার চাচা নওরোজ হীরার কাছে নিয়ে যান। স্ত্রী তালাক দেয়ায় নওরোজ হীরা বাড়িতে একাই থাকতেন। পরে ভাতিজি মারিয়া আক্তারকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দরজা আটকে ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন নওরোজ হীরা।
এ সময় ধর্ষণের ভিডিও এবং স্থির চিত্র নওরোজ হীরা তার মুঠোফোনে ধারণ করেন। পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই ছাত্রীদের অনৈতিক সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করেন তিনি। লজ্জা ও ভয়ে ওই ছাত্রী বিষয়টি গোপন রাখে।
সম্প্রতি ওই ছাত্রীসহ ১১ ছাত্রীর ভিডিও এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এ ঘটনায় ছাত্রীর মা বাদী হয়ে মামলা করেন।
পশ্চিম ফরিদপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, নওরোজ হীরা নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত এবং সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতেন। বাকেরগঞ্জ উপজেলায় জাতীয় পার্টির অবস্থান বেশ ভালো। নওরোজ হীরা জাতীয় পার্টির নেতা বলে পরিচয় দিতেন। উপজেলার জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল।
নেতাদের আশীর্বাদে মধ্য ফরিদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদ পান তিনি। একইভাবে কারকধা একেএম ইনস্টিটিউশন নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য পদও বাগিয়েছেন তিনি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং আরেকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বেতনসহ বিভিন্ন ফি মওকুফ ও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাইয়ে দেয়ার কথা বলে সম্পর্ক গড়ে ভিডিওচিত্র মুঠোফোনে ধারণ করেন তিনি। পরে সেই ভিডিও দেখিয়ে ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেন। সেটাও গোপনে ভিডিও করেন। পরে ইন্টারনেটেন ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ওই ছাত্রীদের অনৈতিক সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করতেন তিনি।
সম্প্রতি নওরোজ হীরার সঙ্গে জমি নিয়ে এক প্রতিবেশীর ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তারা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় নওরোজ হীরার পকেট থেকে তার মুঠোফোন পড়ে যায়। পরে গ্রামের এক ব্যক্তি ওই মুঠোফোন কুড়িয়ে পান।
মুঠোফোনটির মেমোরি কার্ডে সংরক্ষণ করে রাখা ১১ ছাত্রীকে ধর্ষণের ভিডিওচিত্র সম্প্রতি গ্রামের মানুষের মোবাইল ফোনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান নওরোজ হীরা।
বাকেরগঞ্জ থানা পুলিশের ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, নওরোজ হীরা ও মারিয়া আক্তার আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিতে চেয়েছিলেন। তবে আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। নওরোজ হীরাকে পুলিশ হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার অপকর্মের নানা ঘটনা বেড়িয়ে আসবে। তাই তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।