দেশে বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে লাগে পরামর্শক। এই পরামর্শকের সিংহভাগই হয় বিদেশি। প্রকল্পের প্রায় ১৬ আনা ব্যয়ও হয় তাদের পেছনেই। আমাদের দেশে কারিগরি প্রকল্পে বিদেশি অনুদান বেশি, বিনিয়োগ প্রকল্পে কম। উন্নয়ন সহযোগীরা স্বল্পব্যয়ের কারিগরি প্রকল্প থেকে সহজেই টাকা তুলে নিতে পারে। অনুদানের এসব টাকা কখনো পুরোটা, কখনো ৮০-৯০ শতাংশই চলে যায় বিদেশি পরামর্শকের পকেটে। এই টাকার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে বাংলাদেশ আর আগের অবস্থানে নেই উল্লেখ করে বিদেশি পরামর্শকের আধিপত্য ও আধিক্যের জায়গায় লাগাম টানতে কঠোর অবস্থানে সরকার।
পরিকল্পনা কমিশনে জমা পড়া কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বিশ্লেষণ করে দেখা যায় কখনো পুরোটা, কখনো অনুদানের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বিদেশি পরামর্শকের পকেটে। বাংলাদেশ অনুদাননির্ভরতা কমিয়ে নিয়ে আসতে কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেকটা কমেছে। এ বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের চাপ সৃষ্টিও করবে সরকার। এমনটাই জানান সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, ‘প্রিপারেশন অব কনসেপ্ট ডিজাইন অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টশন প্ল্যান ফর বাস রুট রেশনালাইজেশন অ্যান্ড কোম্পানি বেজড অপারেশন অব বাস সার্ভিস ইন ঢাকা’ প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৪ কোটি ৫০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। অথচ এর মধ্য থেকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) পরামর্শক খাতে মোট ১৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা পরামর্শকদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৭৮ শতাংশ। প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শক ৩৬ জন।
ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত রেলপথ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মূল প্রকল্পের আগে রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশদ ডিজাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই কাজে মোট ব্যয় হবে ৫৬ কোটি ৬১ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু পরামর্শকদের পকেটেই যাবে ৪১ কোটি ৬৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, দেশের স্থলবন্দরগুলোর সঙ্গে কানেকটিং সড়কগুলো উন্নয়নে ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফর রোড ট্রান্সপোর্ট কানেকটিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি-২’ প্রকল্পের আওতায় মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৬ কোটি ৭৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় শুধু পরামর্শক খাতে ১৫৯ কোটি ৬৩ লাখ ৫৬ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। প্রকল্পের মোট ব্যয় সরকারি তহবিল থেকে আসবে ৬৩ কোটি ৮০ লাখ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দেবে ১১৩ কোটি টাকা। অনুদানের সব টাকাই যাবে পরামর্শকের পেছনে।
এছাড়া ‘ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রেনদেনিং অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ফর রোড সেফটি অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অব রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট’ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রস্তাবিত প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৫ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রকল্পের সব টাকাই এডিবি এবং জাপান ফান্ড ফর প্রভার্টি রিডাকশনের অনুদান। প্রকল্পের আওতায় ২০০ জন পরামর্শকের জন্য মোট ব্যয় করা হবে ১৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্পের অনুদানের সব টাকাই যাচ্ছে পরামর্শকের পকেটে।
পরিকল্পনা কমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১২০টি। কারিগরি সহায়তা প্রকল্প মানেই অনুদাননির্ভরতা। অনুদানের প্রায় সব টাকাই চলে যাচ্ছে বৈদেশিক পরামর্শকের পেছনে। চলতি অর্থবছরে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৮৪০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন ৪৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এছাড়া এসব প্রকল্পে বৈদেশিক অনুদান ১ হাজার ৩৮৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। দেশীয় টাকা প্রকল্প অফিস পরিচালনাসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়। তবে অনুদানের ১ হাজার ৩৮৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকাই চলে যাবে পরামর্শকের পকেটে।
জানা যায়, অনুদানের প্রকল্প বেশি বাস্তবায়ন হচ্ছে সাধারণ সরকারি সেবা বিভাগে ২৭টি। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৯৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৩৬ কোটি ২৪ লাখ টাকাই ব্যয় হবে পরামর্শকের পেছনে। এরপরই পরিবহন ও যোগাযোগ বিভাগে ১৭টি অনুদানের প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪৪৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এসব টাকার মধ্যে ২৮৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকাই খরচ হবে পরামর্শকের জন্য। অনুদানের টাকায় সবচেয়ে কম প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিনোদন বিভাগে মোট একটি, এতে মোট ব্যয় ৮৮ লাখ টাকা। এর সব টাকাই যাবে পরামর্শকের পেছনে।
