আগড়ম-বাগড়ম
করোনা শুরুর মাসখানেক আগের ঘটনা। পরিচিত এক ভদ্রলোকের ফোন। বাচ্চাদের নিয়ে বইমেলা উপলক্ষে ঢাকায় এসেছেন, এখন ওদের ইচ্ছা মিরপুর স্টেডিয়ামেও যাবে।
‘কিন্তু মিরপুরে তো কোনো খেলা নেই।’
‘আমি তো ছেলেদের সেটা বললাম, কিন্তু বোঝোই তো ঢাকার বাইরে যারা থাকে, তাদের জন্য মিরপুর স্টেডিয়ামও একটা দেখার জায়গা। সারা বছর টিভিতে ওখানে সাকিব-মাশরাফিদের খেলতে দেখে…এখন খেলা না থাকলেও স্টেডিয়াম দেখতে চায়।’
সাংবাদিকদের কাছে নানা রকম দাবি আসে। সব পূরণ করা যায় না। ভুলেও গিয়েছিলাম। কিন্তু রাতে ফেসুবকে দেখলাম স্টেডিয়াম এলাকায় বাচ্চারা মনের মতো ঘুরছে। বাচ্চাদের ইচ্ছাপূরণ করতে কোনোভাবে হয়ত ম্যানেজ করেছেন ভদ্রলোক। ফেসবুকে তাদের উচ্ছ্বাসের ছবির নিচে আবার অনেকের ‘ইস, আমিও যদি যেতে পারতাম’ জাতীয় অনেক আফসোসও। কৌতূহলবশত সেগুলো দেখতে দেখতে মনে হলো, সামান্য একটা উদ্যোগেই এই আফসোস দূর সম্ভব। সম্ভব এমন সমর্থকদের প্রাপ্য ভালোবাসা দিয়ে সম্পর্কটাকে চিরস্থায়ী করার। কীভাবে? বলছি। তার আগে একটা গল্প।
২০১২ সালে বার্সেলোনা-চেলসি ম্যাচ দেখতে যাব। অ্যাক্রেডিটেশনের জন্য যোগাযোগ করছি, ওদের কর্তৃপক্ষের একজন বললেন, ‘আরে, ম্যাচ তো টিভিতেও দেখতে পারবে। আসল জিনিস মিস কোরো না।’
‘খেলার চেয়ে আসল জিনিস আবার কী?’
‘ক্যাম্প ন্যু ট্যুর।’
নাম শুনেই বোঝা গেল ক্যাম্প ন্যু ঘোরাঘুরির একটা আয়োজন। এই আয়োজন আমার জন্য করা হচ্ছে জেনে বিনয়ে গলে গেলাম। পরে দেখলাম অতটা না করলেও পারতাম। এই আয়োজন আসলে সবার জন্য উন্মুক্ত। ২২-২৩ ইউরো দিয়ে একটা টিকিট কিনলে আপনি এমনকি মেসিদের ড্রেসিংরুমে বসেও নিশ্চিন্তে ছবি তুলতে পারবেন। কেউ কেউ তো মেসির কাট আউট ছবির সঙ্গে তোলা ছবি এমনভাবে ব্যবহার করে, যেন মেসি ওর পিঠে হাত রেখে মহা আনন্দে ছবি তুলে নিজেকে ধন্য করছেন। সেই পুরনো ট্রফি, সেই পুরনো কীর্তি, সেই পুরনো দিনের সম্ভার এমনভাবে বিছিয়ে রাখা যে এই ক্লাব সম্পর্কে না জানলে আপনি সব জেনে যাবেন। জানা থাকলে ইতিহাসের অদ্ভুত এক পুনর্পাঠ হবে। আর এসবের মাঝে যেটা হবে ক্লাবের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ। বাংলাদেশে সেই সুযোগ আর ভাবনাটাই কারো নেই। এর ফলে সমর্থক বা দর্শকের সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকই রয়ে যায়। স্থায়ী হৃদ্যতায় পৌঁছায় না বোধ হয়। বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটপ্রেমী হোম অব ক্রিকেটে গিয়ে দুর-দুর এর শিকার হচ্ছে, যখন সুযোগ আছে ওর ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়ে আরো নিজের করে নেওয়ার। এবং এই সম্পর্ক তৈরি হলে দুর্দিনে-দুঃসময়েও সে পাশে থাকবে। ক্রিকেটের এখন সুদিন। সমর্থকদের গেট থেকে দুই মাইল দূরে নামিয়ে, ঢোকার সময় অপমানজনক তল্লাশি সত্ত্বেও ওরা আসছে। কিন্তু যখন একটু সময় বদলে যাবে, তখন এই দুর্ভোগগুলো মনে পড়বে। মুখ ফিরিয়ে নিতে উৎসাহিত হবে। যেটা এখন ঘটছে ফুটবলের ক্ষেত্রে। আরো সুনির্দিষ্ট হলে আবাহনী-মোহামেডানের ক্ষেত্রে। একসময় ওদেরও লাখো সমর্থক ছিল। প্র্যাকটিস দেখতে গিয়ে ঠ্যাঙানি খেয়েছে। তবু পিছু হটেনি। সন্ধ্যা ৭টার ম্যাচের জন্য দুপুর ১২টায় লাইন দিয়েছে। ক্লাবগুলো এই ভালোবাসার মানুষগুলোকে যোগ্য প্রতিদান দেয়নি। ওদের ভোক্তা বানিয়েছে। বন্ধু করেনি। তাই দুর্দিনে ওরা কেউ নেই। স্টেডিয়ামের সেই জনারণ্যে আজ ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা।
পুরো প্রক্রিয়াটা খুব সহজ এবং সাধারণ। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে এমনও নয়। বার্সেলোনা, ম্যানইউ, মিলান, চেলসি সবখানে দেখেছি সাধ্যসীমার মধ্যে একটা টিকিট কিনলেই ক্লাবের মণিমাণিক্যে হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কি এমন একটা ব্যবস্থা করতে পারে না! পারে। কিন্তু এর আগে আরেকটা জিনিস পারতে হবে। তৈরি করতে হবে একটা মিউজিয়াম। একটা মিউজিয়াম হবে—এটা শুনতে পাই বহুদিন ধরে। মাঝেমধ্যে মিটিংয়ে আওয়াজও ওঠে, কিন্তু হয়নি আজও। হয়তো ছোট কাজ বলেই কেউ হাত দিতে চায় না। অথচ যদি তৈরি হয় একটা মিউজিয়াম, ক্রিকেটের সোনালি অতীত জমা হয় এক জায়গায়, তাহলে ঐতিহ্যের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখানো হলো আবার বাণিজ্যও সম্ভব। ওই ভাষাটা সবাই খুব ভালো বোঝে বলে সেভাবেই বলছি।
ধরা যাক, খেলা যখন নেই তখন রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মীদের বেতনের জন্য যে টাকাটা ব্যয় হয় সেটা তো বোর্ডের বাড়তি খরচ। মিউজিয়াম এবং কীর্তির গুপ্তধনের মেলা বসিয়ে যদি উন্মুক্ত করা হয় স্টেডিয়াম এবং ২০০-৩০০ টাকা টিকিটের ব্যবস্থা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে এই টাকা থেকেই রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়টা মেটানো সম্ভব। যেকোনো মিউজিয়াম ভ্রমণের পরের কাজটাই হলো অফিশিয়াল স্যুভেনির শপে ঢুঁ মারা। এই স্যুভেনির বিক্রি থেকেও সম্ভব বড় আয়। আর পুরো সময়টাতেই হোম অব ক্রিকেটে বিরাজ করবে উৎসবমুখরতা, এখন খেলা বাদ দিলে যেটা পরিণত হয় আর দশটা স্থাপনার একটিতে। এবং এভাবেই সম্ভব দর্শকদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কও। তাহলে আর ঢাকায় এসে এর-ওর কাছে স্টেডিয়াম দেখার জন্য তদ্বির করতে হবে না। উঁকিঝুঁকি মারতে হবে না অনাহূতের মতো। উগ্র নিরাপত্তারক্ষীর কাছে হেনস্তাও হতে হবে না।
