যশোর যাচ্ছি। বাসে।বাসে দূরে কোথাও যাচ্ছি — এমন মনেহলেই আনন্দ লাগে । সবার মাঝে থেকেও কারো মধ্যে নেই আমি । নিরিবিলি মনের মধ্যে ডুবে থাকার এমন সুযোগ আর কোন জার্নিতেমেলেনা ।বাতাসের শব্দ কেটে সাঁইসাঁই করে বাস ছুটে চলেছে ।শীতকালের পড়ন্ত বিকেল । রাস্তার দু’পাশে দিগন্তজোড়া সর্ষেফুলের মাঠ,মিষ্টিরোদ, হলুদ রঙের বন্যায় ভেসে গেছে । আবীর রঙ আকাশ মুহূর্মুহু রং বদলে চোখেরসামনেই অন্য আর এক রকম ছবি হয়ে যাচ্ছে । দলবেঁধে পাখির ঝাঁক নীড়ে ফিরেযাচ্ছে । এই সব দৃশ্যে চোখদুটো খোলা রেখে মন যেন নি:শব্দে ঘুমুচ্ছে ।
মাঝে মাঝে বন্ধ জানালার শার্সি গলে ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ের ওম ভেঙেদিচ্ছে । এটা নিয়ে সুপারভাইজারকে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছেনা । কোলাহল দরকার কি । বিপত্তি বাধালো পাশের সিটে বসা প্রায়বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক । আমারসিট বাম জানালার পাশে । আমার ডানপাশে ভদ্রলোক ঝিমুচ্ছেন । বারবার তিনিআমার কাঁধে হেলে পড়ছেন । আমি বারবার উনাকে তুলে দিচ্ছি, সতর্ক করছি ।
তিনি ‘আ্যাঁ-য়ুঁ’ করে সোজাহয়ে বসছেন কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার আগের মতোইহেলেপড়ছেন । মহামুশকিল । আমাদের সিট-লাইনে ডানপাশের জানালায় টানহয়ে বসে আমাদের এই তামাশা দেখে হাসবার চেষ্টাকরে দাঁত বের করে আছে গ্রাম্য চেহারার এক অর্ধশিক্ষিত শক্ত-পোক্ত লোক । লোকটা বয়সোত্তীর্ণ ছাত্রও হতে পারে । তার বামপাশে চুপচাপ বসে আছেন জেনুইন একজন বৃটিশ ধাঁচের বৃদ্ধ ।
তার অমায়িক মুখাবয়ব । বকধবল চুল । আমার মাথায় দুষ্টুচক্র খেলে গেল। একঢিলে দুই পাখি মারবো । সন্দেহ হলো, ঝিমুনো
লোকটা ঘুমের ভাণ করে আমার গায়ের উপর অমন হেলে পড়ার অভিনয় করছে মনেহয় । আর ঐ পাশে জানালায় বসা দেঁতো ছাত্র-লোকটা এই মজার দৃশ্য দেখার ছলে দুই চোখ দিয়েআমাকে গিলছে বোধহয় । আমি শেষবারের মতো আমার পাশে বসা লোকটাকে মধ্যম সাইজের একটা ধাক্কা দিয়েবললাম, চাচা, বাসে চড়ে ঘুমানো উচিৎ নয় । বাস এক্সিডেন্ট করলে আপনিই আগেমারা যাবেন । ওমা, লোকটা আচমকা আগুন হয়ে গেল, তুমি মইরবানা ? তুমি কিবাঁইচা থাকবানি ? আমি তাড়াতাড়ি ভূল শংশোধন করে নিলাম, চাচা, আপনারবোধহয় শরীরটা ভালো নয় । ঘুম দরকার । ওই পাশে জানালার ধারে গিয়ে হেলানদিয়ে বসলে আপনি আরাম করেঘুমুতে পারবেন, যাবেন ? চাচা জবাব দেবার আগেই আমি মিষ্টি হেসে দেঁতোলোকটাকে বললাম, ভাইয়া, আপনি আমার পাশে এসে বসেন । চাচা আপনার সিটে গিয়েএকটু আরাম করে বসুক । অসুস্হ মানুষ তো, ঘুম দরকার । যাদুর মতো কাজ হয়ে গেল । আমার আর কিছু করতে হলোনা । লোকটা চাচাকে এক প্রাকার টেনে-হিঁচড়ে এনে ইমার্জেন্সী রুগীর মতন তার সিটেবসিয়ে দিল ।
চাচা আপত্তি করলো না । খুশি হলো।সুন্দরীসঙ্গ সহচার্য্যে
