মাত্র ২৫ হাজার টাকা পুজিঁ নিয়ে ব্যবসা শুরু করা নোয়াখালীর এ কে এম নেয়ামত উল্লাহ এখন কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়া উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।
নেয়ামত উল্লাহ জানালেন ‘ছোট বেলা থেকেই আমি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্ন দেখতাম নিজে সাবলম্বী হয়ে অন্যদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবো। কিন্তু ব্যবসা শুরু করার সাহস পাইনি। এরই মধ্যে আমি সরকারের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে জানতে পারি এবং ড্রেস মেকিং এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।’
ব্যবসায়িক কারণে বর্তমানে রাজধানীর মগবাজারে বসবাসকারী, ৪২ বছর বয়সী নেয়ামত জানান, প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মাত্র ২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেন তিনি। একজন স্কুল শিক্ষক ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে এই অল্প পুঁজির ব্যবস্থা করতে গিয়েও তাকে হিমশিম খেতে হয়।
‘আমার কোনো পুঁজি ছিল না। নিজের মাত্র ৫ শত টাকা ও স্বজনদের কাছ থেকে ২৪ হাজার ৫ শত মোট ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু, বর্তমানে আমার ব্যবসার মূলধন প্রায় ১ কোটি টাকা,’ বলেন নেয়ামত।
ড্রেস মেকিং ব্যবসার সফলতা তাকে ‘সফল আত্মকর্মী ২০১০’ পুরুস্কার এনে দেয়। এই পুরুস্কার গ্রহণের সময় তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যেশ্যে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেনা তাকে নতুন ব্যবসার দিকে ঠেলে দেয়। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ীই তিনি সোনালি আঁশ পাট নিয়ে কাজ শুরু করেন। এক্ষেত্রেও তাঁর একনিষ্ঠ শ্রম ও মেধা তাকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে যায় এবং ‘শ্রেষ্ঠ যুবসংগঠক পুরস্কার ২০১৭’ পান তিনি।
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরীতে সরকার গৃহীত পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে নব প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) এর নির্বাহী চেয়ারম্যান (সচিব) দুলাল কৃষ্ণ সাহা বাসস’কে বলেন, একশন প্ল্যান (২০২০-২০২৫) অনুযায়ী আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশ ১ কোটি ৭ লাখ প্রশিক্ষিত, দক্ষ জনবল তৈরি করতে সক্ষম হবে।
এছাড়া, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ও যোগান সংক্রান্ত বিষয়াদিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম এর তথ্য প্রকাশের লক্ষ্যে একটি স্কিলস পোর্টাল তৈরী করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। এনএসডিএ’র বিভিন্ন কার্যক্রম উল্লেখ করে তিনি বলেন প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়ের অধীন এই সংস্থাটি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। দেশীয় ও আর্ন্তাতিক শ্রম বাজারের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মকৃতি নির্দেশক, অভিন্ন প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কার্যক্রম সমন্বয় করবে।
এনএসডিএ নিজে কোনো প্রশিক্ষণ দিবে না উল্লেখ করে, কৃষ্ণ সাহা বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দেয়া প্রশিক্ষণের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে এই সংস্থা। পাশাপাশি সকল প্রতিষ্ঠাণ যেনো একই সিলেবাস অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারে, সে লক্ষ্যে কোর্স তৈরীর কাজও করবে এই প্রতিষ্ঠান।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আজহারল ইসলাম খান বলেন, যুব জনগোষ্ঠীর কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ট্রেডগুলোর বর্তমান অবস্থা যা যুব জনগোষ্ঠীকে কারিগরি শিক্ষা প্রদানের জন্য দেশের জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে স্বাস্থ্য বিধি মেনে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক বিভিন্ন ট্রেডে দেশের ১৮-৩৫ বছর বয়সি বেকার যুব ও যুব মহিলাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থীরা বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করছে।
তিনি আরো বলেন, চলতি অর্থবছরে সারাদেশে ৮৪টি ট্রেডে ৩ লাখ ১৭৪ জনের প্রশিক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ৪৪,৩২৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শুরু থেকে সেপ্টেম্বর-২০২১ পর্যন্ত ৬৫ লাখ ৫ হাজার জনকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
আজহারুল জানান, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষন কার্যক্রম অধিদপ্তরের নিজস্ব ভবনে সরাসরি পাঠদান ও ব্যবহারিক ক্লাশের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। কিন্তু, করোনাকালীন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। তাই, বিভিন্ন মুঠোফোন কোম্পানি ও অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করে তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক প্রশিক্ষণ অচিরেই চালু করা হবে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ প্রদানের পর একজন বেকার যুব ও যুব মহিলাকে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক প্রকল্প স্থাপনের জন্য যুব ঋণ প্রদান করা হয়। করোনার সময়ে এসব প্রকল্প গ্রহনকারী যুব ও যুব মহিলারা আর্থিকভাব ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্থ যুবদের প্রণোদনা দিয়ে সহযোগিতা করলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এজন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ প্রদানসহ নিজস্ব তহবিল থেকে মাত্র ৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ প্রদান করছে।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় নতুন নতুন প্রশিক্ষণ যেমন- ফ্রিল্যান্সিং, মোবাইল সার্ভিসিং, বিউটিফিকেশন, ওয়েব ডিজাইন, ডাটাবেজ, নেটওয়ার্কিং প্রভৃতি চালু করা হয়েছে এবং আরো নতুন নতুন ট্রেড যেমন- ম্যাশন, প্লাম্বিং এন্ড পাইপ ফিটিংস, ফুড প্রসেসিং, ক্যাটারিং, থ্রিডি ফ্যাশন ডিজাইনিং এবং স্থানীয় চাহিদা মোতাবেক আরো কিছু প্রশিক্ষণ সংযোজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, বলেন তিনি।
চাহিদা অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ট্রেড চালুর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণগুলো মূলত: এলাকাসমূহের চাহিদার ভিত্তিতে করা হয়। সাধারণত স্থানীয় যুব নর-নারীদের চাহিদার ভিত্তিতে ট্রেড নির্বাচন করে নির্ধারিত ট্রেডের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষককে দিয়ে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া, এলাকার চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নতুন ট্রেড নির্বাচনের পরিকল্পনাও বর্তমানে রয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মোবাইল প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। করোনা মহামারি বিবেচনায় যুব নারীদের জন্য নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে মোবাইল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বিশেষ মোবাইল প্রশিক্ষণ বর্তমানে কেবল নারীদের জন্যই পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এই শিক্ষণসমুহ স্থানীয় যুব মহিলাদের চাহিদা মোতাবেক প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি জানান, ‘প্রশিক্ষণ শেষে আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের ঋণ প্রদান করে থাকি। কিন্তু আমাদের ঋণ তহবিল অপর্যাপ্ত থাকায় আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী সকলকে ঋণ প্রদান করতে পারি না।’
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষিত যুবকদের ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ৬০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত একক ঋণ প্রদান করা হয়।
তিনি আরো জানান, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিজস্ব ঋণ তহবিল স্বল্পতার জন্য এখনও উদোক্তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে, ভবিষ্যতে যাতে উদ্যোক্তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া যায় সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তাছাড়া, ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে বেকার যুব জনগোষ্ঠীর ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে অনলাইনে প্রশিক্ষণ প্রদানের বিশেষ সুযোগ সৃষ্টির জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে এবং কিছু কিছু প্রশিক্ষণ অনলাইনে পরিচালনার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।