২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আবার সরগরম হয়ে উঠেছে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডের ইলিশ মোকাম। মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) ভোরে নদী ও সাগর থেকে ইলিশের বোট আসা শুরু করে। এদিন ২০ হাজার মণ ইলিশ এসেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, মোকামে আসা অনেক ইলিশ ডিম ছাড়েনি।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, জাটকা সংরক্ষণে কঠোর তদারকি করতে হবে। এতে ইলিশ বৃদ্ধি পেলে রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশ যে পরিমাণ ডিম ছেড়েছে তা সংরক্ষণ করলে বরিশাল বিভাগে চার লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদনের টার্গেট পূরণ হবে।
এদিকে, ইলিশের জালে ধরা পড়েছে ১৫-২০ কেজির পাঙাশ। এটিকে বাড়তি আয় হিসেবে দেখছেন জেলেরা। আগামী এক সপ্তাহ এই ধরনের পাঙাশ ধরা পড়বে বলে জানান একাধিক জেলে।
নদী থেকে ইলিশ নিয়ে আসা জেলেরা বলেন, নদীতে তেমন ইলিশ নেই। তবে যা পাওয়া গেছে তা ছোট। আবার কিছু মাছ জালে উঠেছে, এক কেজি থেকে দুই কেজি। ধরা পড়া বড় ইলিশ এখনও ডিম ছাড়েনি। ডিম ছাড়লে নদীতে থাকতো না। ডিম ছাড়ার পরপরই ইলিশ সাগরে চলে যায়। তবে আরও কিছু দিন নিষেধাজ্ঞা থাকলে ইলিশ ডিম ছাড়তো।
স্থানীয় একটি ফিশিং বোটের জেলেরা জানিয়েছেন, ইলিশের জালে ধরা পড়ছে বড় বড় পাঙাশ। সোমবার রাত থেকে তিনবার জাল ফেলার সুযোগ পেয়েছেন। তাতে ১১টি বড় পাঙাশ উঠেছে। প্রতিটি ইলিশের জালে বড় পাঙাশ ধরা পড়েছে। প্রতিবছর এই সময়ে ইলিশের জালে পাঙাশ ধরা পড়ে। আগামী এক সপ্তাহ পাঙাশ পাওয়া যাবে। এরপর জালে উঠবে না। তবে মাঝে মধ্যে ১৫-২০ কেজি ওজনের পাঙাশ ধরা পড়ে।
এতে লাভ হয় তাদের। টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। একটি ফিশিং বোটে যা আয় হয়, অর্ধেক নেন বোট মালিক। বাকি টাকা ভাগ করে নেন জেলেরা। এ ছাড়া মালিকের কাছ থেকে দাদন নেওয়া থাকায় তাকেই মাছ দিতে হয়। সেক্ষেত্রে বাজার দরের চেয়ে কম পাওয়া যায়। কত কম তা আর বলতে চাননি জেলে সোলেমান ফকির ও তার সহকর্মীরা।
পোর্ট রোডের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিমণ পাঙাশ পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১৫-১৬ হাজার টাকা। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে। বড় পাঙাশের চাহিদা থাকায় ৪-৫ জন ক্রেতা একত্রিত হয়ে একটি মাছ কিনে ভাগ করে নেন। আজ ইলিশ মোকামে আসা পাঙাশের সর্বোচ্চ ওজন ছিল ২০ কেজি। সর্বনিম্ন ছিল ১০ কেজি। আজ আড়তে তিন শতাধিক পাঙাশ এসেছে বলে জানান মাছ ব্যবসায়ী মো. পারভেজ।
পোর্ট রোডের ইলিশের আড়তদার জহির সিকদার বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর বড়-ছোট প্রচুর ইলিশ এসেছে। বড় যেসব ইলিশ এসেছে তাতে ডিম হয়নি। ডিম ছাড়লে ইলিশ পাতলা হয়ে লম্বা আকৃতির দেখায়। সে ধরনের ইলিশের সংখ্যা কম। এ জন্য নিষেধাজ্ঞার সময়টা ঠিক ছিল না। মা ইলিশের ওপর জরিপ চালিয়ে সময়টা নির্ধারণ করলে ইলিশ উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। তবে ছোট সাইজের প্রচুর ইলিশ এসেছে।
ইতোমধ্যে আঞ্চলিক নদীগুলোতে ডিম ছেড়েছে ইলিশ। যা জাটকায় রূপ নেবে। জাটকা ঠিকমতো সংরক্ষণ করা গেলে বড় ইলিশ নদীতে মিলবে। নদী ও সাগরের ইলিশের স্বাদের ব্যবধান আছে। জাটকা নিধন বন্ধকালীন সংশ্লিষ্টরা কঠোরভাবে তা মনিটরিং করলে বড় ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যাবে। ফলে মাছের দামও কমে আসবে। তাতে সব শ্রেণির মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে ইলিশের দাম।
জহির সিকদার বলেন, আজ ইলিশ মোকামে পাঙাশ উঠেছে তিন শতাধিক। এসব পাঙাশ ইলিশের জালে উঠেছে। নদীর পাঙাশ আরও ৫-৬ দিন মিলবে।
পোর্ট রোড মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ায় সরকারকে ধন্যবাদ। একই সঙ্গে জাটকা সংরক্ষণে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানাই সংশ্লিষ্টদের। এতে বড় সাইজের ইলিশ উৎপাদন বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে ইলিশের কদর কম। অন্য মাছের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট থাকে। এ জন্য শীত মৌসুমে ইলিশ বিক্রি কম হয়। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে রফতানি উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
টুটুল বলেন, আজ মোকামে এক কেজি ২০০ গ্রাম সাইজের প্রতি মণ ইলিশ পাইকারি ৩৬ হাজার টাকা, কেজি সাইজের প্রতি মণ ৩৪ হাজার, এলসি সাইজ (৬০০-৯০০ গ্রাম) প্রতি মণ ৩০ হাজার, ৪০০ থেকে সাড়ে ৫০০ গ্রাম সাইজের (ভেলকা) প্রতি মণ ২৪ হাজার এবং গোটলা সাইজ (আড়াইশ থেকে সাড়ে ৩০০ গ্রাম) প্রতি মণ ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বরিশাল মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ইলিশ সারা বছরই ডিম দেয়। তবে পূর্ণিমায় অধিকাংশ ইলিশ ডিম দেওয়ায় ওই সময়টা মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এ জন্য ব্যাপক জরিপ চালানো হয়। জরিপের ভিত্তিতেই এই নিষেধাজ্ঞা। এতে আমরা সুফলও পাচ্ছি। প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। মঙ্গলবার পোর্ট রোড মোকামে ইলিশ এসেছে ২০ হাজার মণ। প্রতিদিন এর পরিমাণ বাড়বে।
মৎস্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদার বলেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে যে পরিমাণ ইলিশ ডিম ছেড়েছে তা সংরক্ষণ করা গেলে আমাদের টার্গেট পূরণ হবে। দেশে এ বছর ইলিশের টার্গেট ছয় লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে চার লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হবে বরিশাল বিভাগে।
তিনি আরও বলেন, জাটকা নিধন বন্ধ করতে হবে। এ জন্য কঠোর আইনও প্রয়োগ করা হবে। এটা ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারলে টার্গেটের বেশি ইলিশ আসার সম্ভাবনা থাকবে।