শুরুটা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সেই থেকে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের সাথে সরব হয়ে ওঠে রমনার বটমূল। প্রভাতী আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষবরণের সকাল শুরু করে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে রাজধানীর মানুষের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে এই অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ।
১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিবছরই এই পরিবেশনা চলেছে। তবে ব্যতিক্রম ঘটে গতবছর। করোনা মহামারির কারণে সীমিত পরিসরে বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয় অন্যান্য বছরের অনুষ্ঠানগুলোর রেকর্ডের ভিত্তিতে। একই অবস্থা এবছর। করোনার কারণে চলমান লকডাউনে ঐতিহ্যবাহী এ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে বর্ষবরণের আয়োজন সম্পন্ন করতে হয়েছে অনলাইনে।
বুধবার সকালে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল এবং বিটিভিতে এই আয়োজনটি সম্প্রচার করা হয়।
পুরনো ও নতুন পরিবেশনের মিশ্রণে বাংলা বর্ষবরণের প্রতীকী, সংক্ষেপ ও ডিজিটাল আয়োজনটি সাজানো হয়। বিশেষ করে মানুষের মঙ্গল কামনা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে উজ্জীবনী গান, বাণী ও কথন দিয়ে সাজানো ছিল অনুষ্ঠান।
শুরুতেই রাগালাপে সরোদবাদন করেন ইউসুফ আলী খান। এরপর ‘পূর্বগগনভাগে দীপ্ত হইল সুপ্রভাত’ সম্মিলিতভাবে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে ছায়ানটের বড়দের দল। ‘অন্ধকারের উৎস হতে’ একক রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন আব্দুল ওয়াদুদ। ‘আমি ভয় করব না’, রীবন্দ্রনাথের এই গানটি এককভাবে গেয়ে শোনান সেঁজুতি বড়ুয়া। ‘এলো এলো রে বৈশাখী ঝড়’ সম্মেলক নজরুল গীতি উপস্থাপন করে ছায়ানটের ছোটদের দল।
নজরুলের ‘গগনে প্রলয় মেঘের মেলা’ একক সংগীত পরিবেশন করেন খায়রুল আনাম শাকিল। আয়োজনে ফারহানা আক্তার শ্যার্লি, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, রেজাউল করিম এবং আবুল কালাম আজাদসহ ছায়ানটের শিল্পীরা বিভিন্ন পরিবেশনা উপস্থাপন করেন। সবশেষে কথন পর্বে অংশ নেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন।
সন্জীদা বলেন, এ বছর আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষ পূর্ণ করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, নববর্ষের প্রথম প্রভাতে আপনারা ছায়ানটের প্রীতি ও ভালোবাসা গ্রহণ করুন। ১৯৬৭ সাল থেকে নগরজীবনে নববর্ষকে আবাহন জানানোর জন্য ছায়ানট রমনার বটমূলে যে সুর ও বাণীর আয়োজন করে আসছে তাতে প্রথম ছেদ পড়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে, আর গত বছর মহামারির কারণে।’
ছায়ানট সভাপতি বলেন, ‘সংক্রমণের প্রকোপে এবছরেও তা আয়োজিত হচ্ছে অনলাইনে, অর্থাৎ সীমিত পরিসরে। উৎসবের আমেজ নেই; স্বজন হারানোর বেদনা আর সংক্রমণের শঙ্কা আজ সর্বজনের অন্তরে। তবে, পহেলা বৈশাখ বাঙালি জীবনে নিছক নববর্ষ উদযাপন নয়। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বাঙালি যে পথপরিক্রমায় অংশ নিয়েছে, সে পথ মসৃণ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, নববর্ষের আয়োজন সর্বধর্মের বাঙালিকে ঐক্যসূত্রে যুক্ত করে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’
সন্জীদা আরো বলেন, লাখ প্রাণের আত্মদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সংস্কৃতির যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন হয়েছে। অর্ধশতবর্ষ পরে ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে ওঠা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ঈর্ষণীয় সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি আমাদের আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু ধর্মের মর্মবাণীকে উপেক্ষা করে নতুন অবয়বে উত্থিত ধর্মবিদ্বেষ সম্প্রীতির সমাজকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। লোভের বিস্তার বৈষম্য সৃষ্টি করছে। খণ্ডবিচ্ছিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে সামাজিক অবক্ষয়ের। দেশের অগ্রযাত্রাকে অক্ষুণ্ণ রেখে নেতিবাচক প্রবণতাকে রোধ করবার জন্যে অতীতের মতো বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার প্রসার, মানবিক সমাজ গঠনের এক অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে। আমরা আশা করছি অন্ধকারের উৎস থেকে আলো উৎসারিত হবে। নতুন বছর বয়ে আনবে সর্বজনের জন্য মঙ্গলবার্তা। আলো আসবেই।’
সবশেষে ছায়ানট শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শেষ করা হয় অনুষ্ঠান। সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেল (https://youtu.be/drDGKeM9cgM) থেকে।