মিলান না বার্সেলোনার ঘটনাটা ঠিক কোন জায়গার মনে নেই। পরিচিত এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, তিনি স্টেডিয়ামের মূল প্রশাসনিক বিল্ডিংয়ে আছেন। অপরিচিত ভাষা, তাই দেয়ালে সাঁটানো দিকনির্দেশনা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবচেয়ে বড় বিল্ডিংটা দেখে ভাবলাম, এটাই বোধ হয়। অনেক ভিড়ও দেখা যাচ্ছে। নির্ঘাৎ এটাই। গিয়ে জানলাম, এটা আসলে সাপোর্টারদের অফিস। এ এসেছে, এই ম্যাচের টিকিট বদলাতে। ও এসেছে, অ্যাওয়ে ম্যাচের জন্য কোনো প্যাকেজ আছে কি না জানতে। মূল বিল্ডিংয়ের তুলনায় অনেক মলিন। এবং এটাই আসলে আদর্শ ক্রীড়া ব্যবস্থাপনার ছবিও। দর্শকরাই হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। এটা যেন চলমান থাকে সেটা নিশ্চিত করো। তৈরি হোক, ভাব-ভালোবাসার এমন অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, যে সম্পর্ক শুধুই ৯০ মিনিট বা এক দিনের ম্যাচ দেখার নয়। এর চেয়ে অনেক বড়। বিস্তৃত। আমাদের ক্রিকেট দর্শকদের দুর্ভাগ্য যে ওদের দিক থেকে এটা জীবন-মরণ। ক্রিকেট প্রশাসনের দিক থেকে এরা নিছকই ভোক্তা।
সম্পর্ক তৈরির এই ব্যর্থতাটা আবাহনী-মোহামেডান আর ফুটবলকে যেভাবে ঠেলে দিল তলানিতে। সেই সোনালি দিনে ওরা ওদের সমর্থকদের জন্য কী করেছে! কিসের মিউজিয়াম আর কিসের সাপোর্টার অফিস, প্র্যাকটিস দেখার উৎসাহে ক্লাব চত্বরে ঢুকতে গিয়ে ঘাড় ধাক্কা খেয়েছে, তারকাদের অটোগ্রাফ নেওয়ারও কোনো বন্দোবস্ত রাখেনি ক্লাব। তখন না রাখলেও চলত। এখন? মাঝেমধ্যে ভাবি, আবাহনী-মোহামেডান কি এ রকম একটা মিউজিয়াম-স্যুভেনির শপ বানাতে পারত না! রেজিস্টার্ড সদস্য তৈরি করতে পারত না কিছু বাড়তি সুবিধা আর সম্মান দিয়ে। তাহলে হয়তো আজকের দিনে এই মানুষগুলো আলো জ্বালানোর লোক হয়ে রয়ে যেত পাশে। এদের কথা আর কী বলব? আবাহনী-মোহামেডানের পুরনো ম্যাচগুলো টিভিতে পুনঃপ্রচার সম্ভব কি না জানার জন্য একবার একটা রিপোর্ট করার চেষ্টা করলাম। খোঁজ করে জানা গেল, কোনো টেপ ওদের কাছে নেই। দরকারি মনে না হওয়ায় সংরক্ষণ করা হয়নি। এক ক্লাব কর্মকর্তাকে একদিন ধরলাম, ‘আপনাদের কাছে পুরনো খেলার কোনো রেকর্ডিং আছে?’
‘তখন কি আর মোবাইল ছিল যে…?’
‘কিন্তু ভিডিও করার ব্যবস্থা তো ছিল।’
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ‘এর কি কোনো দরকার ছিল?’
কেউ দরকার মনে করেনি বলেই সোনালি দিন হেলায় হারিয়েছে। অথচ এটা কোথাও কোথাও ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে। ফুটবলার আসলাম কিভাবে কিভাবে যেন নিজের খেলার কিছু ভিডিও ক্লিপ জোগাড় করেছিলেন। নিজের আত্মজীবনী বা গানের সিডির প্রকাশনা উৎসবে সেই ভিডিওটা দেখালেন কিছুক্ষণ। চমকে গিয়ে এর আগে আসলামকে না দেখা এক তরুণ সহকর্মী বলল, ‘কিছু কিছু গোল দেখে তো মনে হলো বিশ্বমানের।’
বিশ্বমানের না হলেও আসলাম এশিয়া মানের ছিলেন বলেই মনে করি। যেমন ছিলেন মুন্না-সাব্বির-কায়সার হামিদরা। ওদের কীর্তিগুলো জমা থাকলে পুরনো দিনের মানুষেরা নিশ্চিতভাবে ভিড় করতেন আবাহনী-মোহামেডান তাঁবুতে। সঙ্গে হয়তো তরুণ ছেলে কিংবা হাত ধরে চলা নাতি। এভাবেই গভীরতা তৈরি হয়। খেলার সঙ্গে খেলাপ্রেমীর সম্পর্ক এভাবেই বংশপরম্পরায় বয়ে চলে।
অবশ্য বাণিজ্যের স্রোত আর সময়ের মোহে মত্ত আমাদের বয়েই গেছে এসব আগড়ম-বাগড়ম শুনতে।