কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছচোরদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন খোদ ডিএফও এবং এসিএফ।তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় বেপরোয়া এখন গাছ চোরচক্র। এমন অভিযোগ কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সরকার ও এসিএফ প্রান্তোষ চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে। নিত্যনতুন পদ্ধতিতে বনের জমি জবর দখল হচ্ছে।কোথাও কোথাও বনভূমি কেটে সমতল করে পাকা দালান থেকে শুরু করে পোলট্রি ফার্ম ও নানা স্হাপনাসহ বনভূমির প্রায় সিংহ ভাগ জায়গায় দখলবাজরা নিয়মিত পাহাড় কেটে পাকা ঘর নির্মাণ ও পাহাড়ি মাটি অবৈধভাবে বিক্রি করছে।
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও এসিএফকে মাসোহারা দিয়ে ভূমিদস্যুরা নির্বিচারে ধ্বংস করছে বনভূমি। রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তাদের দিয়ে এই মাসোহারা নিচ্ছে বলে নির্ভর যোগ্য সুত্রে জানা গেছে। ফুলছড়ি রেঞ্জের পাহাড়ি খুটাখালী খাল, মধুর শিয়া,হরিণা ঝিরি,তাজ্জুক কাটায় বনবিভাগকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করে চিহ্নিত ভূমিদস্যুর একটি সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। চকরিয়া নলবিলা চেকপোস্টে পেরিয়ে প্রতিদিন অবাধে পাচার হচ্ছে বনের গাছ, ফার্নিচার ও চিরাই কাঠ। এ নিয়ে কোন ভূমিকা নেই বনবিভাগের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন মাসোহারা পেয়ে নিরব রয়েছে বনবিভাগ। এতে জড়িত রয়েছেন খোদ নলবিলা নলবিলা বিট কাম চেক ষ্টেশন কর্মকর্তা অবনি কুমার রায়। মাসোহারা গুলো ডিএফও এবং এসিএফর পকেটে যায় বলে জানা গেছে। অবশ্যই তিনি দাবী করেছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তার বেঁধে দেওয়া মাসিক চাঁদা জোগান দিতেই যত সব অনিয়ম করা হচ্ছে। জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়া খালী রেঞ্জের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চকরিয়া নলবিলা বনবিট কাম চেক স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন অবাধে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সরকারি কাঠ।
নলবিলা বনবিট কাম চেক স্টেশনে অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রতিরাতেই পাচার হচ্ছে কাঠ। কাঠ পাচারে দৈনিক এক থেকে দেড় লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। অভিযোগ আছে মাসোহারা পেয়ে চুপ থাকছে বনবিভাগ। এতে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিশাল বনভূমি দিনে দিনে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষটদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বনবিভাগ এবং স্থানীয় কাঠচোর সিন্ডিকেটের দ্বিপক্ষীয় যোগসাজশে ব্যাপক পরিমাণ কাঠ পাচার হয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহা সড়কের নলবিলা চেক স্টেশন দিয়ে। ফলে অবাধে বৃক্ষ নিধনে পরিবেশের ভারসাম্য নিয়েও শংকা দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলগুলোতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অন্যতম প্রধান ধরন হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হতে অবৈধভাবে কাঠ সংগ্রহ ও পাচার। এর ফলে বনাঞ্চল একদিকে যেমন বন উজাড় হচ্ছে, তেমনি সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কক্সবাজারের বনাঞ্চলগুলো কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বিরান ভুমিতে পরিণত করেছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এদিকে, আজিজ নগর, আধুনগর, চুনতি, হারবাং, ফাইতং থেকে কাঠ চকরিয়া ডুকে নলবিলা চেক অতিক্রম করে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, পদুয়া, সাতকানিয়া, কেরানী হাট আধুনগর থেকে চোরাই কাঠ, ফার্নিচার ও চিরাই কাঠ ভর্তি কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাচ্ছে নলবিলা চেক স্টেশন পেরিয়ে।
