বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল এখন অনিয়ম দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিণত হয়েছে। এমডির নানা দুর্বলতার সুয়োগ নিয়ে কোম্পানীর জিএম মো: আসলাম সর্বত্র তার কালোথাবা বিস্তার করেছেন। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় একডজন গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি প্রায় ১০ বছর প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন মর্মে জানাগেছে। সুত্রমতে তিনি কোম্পানীর প্রকিউরমেন্ট বিভাগের দায়িত্বে থাকায় একটি ঠিকাদার সিন্ডিকেট গঠন করে বিটিসিএল’র নানা প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা সুকৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন। অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সাইড লাইনে রেখে অদক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপুর্ণ পদে বসিয়ে তিনি নজের আধিপত্য কায়েম করেছেন।
তিনি নানা কৌশলে পকেটের লোক দ্বারা ঠিকাদারী করিয়ে বিটিসিএল থেকে প্রায় ৫ শত কোটি টাকা অবৈধপথে অর্জন করে বিদেশে পাচার করেছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান এমডি তার পদ রক্ষার্থে সব সময় মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকায় জিএম মো: আসলাম সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। তার কথামতই চলছে কোম্পানীর সামগ্রীক কার্যক্রম। নিয়োগ,বদলী,কেনাকাটা সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। এককথায় তার গ্রাসে চলেগেছে সরকারী প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল। খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে, জিএম আসলাম ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো তুলে দিচ্ছেন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের হাতে। বিনিময়ে তিনি হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এ ছাড়া তার পছন্দের কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ যাতে ঠিকাদারী কাজ না পায়, সেভাবে প্রকল্পের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়। এভাবে বিটিসিএল এ চলছে দুর্নীতি-লুটপাটের মহোৎসব। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে বিদেশে টাকা পাচারের গোপন কারবার।
ক্ষমতার শীর্ষ পদে বসে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা একাধিক বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা নিচ্ছেন। ফলে সরকারি কোম্পানিগুলো এখন খাদের কিনারে গিয়ে ঠেকেছে। এহেন গর্হিত কাজ করে প্রকারান্তরে নিজেদের গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতি-লুটপাট আর ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সরকারি ফোন কোম্পানি টেলিটকের এখন গ্রাহক নেই বললেই চলে। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই কোম্পানি। জানা গেছে, বিটিসিএলের জিএম মো: আসলাম হাওয়া ভবনের প্রভাবশালী এক নেতার প্রয়াত ছোট ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ওই ছোট ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বিটিসিএলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। সে সময় বিটিসিএলে গডফাদার হিসেবে তাকে আগলে রেখেছিলেন সে সময়ের অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের জনক মোহাম্মদ তৌফিক। বর্তমানে এই তৌফিক দেশের বাইরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। এই গডফাদারের সিন্ডিকেট সে আমলে শুধু অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে এই খাত থেকে হাতিয়ে নেয় কয়েকশ’ কোটি টাকা। হাওয়া ভবনের শেল্টার থাকায় এদের বিরুদ্ধে ওই সময় কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেনি।
অভিযোগ উঠেছে, ভিওআইপি তৌফিকের ডানহাত হিসেবে পরিচিত এই কর্মকর্তাই এখন বিটিসিএলের জিএম পদে। সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের জার্সি পরে তদবিরের মাধ্যমে বিটিসিএলের জিএম পদ বাগিয়ে নেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিটিসিএলের গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্য অনেক সিনিয়র ও দক্ষ কর্মকর্তা থাকলেও তাদের ডিঙিয়ে তিনি নিয়োগ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। এ কাজে তাকে সহায়তা করে অবৈধ ভিওআইপি গডফাদার ও তার নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি। নিয়োগ পেয়েই তিনি পুরো বিটিসিএলে প্রভাব বলয় তৈরি করেন। প্রতিটি বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় নিয়ে আসেন তার সিন্ডিকেট সদস্যদের।
যার কারণে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা এখন কাজবিহীন পদে অলস সময় কাটাচ্ছেন। যেসব বিভাগের সঙ্গে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তার সব পদেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে ওই শীর্ষ কর্মকর্তার সিন্ডিকেট সদস্যদের। যার কারণে বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কল কমে এখন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক কলের বেশিরভাগই এখন অবৈধ পথে ভিওআইপির মাধ্যমে আসা-যাওয়া করছে। আর এ খাতের আয় পুরোটাই এখন চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে। দেশের বাইরে বসে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন সেই গডফাদার তৌফিক। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটিসিএলের বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে এই জিএম আসলামের পছন্দের কোম্পানিগুলো। কারণ, হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রকল্পগুলোর দরপত্রের স্পেসিফিকেশন এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে তার পছন্দের কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ কাজ না পায়। কিছু কিছু প্রকল্পের শর্ত সেভাবেই করা হয়েছে। এভাবে টেন্ডার স্পেসিফিকেশন তৈরিতে সহায়তা করছেন জিএম মো: আসলাম ।
যিনি বিটিসিএলের প্রকিউরমেন্ট বিভাগে কাজ করছেন। ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমের (ডট) একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেট দেশীয় একটি কোম্পানিকে ৯৪ কোটি টাকার কাজ দিয়েছে ডিরেক্ট পার্সেজ মেথডের (ডিপিএম) মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় আরও ১০০ কোটি টাকার কাজ দেয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রাইমারি শিক্ষায় ট্যাব দেয়ার নামেও ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে একটি দেশীয় কোম্পানির যোগসাজশে। টেলিটক থেকে লিথিয়াম ব্যাটারি সরবরাহের কাজটিও একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করানো হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, টেলিটকের এক শীর্ষ কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় বুস্টার নামে সাবেক এক ছাত্রদল ক্যাডারের মাধ্যমে পুরো টেলিটকে দখলের রামরাজত্ব কায়েম করা হয়েছে।
এদিকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার এসব আন্ডারগ্রাউন্ড সম্রাটের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ৯টি দেশের গোয়েন্দারা। এ ছাড়া কানাডার অ্যান্টিফ্রড ডিপার্টমেন্ট, মনিটরিং অথরিটি অব সিঙ্গাপুর, ইন্টারন্যাশনাল রেভিনিউ সার্ভিসেস (আইআরএস), অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথরিটি অব কানাডা (একরা)। নেপাল সরকারি টেলিকম এসব ভিওআইপি ও সাইবার গডফাদারের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে। ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, নেপাল, কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্তত ডজন খানেক দেশের টেলিকম কেলেঙ্কারিতে এদের কয়েকজনের নামও রয়েছে।
অভিযোগ আছে, গত ১০ বছরে জিএম আসলাম সিন্ডিকেট ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি কল টার্মিনেশন-অরিজিনেশন ও অবৈধ টেলিকম বাণিজ্য করেছে। এই সিন্ডিকেট প্রতারণার মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে সিংটেলের মাধ্যমে আইপিএলসি (ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিজ লাইন) এনে কল টার্মিনেশনের পাশাপাশি অন্য টেলিকম কোম্পানি ও আইএসপি কোম্পানিগুলোর কাছে কোটি কোটি টাকার ব্যান্ডউইথ বিক্রি করত। সরবরাহ করত ভিওআইপি ইকুইপমেন্ট সেঙ্গোমা পিসি ও সিগনাল লজিক ও সুপার মাইক্রো সার্ভিস সিস্টেম। কম্পিউটার আইটেমের নামে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এবং বিটিসিএলের ইকুইপমেন্ট দেখিয়ে তারা এসব অবৈধ কল টার্মিনেশনের যন্ত্রপাতি আমদানি করত।
বেআইনি ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে বিটিসিএল মগবাজার শাখার অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, জিএম মো: আসলামকে বেশির ভাগ সময়েই বিটিসিএল এর শেরে বাংলা নগরের প্রধান কার্যালয়ে পাওয়া যায় না। তিনি প্রায় সময়েই মন্ত্রণালয়ে তদবীরে ব্যস্ত থাকেন । কোন কোন সময় প্রধান কার্যালয়ে থাকলেও তিনি রাজনৈতিক নেতাদের মত তার সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে মিটিং অথবা খোশগল্পে মত্ত থাকেন। তিনি এতটাই শক্তিশালী যে বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির খবর ছাপা হলেও মন্ত্রী ,সচিব বা এমডি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোন তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন না। ফলে তিনি দিনদিন মহীরুহ রুপ ধারণ করেছেন।
বিটিসিএল এর প্রকিউরমেন্ট বিভাগের ফাইলপত্র নিখুঁতভাবে নীরিক্ষা করলেই শত শত কোট টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়বে মর্মে জোর দাবী তোলা হয়েছে। এ বিষয়ে জিএম মো: আসলামের সাথে সরাসরি কথা বললে তিনি জানান, এসব অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। তার এই পদে আসার জন্য কেউ হয়তো এরকম মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে। বিটিসিএল এর দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা জিএম মো: আসলামের গ্রাস থেকে এই প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করার জন্য অতিসত্তর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে মন্ত্রী, সচিব ও কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদক্ষেপ কামনা করেছেন। একই সাথে তার অনিয়ম-দুর্নীতি , বিদেশে টাকা পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করার দাবী তুলেছেন।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল বাংলাদেশের সরকারি টেলিফোন সংস্থা ও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) হিসেবে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। জুলাই ১, ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয় এবং বিটিসিএল হিসেবে নামকরণ করা হয়। বিটিসিএল এর মোট কর্মকর্তা ও কর্মচারী সংখ্যা ১২,৬৩৬ জন। বিটিসিএল বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ল্যান্ড-লাইন টেলিফোন পরিষেবাগুলি সরবরাহ করে, যার মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে দূর-দূরান্তে এবং আন্তর্জাতিক কলিং পরিষেবার পাশাপাশি ইন্টারনেট পরিষেবা রয়েছে।