টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে উপকূলীয় জনপদের জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ায় এবং করোনাভাইরাসের প্রভাবে উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলের বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় দেশের এ দুটি অঞ্চলের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। স্কুলবিমুখ হয়ে পড়ছে সেখানকার অগণিত শিশু-কিশোর। এর নেতিবাচক প্রভাবে বাড়ছে বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম। একই সঙ্গে অনেক ছেলেমেয়ে বিপথগামীও হয়ে পড়ছে। উপকূল ও চরাঞ্চলের বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেড়িবাঁধ ভেঙে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ায় সেখানকার জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের সর্বদক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর লাগোয়া অঞ্চলগুলোর অবস্থা সবচেয়ে করুণ। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও পরবর্তী সময়ে আইলার ধ্বংসলীলার জের এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওইসব এলাকার মানুষ। এর মধ্যে সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর, খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা এবং বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। ভুক্তভোগীরা জানান, সিডর ও আইলার পর সর্বশেষ ‘ইয়াস’ ছাড়াও ইতোমধ্যে ফনীসহ পর্যায়ক্রমে আরো কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেখানে হানা দিয়েছে।
তাঁদের অভিযোগ, উপকূল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি বাঁধগুলো খুব দুর্বল এবং প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চতাও কম। এর ফলে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারে নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলেই বেড়িবাঁধ ভেঙে বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে এবং বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়; আবাদি জমি জলমগ্ন হয়ে ধ্বংস হয় বিভিন্ন ধরনের ফসল। এছাড়া গত কয়েক বছরে সেখানকার বহু বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ও ধর্মীয় উপাসনালয় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সর্বস্বহারা আশ্রয়হীন মানুষগুলো কর্ম হারিয়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
এ কারণে তাদের ছেলেমেয়েরা আর স্কুলে যেতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অনেকেই শিশুকন্যাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। সাতক্ষীরার বিশিষ্ট রাজনীতিক ও শিক্ষাবিদ এবং স্থানীয় দৈনিক ‘দক্ষিণের মশাল’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী বলেন, উপকূলবাসীর প্রধান সমস্যা টেকসই বাঁধের অভাব এবং উপকূলবাসীর একটাই দাবি- টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাগরিক আন্দোলনের এই নেতা বলেন, বারবার বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় মানুষ সহায়সম্বল হারিয়ে বাঁচার জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অগণিত শিশু-কিশোরের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হচ্ছে এবং শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বাড়ছে। এতে একটি প্রজন্ম ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে। অথচ সমস্যা সমাধানে সরকারের সময়োচিত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শুধু প্রতিশ্রুতি না দিয়ে উপকূলীয় জনপদ এবং ভুক্তভোগী মানুষকে বাঁচাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী।
অন্যদিকে দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উত্তরবঙ্গের দারিদ্রপীড়িত চরাঞ্চলে। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার অবস্থা বেশি শোচনীয়। সেখানকার অগণিত মানুষ কর্ম হারিয়ে চরম অভাবগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। এ কারণে অনেক শিশুর দিন কাটছে বাবা-মায়ের সঙ্গে ক্ষেত-খামারে কাজ করে অথবা বিভিন্ন চরে ছাগল চরিয়ে। পড়াশোনা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। যে কারণে তারা স্কুলবিমুখ হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, করোনার দীর্ঘ ছুটিতে শুধু কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার মূল ভূখণ্ডের বাইরে দুর্গম চরগুলোতে অবস্থিত প্রায় পাঁচশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর অবস্থা এখন কম-বেশি একইরকম। এসব এলাকায় শিশুশ্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি বাল্যবিয়েও বেড়ে গেছে। অভাবের তাড়নায় অভিভাবকেরা সুযোগ পেলেই তাদের মেয়ে শিশুদের বিয়ে দিচ্ছেন।
কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট- এ দুটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর চরগুলোতে অবস্থিত ৪৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত হাজার। আর কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, তিস্তা, ধরলা ও জিনজিরামসহ ১৬টি নদীর বিভিন্ন চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৪২০টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৭ হাজারের মতো। চিলমারী উপজেলার এনজিও কর্মী আহসানুল কবীর বুলুর পর্যবেক্ষণ, মহামারিতে চরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কিছুটা পড়ালেখা হলেও প্রাথমিকে একেবারেই নেই। তিনি বলেন, ‘জেলার মূল ভূখণ্ডের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ে কিছুটা হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চরাঞ্চলে সেটিও নেই। কারণ চরের বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য কম।
অভিভাবকরাও অতটা সচেতন না।’ কুড়িগ্রাম জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলামের ভাষ্য, মহামারিতে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতিটা হচ্ছে, তা পূরণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের অনুরোধ করেছি, তারা যেন একটু শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেন। জেলার মূল ভূখণ্ডের কিছু শিক্ষক আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করলেও চরগুলোতে তা হচ্ছে না।’ লালমনিরহাটের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম নবী বলেন, অনলাইন ক্লাসে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ নেই। কারণ চরগুলোর বেশিরভাগ বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ। ফলে তাদের অনেকের স্মার্টফোন, এমনকি টিভিও নেই। ‘আমরা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এর মধ্যে যে ক্ষতিটা হয়ে গেছে তা অপূরণীয়, যোগ করেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে পভারটি ইলুমিনেশন এ্যাসিস্ট্যান্স সেন্টার ফর এভরিহয়্যার (পিস) মহাসচিব ইফমা হুসেইন বলেন, আগে মানুষের জীবন ও জীবিকা। তারপর লেখাপড়া ও অন্যসব। উপকূল ও উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলের যে অবস্থা তাতে সেখানকার সাধারণ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার সংকট দেখা দিয়েছে। এই সামাজিক সংগঠনের নেতা বলেন, এখন জরুরি কাজ হচ্ছে- টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে উপকূলকে রক্ষা এবং চরাঞ্চলবাসীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি অঞ্চলের এই মৌলিক সমস্যার সমাধান না করা হলে সেখানে বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম কিছুই রোধ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন ইফমা হুসেইন।