পল্লবীতে আলীনগর হাউজিং প্রকল্পে জমি না দেওয়ায় শাহিন উদ্দিনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করার পর সন্ত্রাসী সুমন সাবেক এমপি এম এ আউয়ালকে ফোন করে জানান, ‘স্যার, ফিনিশ’। এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর এম এ আউয়ালকে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি দরগা শরিফ থেকে র্যাব গ্রেফতার করে।
র্যাবের দাবি, শাহিন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক এই এমপি। হত্যার আগে তার কলাবাগানের অফিসে পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা বৈঠকে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া তিন সন্ত্রাসী উপস্থিত ছিলেন। এর আগে র্যাব চাঁদপুরে অভিযান চালিয়ে হাসান (১৯) ও পটুয়াখালী থেকে জহিরুল ইসলাম বাবুকে (২৭) গ্রেফতার করে।
অপরদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে এই ঘটনায় কিলার গ্রুপের প্রধান নেতা সুমন ও রকি তালুকদারকে বুধবার রাতে গ্রেফতার করে। এর আগে এই হত্যাকাণ্ডে পল্লবী থানা পুলিশ মনিরকে গ্রেফতার করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। গতকাল বৃহস্পতিবার কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন কিলিং মিশনের যাবতীয় তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘আলীনগর হাউজিং প্রকল্পে জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে শাহিন উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এক বিঘার বেশি পরিমাণ জমি কেনার চেষ্টা করছিল সাবেক এমপি আউয়ালের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হ্যাভিলি প্রপার্টি। নিহত শাহিন ও তার স্বজনরা ঐ জমির মালিক। কম টাকায় জমি কিনতে না পারার কারণে এই হত্যার ঘটনা ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে শাহিনকে তারা টার্গেট করে আসছিল। দুই মাস আগেও আউয়ালের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা শাহিনের ওপর হামলা করেছিল। ঐ সময় তার মাথায় কোপ দেওয়া হয়। এমনকি কোপানোর পরও উলটা শাহিনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে জেলে পাঠায় আউয়াল বাহিনী। গত ঈদের কয়েক দিন আগে শাহিন ঐ মামলায় জেল থেকে জামিনে বের হন। আর ঈদের দুই দিন পরই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।’
কমান্ডার মঈন বলেন, ‘১৬ মে দুপুরে নিজ সন্তানের সামনে শাহিন উদ্দিনকে চাপাতি, রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ১৯ মে চাঁদপুর থেকে হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। ২০ মে রাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী এম এ আউয়ালকে ভৈরবে তার একটি দরগা শরিফ থেকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া পটুয়াখালীর বাউফল থেকে ১৯ নম্বর আসামি জহিরুল ইসলাম বাবুকে গ্রেফতার করে র্যাবের আরেকটি দল। তারা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।’
কমান্ডার মঈন জানান, এই ঘটনার চার-পাঁচ দিন আগে এম এ আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে মোহাম্মদ তাহের ও সুমন এই হত্যার পরিকল্পনা করে। মাঠ পর্যায়ে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুমনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর সুমন সক্রিয়ভাবে কিলিং মিশনে অংশ নেয়। এ সময় বেশ কয়েক জন কিলিং মিশনে জড়িত ছিল।
র্যাব জানায়, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, সুমন ও বাবুসহ কয়েক জন একটা মিটিং করে। এরপর ঘটনার দিন তারা মীমাংসার অজুহাতে শাহিন উদ্দিনকে ঘটনাস্থলে ডেকে পাঠায়। এ সময় শাহিন তার সাত বছরের শিশুসন্তান মাশরাফিকে নিয়ে সেখানে যায়। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগেই থেকে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসী সুমন, মানিক, হাসান, ইকবালসহ ১০-১২ জন শাহিনকে তার ছেলের সামনে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। প্রথম ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুমন কোপটি দেয়। এরপর মানিকসহ বাকিরা কোপাতে থাকে। মনির হাঁটুতে এবং মানিক উপর্যুপরি শাহিনের পুরো শরীর এবং গলায় কুপিয়ে জখম করতে থাকে। এ সময় বাবুসহ কয়েক জন বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে পাহারা দিতে থাকে। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে পুরো কিলিং মিশনটি শেষ করে। ঘটনা শেষে সুমনসহ বাকিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এ সময় সুমন এক নম্বর আসামি আউয়ালকে মোবাইল ফোনে জানায়, স্যার, ফিনিশ।’
গ্রেফতার প্রধান আসামি এম এ আউয়াল একজন জমি ব্যবসায়ী। তার ছত্রছায়ায় সুমন জমি দখল, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও এলাকায় প্রভাব বিস্তার করত এবং প্রতিমাসে ১০-১২ হাজার টাকা নিতো। তাছাড়া বিভিন্ন কাজেও সে টাকা নিতো। এই সন্ত্রাসী দল রিকশার টোকেন বাণিজ্য, মাদক, জুয়াসহ অন্যান্য অপরাধ কার্যক্রমে জড়িত।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব পরিচালক বলেন, ‘দুই মাসে এই সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মাদক মামলাও রয়েছে।’
গ্রেফতার আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের হয়ে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্য ছিলেন। ভৈরবে তার একটি পিরের আস্তানা রয়েছে। আউয়াল পল্লবীর আলীনগর প্রকল্প এলাকায় জমি দখল করে একটি হাউজিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। একটি জায়গা দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে তিনি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের জমি দিতেই আরেক জনের জায়গা জোর করে সন্ত্রাসী দিয়ে দখলের চেষ্টা করেন তিনি। আর এরই জের ধরে শাহিনকে হত্যার পরিকল্পনা করে বলে র্যাব জানায়।