দেবতারাও যে পটে যায়, লোকটা আবার প্রমাণ করলো । আমি হাসলাম । চাচাকেসন্দেহ করায় আমার একটু খারাপ লাগতে লাগলো । একটু পরেই টের পেলাম আহম্মকিকরে ফেলেছি । মনে করেছিলাম বুদ্ধির খেলাটা পরে খেলবো । সহযাত্রটি আগেপাশে ভালভাবে বসে নিক। কিন্তু সে সুযোগ আর মিললো না । আম মিষ্টি কিনা –আঁটি পর্যন্ত আর যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো না । সহযাত্রীর গায়ে ঘামেরবোঁটকা গন্ধ । ভূত পালায় এমন অবস্হা ।আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে হলোআমার,যেচে কী গন্ধগোকূল টেনে এনে আমি কাছে বসালাম ! দুর্গন্ধ থেকে বাঁচারজন্যে আমি গায়ের ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে মুখ বেঁধে ফেললাম । কাঁচুমাচুহয়ে সরে গেলাম ফাঁকে । অনেক ফাঁকে । সহযাত্রী বুদ্ধিমান । পরিবেশ বুঝতেপারলো । বিনয়ের সঙ্গে বললো, আপু, এই ইকটু সমস্যা হতি পারে আপনের ।চাইরদিন গোসুল করার সুযুক পাইনি আমি । হাজতে ছিল্যাম। মুখ বাঁধা ছিলআমার, চোখদুটো বের হয়েছিল । ভরকে গিয়ে সে দু’টো দিয়েই তাকিয়ে রইলাম ।সহযাত্রী বললো, ইবার কুনো অপরাধ করে হাজতে যাইনি আপু, ভুট্টুর চা’রদুকানে বাংলা মাল টানতে গিয়ে ইকটু রাইত হয়ে গিছিলো, আচমকা টহল-মামারাআইসে সবটিকতুলে লিয়ে গেল। পরেদ্দিন প্যাদানি দিয়ে ফিফটি ফোর । ট্যাকা-পয়সা থাকলিকোট-হাজতে গিয়ে আর চোদ্দসিক গুনা লাইগতো না আপুমনি । পুলিশ শালাদের ইডাহইল একটা ইসটা কামাই, বুজল্যান না ? একটু থামলো হাজত খাটা সহযাত্রী ।
আমিএ ধরনের সিচ্যুয়েশনের মুখোমুখি পড়িনি কখনো । এ ধরনের গল্পে সাড়া দিতেহয় কি ভাবে আমি তা-ও জানিনে । শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলাম । ভয়ভয় করছিল । সহযাত্রী হঠাৎ আমার উড়ুতে আঙ্গুলের টোকা দিয়ে বললো, আপাশোনেন, একখান কথা কই — আমি চমকে উঠলাম । চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে পড়তেআবার ঠাসকরে বসে পড়লাম । এই অস্বাভাবিকতা এক সিট পরের বৃটিশ-ভদ্রলোকবোধকরি টের পেলেন । তিনি বিরক্ত হয়ে একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়েইমাথা নিচু করলেন । মনেমনে আমাকে গালি দিলেন নিশ্চয় । পাশে বসা বদ লোকটাএবারও আমার বেসামাল অবস্হা বুঝতে পাড়লো । ঠোঁট কামড়ে ধরেমুখে এক ধরনের বিশ্রী শব্দ করে বললো, ভুল হয়ে গেল আপুমনি । অভ্যাস ।কিছু মনে কইরেন না । তারপরে সে আর অনেক্ষণ কথা বললো না । অথবা বললেও আমারকানে গেলনা । সন্ধ্যে হয়ে আসছিল । বাসের মধ্যে আঁধার । একটুপরেই রাতনেমে আসবে । এই ধরনের চরিত্রহীন লোকের পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমাকে আরোদীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হবে — এই কথা ভাবতেই আমার গা-কাঁটা দিয়ে উঠছিল ।কান্না পাচ্ছিলো । সহসা বাসের মধ্যে বাতি জ্বলে উঠলো । বোনাটের কাছেদাঁড়িয়ে সুপারভাইজার ঘোষনা দিল, সন্মানিত যাত্রী সাধারন, আমরা ঝিনাইদহরোজাভিস্তা ফুডভ্যালীতে পৌঁছে গেছি । এখানে যাত্রা বিরতি পনের মিনিট । মাল-সামানা নিজ দায়িত্বে রাখুন । ধন্যবাদ। আমার জানটা ধরে এলো । বাসের মধ্যে ঝলমলে আলোয় যেন নুতন দুনিয়া দেখলাম আমি । আড়মোড়া ভেঙে যাত্রীরা সব নেমে যেতে লাগলো । আমিও নামবো । দেখলাম বৃটিশ-আঙ্কেল তাড়াহুড়ো করে আগে আগেই নেমে গেলেন । বুড়ো মানুষ ! কিন্তু আমার পাশের বিশিষ্ট ভদ্রলোক না নামলে তো আর আমার নামার