মাঝে মধ্যে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগের বনকর্মীরা অভিযান চালিয়ে চোরাই কাঠ ভর্তি ট্রাক, পিকআপ আটক করলেও সিংহভাগ কাঠ আত্মসাত ও মোটা অংকের টাকা বিনিময়ে পরে আটক গাড়ী ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। নলবিলা চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিনই ভ্যানগাড়ি পিকআপ, ট্রাক এমনকি যাত্রীবাহী বাসে বহন করেও হাজার হাজার টাকার মূল্যবান সেগুন কাঠ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি ছাড়া চেকপোস্ট অতিক্রম করতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে তাদের নির্ধারিত উৎকোচ না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঠবাহী গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে। পরে স্টেশন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাহিদা মাফিক টাকা দিয়ে স্টেশন অতিক্রম করতে হয়। প্রতিদিন নলবিলা চেক পোস্টর বন কর্মচারীরা এভাবেই লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে।
আবার সন্ধ্যার পর যেসব অবৈধ সেগুন কাঠভর্তি ট্রাক আসে সেগুলোর চাঁদার অংক দ্বিগুণ। এসব গাড়িকে নলবিলা চেকপোস্ট অতিক্রম করতে ডিউটিরত বন কর্মকর্তাদের বাণিজ্য চুক্তির গাছ ভর্তি প্রতি ট্রাক ১ হাজার টাকা, লামা আলী কদমের টিপির কাঠ ভর্তি প্রতি ট্রাক থেকে ৪০০০ টাকা, কক্সবাজার জেলা থেকে টিপির কাঠ ভর্তি প্রতি গাড়ী থেকে ৩০০০ টাকা। চলাচল পাস টিপি চেকিং এর নামে সম্পূর্ণ অবৈধ ভাবে টাকাগুলো আদায় করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে টিপির বাইরে অতিরিক্ত অবৈধ কাঠ পাচারও হচ্ছে।
এভাবে দৈনিক ১-২ লাখ টাকার মতো চাঁদাবাজি হচ্ছে নলবিলা বিট কাম চেক স্টেশনে। অথচ অবৈধ কাঠ পাচার রোধে নলবিলা চেক স্টেশন বসানো হলেও চেক স্টেশন পাচার রোধের পরিবর্তে কাঠ পাচারের সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের নলবিলা বিটের বনাঞ্চল, ফাসিয়াখালী ও ফুলছড়ি রেঞ্জের বিভিন্ন বনবিটের আওতাধীন এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে পাচারকারীরা সেগুন, চাপালিশ, গামারি, কড়ই, গর্জন, আকাশমনি, জামগাছসহ নানা প্রজাতির ছোট-বড় গাছ কেটে সরকারি বাগান সংলগ্ন নিরাপদ জায়গায় স্তুপ করে রাখে।
সন্ধ্যা হওয়ার পর এসব কাঠ গাড়িভর্তি করে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে রাতভর পাচার করে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন ইটভাটা ও স’মিলে। অন্যদিকে, রাত ১০টা পেরুলেই শুরু হয় ট্রাকভর্তি কাঠ পাচারের প্রতিযোগিতা। এ সময় নলবিলা চেক স্টেশনের সামনে কাঠভর্তি গাড়ীর দীর্ঘ লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে থাকে। আর চেকের নামে চলে চাঁদাবাজি। আবার চেক পোস্টের চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত থাকে চেক স্টেশনে নিজস্ব একটি আদায়কারী সিন্ডিকেট। এ বিষয়ে চাঁদা আদায়কারী সিন্ডিকেটের সদস্যদের নিকট জানতে চাইলে তারা কোন ধরণের তথ্য দিতে চায়নি।
কয়েকজন কাঠ ব্যবসায়ী জানান, ট্রান্সপোর্ট পারমিশন বা টিপি থাকার পরও সড়কপথে পার্বত্য বান্দরবানের লামা- আলী কদম, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন বিটের নিলামে কেনা গাছ ও মিয়ানমার থেকে বাণিজ্য চুক্তির গাছ ভর্তি ট্রাক নিয়ে আসতে হলে চকরিয়া নলবিলা চেকপোস্টে কর্মকর্তাদেরকে নির্ধারিত হারে গাড়ি প্রতি চাঁদা দিতে হয়।
কাঠ ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ‘বনবিভাগকে চাঁদা দেবার বিয়য়টি অনেক পুরনো ব্যাপার। যারা বৈধভাবে গাছ নিয়ে আসছে তাদেরকে তারপরও কিছু করে দিতে হয়। আবার যারা অবৈধভাবে নিয়ে আসছেন তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে শুরু করে যত পারে তত টাকাই নিয়ে থাকে বন কর্মকর্তারা। কোনো কোনো সময় চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না পেলে গাড়িগুলো আটক করে রাখা হয়। ট্রাকচালক আবুল মিয়া বলেন, কাঠবাহী গাড়ী নলবিলা চেক স্টেশন অতিক্রিম করার সময় উক্ত স্টেশনে কাঠের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সর্বনিম্ন ১০০০ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা দিতে হয়।
ঈদগড়ের সামাজিক বনায়নের গাছ গুলো নির্বিচারে কেটে ভোমরিয়াঘোনা হয়ে কক্সবাজারে বিভিন্ন ফার্নিচারের দোকানে পাচার করছে। রাতের আধারে এসব কাঠ গুলো পাচার করছে খোদ কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের এসিএফ প্রান্তোষ রায়। এসিএফ এবং ডিএফও নির্দেশে বন নিধন চলছে বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে দূর্ণীতিতে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ভারপ্রাপ্ত ডিএফও ও এসিএফ কে অবিলম্বে অপসারন করা প্রয়োজন বলে বন বিশেষজ্ঞগন মনে করেন।