আশীষ কুমার দে : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই নৌখাতের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের শাসনভার হাতে নিয়ে নদ-নদী রক্ষা ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনার পর তখনকার সব পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে এবং পরবর্তী সরকারগুলোর বিমাতাসুলভ ভূমিকার কারণে নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয় সম্ভাবনাময় নৌ পরিবহন খাত। নৌ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও সংস্থায় খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে অনেক দেরিতে হলেও বিধ্বস্ত নৌখাতকে আবারো গতিশীল ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ লক্ষ্যে বিলুপ্ত-বেদখল নদ-নদী ও নৌপথ উদ্ধার এবং নিয়মিত খনন ও পলি অপসারণের দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এর অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এছাড়া নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি অন্য সংস্থাগুলোকেও গতিশীল করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু দেশের শাসনভার গ্রহণের পর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টনকালে নৌ মন্ত্রণালয় (তৎকালীন নৌ পরিবহন বিভাগ) নিজের হাতে রেখেছিলেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে শক্তিশালী নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামো ও নৌযান মেরামতসহ নৌখাতের উন্নয়নে নানামুখি পদক্ষেপ নেন তিনি। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, নদ-নদী বাংলাদেশের অস্তিত্বের অংশ। এ জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের মতো কঠিন কাজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও নদ-নদী খননের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে ভোলেননি তিনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের রেখে যাওয়া ‘খনক’ নামের একটি মাত্র ড্রেজার (খননযন্ত্র) দিয়ে নদী খনন ও বিশাল আয়তনের নৌপথের পলি অপসারণ সম্ভব নয়। এ উপলব্ধি থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনামলে বিআইডব্লিউটিএর জন্য দু’দফায় নেদারল্যান্ড থেকে সাতটি উন্নতমানের ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন; যেগুলো এখনও বিআইডব্লিউটিএর বহরে যুক্ত ও সচল রয়েছে। সূত্র মতে, বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে আনা ড্রেজারগুলো হলো- ডেল্টা-১, ডেল্টা-২, ড্রেজার-১৩৫, ড্রেজার-১৩৬, ড্রেজার-১৩৭, ড্রেজার-১৩৮ ও ড্রেজার-১৩৯। এর মধ্যে প্রথম দুটি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছাস্বরূপ দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। অন্য পাঁচটি ১৯৭৫ সালে সে দেশ থেকে ক্রয় করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শুধু নদীপ্রেমী ছিলেন না; প্রকৃতিপ্রেমীও ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনের ভবিষ্যত নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন। প্রাকৃতিক এ বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদীর বুক চিরে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল অব্যাহত থাকলে নিকট-ভবিষ্যতে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে- এমন আশঙ্কাও জেগেছিল তাঁর মনে। যেহেতু আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর মংলার সঙ্গে শিল্প ও বন্দরনগরী খুলনাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের নৌ যোগাযোগ অপরিহার্য ছিল, সেহেতু মংলা বন্দরের যাত্রা শুরু থেকেই শেলা নদী দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করতো। তাই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথটি বন্ধ করা মোটেও সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, সময়ের প্রয়োজনেই শেলা নদীকে ভারি নৌযান চলাচলমুক্ত করতে হবে। তা না হলে সুন্দরবনকে রক্ষা করা কঠিন হবে। এ জন্য তিনি সমুদ্রবন্দর মংলার সঙ্গে সারা দেশের জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বিকল্প নৌপথ সৃষ্টির উপায় খুঁজতে থাকেন। তাঁর নির্দেশে লুপ কার্টিং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ঘষিয়াখালী থেকে রামপাল উপজেলার বেতিবুনিয়া পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার (কিমি) সংযোগ খাল খননের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয় ৩১ কিলোমিটার (কিমি) দীর্ঘ নতুন নৌ চ্যানেল বা নৌপথ। ১৯৭৫ এর জুনে খনন কাজ পুরোপুরি শেষ হলেও এর প্রায় ৬ মাস আগে ১৫ জানুয়ারি চালু হয় ১২ ফুট গভীরতাসম্পন্ন জাহাজ চলাচলের উপযোগী মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে এটি চালু হয় ১৯৭৪ এর শেষদিকে। নতুন এ নৌপথ সৃষ্টির ফলে সুন্দরবনকে ঝুঁকিমুক্ত রেখে নিরবিচ্ছিন্ন নৌ যোগাযোগের পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর হতে মংলা সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ৮৯ কিলোমিটার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু সরকার ‘মেঘনা-কুশিয়ারা নদীর ভৈরব বাজার হতে ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত জলপথের উন্নতি সাধন’ শীর্ষক জলপথ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এই নৌপথকে সারা বছর ৬ ফুট গভীরতাসম্পন্ন জাহাজ চলাচলের উপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ১৯৭৫ সালে পটুয়াখালী নদীবন্দরের নির্মাণকাজ ও বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলোর খননকাজও প্রায় শেষ হয়েছিল। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৮ নম্বর অধ্যাদেশ অনুযায়ী গঠিত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জল পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)। সংস্থাটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ৬০৮টি নৌযান নিয়ে; যার মধ্যে ২০টি ছিল যাত্রীবাহী। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই এই সংস্থার বহরে আরো যাত্রীবাহী জাহাজ, ফেরি, সী-ট্রাক, কার্গো ও ওয়াটার বাস যুক্ত হয়েছিল। জানতে চাইলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। যে কারণে তাঁর শাসনামলেই নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তিনি বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি-কে গতিশীল করার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পর সে সব কর্মপরিকল্পনা বাতিল করা হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনো সরকারই নৌখাতের দিকে নজর দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নদ-নদীগুলো এভাবে ধ্বংস এবং নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার এই নাজুক অবস্থা হতো না এবং দেশেরও অনেক উন্নতি হতো বলে মন্তব্য করেন হাজী শহীদ মিয়া। উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের সভাপতি ও নৌ পরিবহন বিষয়ক গবেষক আমিনুর রসুল বাবুল বলেন, বঙ্গবন্ধু নৌখাতের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে অনেক পরিকল্পনা হাতে নিলেও তা সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। তবে অনেক দেরিতে হলেও শেষপর্যন্ত নৌখাতের উন্নয়ন হচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হাঁটছেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। বিধ্বস্ত নৌখাতকে গতিশীল ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।