এছাড়া জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় ৩, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ১০, কৃষিতে ৭, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ৭, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৫, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদে ১০, গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলিতে ৫, স্বাস্থ্যে ১০, শিক্ষায় ৭, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ৪ ও সামাজিক সুরক্ষায় ৭টি প্রকল্প অনুদানের টাকায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের সিংহভাগই ব্যয় হবে পরামর্শক খাতে।
অনুদানের টাকা পরামর্শকদের পেছনে খরচের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, অনুদানের টাকায় আমাদের কোনো হাত থাকে না। অনুদানকারীরা যেভাবে বলে সেভাবেই হয়। অনুদানের টাকা মানেই পরামর্শকের জন্য। এসব প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শকই বেশি থাকে। দেশীয় পরামর্শক কেউ যদি থাকেন তবে তাদের পছন্দের লোক হন। অনুদান যারা দেন তারা যেভাবে বলেন সেভাবেই হয়। তবে এই প্রথা ভাঙা দরকার। অনুদান যে দেবে তার মনগড়া পরামর্শক হবে, এটা হতে পারে না। এটা নিয়ে অনেক কথা বলার আছে কিন্তু নানা কারণে আমরা বলতে পারি না।
অর্থনীতিবিদরা জানান, নানা কারণে অনুদানের টাকা পরামর্শকের পকেটে যাচ্ছে। সরকার কারিগরি প্রকল্পে ঋণ নিতে চায় না। এছাড়া যারা অনুদান দিচ্ছেন তারা পরামর্শকের মাধ্যমে টাকা তুলে নিতে পারছেন। বিনিয়োগ প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি। ফলে বিনিয়োগ প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীরা অনুদান দেয় না। উন্নয়ন সহযোগীরা সেতু নির্মাণে টাকা দেয় না। অথচ সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা তৈরির জন্য অনুদান দেয়। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এটা ঠিক অনুদানের টাকায় বাস্তবায়িত প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য বেশি ব্যয় হয়। কারিগরি প্রকল্পে পরামর্শক বেশি থাকে।
কারিগরি প্রকল্পে অনুদান প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নানা কারণে কারিগরি প্রকল্পে পরামর্শক বেশি থাকে। অনুদানের টাকা বলেই বিদেশি পরামর্শকের বিষয়ে সরকার তেমন কিছু ধরে না। তবে আমাদের দেখতে হবে যাদের পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা সঠিক কি না।
যেভাবে কারিগরি প্রকল্পে অনুদান আসে, বিনিয়োগ প্রকল্পে সেভাবে আসে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে জাহিদ হোসেন বলেন, কারিগরি প্রকল্পের ব্যয় কম হয়। কোনো প্রকল্পের প্রতিবেদন তৈরি করেই টাকা তুলে নিতে পারে উন্নয়ন সহযোগীরা। বিনিয়োগ প্রকল্পের ব্যয় বেশি বলে এসব প্রকল্পে অনুদান দেয় না। আসলে নিজেদের স্বার্থ ছাড়া ঋণ-অনুদান কেউ দেবে না।
কমছে বৈদেশিক অনুদান
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায় অর্থাৎ ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে অনুদান ছিল সর্বোচ্চ ৮৬ শতাংশ, ঋণ ছিল ৬ থেকে ৮ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অনুদান ছিল ৩০ শতাংশের মতো, ৭০ শতাংশের মতো ঋণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অনুদান ছিল সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের মতো, আর ৯৫ শতাংশই ছিল ঋণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদান আরও কমেছে, যা ২-৩ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। ৯৭ শতাংশই আসছে ঋণ হিসেবে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা ছাড় হয়েছিল ৭৪৮ মিলিয়ন ডলার, তখন জিডিপির ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল ঋণের পরিমাণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা ছিল সাত হাজার ১২১ মিলিয়ন ডলার, তা ছিল জিডিপির ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ আর দানের ওপর নির্ভর নয়। দেশ নিজস্ব দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। ফলে কমিয়ে আনা হচ্ছে বৈদেশিক অনুদান। অনেক প্রকল্পে বৈদেশিক পরামর্শক নিয়োগের লাগাম টেনে ধরতে কাজ করছে সরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব জাগো নিউজকে বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে বৈদেশিক অনুদান কমে আসছে। তবে দেখা যাচ্ছে বৈদেশিক অনুদান মানেই বিদেশি পরামর্শকের পকেটে যাচ্ছে টাকা। সরকার এটার লাগাম টেনে ধরার পরিকল্পনা করছে। সরকার চাচ্ছে অনুদানের প্রকল্পে বৈদেশিক পরামর্শকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে। এই মানের পরামর্শক দেশেও আছেন। বৈদেশিক পরামর্শক কমিয়ে আনা হলেও অনেক দেশীয় দক্ষ মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। আমরা ঢালাওভাবে যারা অনুদান দেয় তাদের মতো চলবো না।
বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), চীন, ভারত, এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), কোরীয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (কোইকা), পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারী দেশগুলোর সংস্থা (ওপেক), জার্মান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (জিআইজেড), ইউরোপীয় ইউনিয়ন জার্মানির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উন্নয়ন ব্যাংক (কেএফডব্লিউ), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক (কেএফডব্লিউ) রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।