উপায় নাই। সবাই একে একে নেমে গেল, তার নামার কোন লক্ষণ নেই । গাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল । খবরের কাগজে পড়া হঠাৎ বাজে খবরের কথা মনে পড়লো আমার । বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎকরে উঠলো । কালবিলম্ব না করে আমি উঠে দাঁড়ালাম । ঘাড় উঁচুকরে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে অসভ্যের মতো প্রশ্ন করলো, আপা কি বাথরুমে যাবেন ? আসেন আমার সাথে, আমিও যাবো । সিট ছেড়ে সরে দাঁড়ালো সে।
আমি তার কথার জবাব না দিয়ে সন্তর্পনে গা বাঁচিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম । ওয়াশরুমে গেলাম না । লোক চলাচলের রাস্তা ছেড়েদিয়ে অনতিদূরে গিয়ে দাঁড়ালাম, বৃটিশ আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলবো বলে । আঙ্কেলের জরুরী সাহায্য প্রয়োজন । দেঁতো লোকটা পিছুপিছু এসেছে । মাথাটা আমার গরম । ক্ষানিকটা এলোমেলোও । যতদুর সম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে আমি তাকে এই রকম কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম, এইযে ভাই, শুনুন, আমি যদি আপনার সাথে যেচে কথা বলি তখন আপনি কথা বলবেন কিন্তু আপনি উপযেচে আমাকে কোন কিছু আর বলবেন না, বুঝতে পেরেছেন ? মনেহয় আমার কথা সে বুঝতে চাইলো না । বদের হাড্ডি । না বুঝলো নাই । আমি তার সামনে থেকে সরে গেলাম ।
এদিক ওদিক হেঁটে বৃটিশ আঙ্কেলকে খুঁজে বের করলাম । ডাইনিং হলে তিনি পরিচিত কারো সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন । আমাকে দাঁড়ানো দেখে বললেন, কিছু বলবে ? আমি ছোট্ট বাবুর মতো মাথা ঝাঁকালেম । আঙ্কেল আরো দু’একটা কথা বলে ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিলেন । তারপর আমার দিকে ফিরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন । আমার মুখে কথা ফুটছেনা । কি বললে ভালো হয়, কি বলা উচিৎ কিছুই ভেবে কূল পাচ্ছিনে । কোনমতে বলার চেষ্টা করলাম, আঙ্কেল প্লিজ, এখন বাসে উঠে যদি আপনি আমার সিটে বসেন, আমি — আমার কথা শেষ হলোনা ।
আঙ্কেল মাথা দুলিয়ে বললেন, বসবো । সমস্যা নেই । কিন্তু তোমার ভুল হয়েছে, অচেনা অজানা একটা ছেলেকে এভাবে পাশে ডেকে নিয়ে বসানো । এ ছোকরাকে তো আমরা চিনি । ভাড়াখাটা রাজনীতির একটা পরিত্যক্ত ছেলে । জঘন্য স্বভাব তার । আঙ্কেল কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলেন । আমি চুপ । ভয়ে ভয়ে ছিলাম এবং আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ করলাম, এই বিশিষ্ট ভদ্রলোক একবারো তিনি তাঁর কন্যার বয়সী, চরম বিব্রতকর অবস্হায় পড়া একজন তরুণীকে জিজ্ঞাসা করলেন না, তোমার বাড়ি কোথায়, বাবার নাম কি, তিনি কি করেন । বরং বাসের কাছে এসে বাসের গেট ধরে দাঁড়িয়ে বৃটিশ আঙ্কেল উদাস কন্ঠে বললেন, শিক্ষিত ছেলে, এরা হলো দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘস্হায়ী দূরাবস্হা আর চরম অব্যবস্হাপনার শিকার । যাও, তুমি উঠে গিয়ে আমার সিটে বসো । আমি তাই করলাম।
গাড়ির মধ্যে কোথাও লোকটাকে দেখতে পেলাম না । ষ্টার্ট দিয়ে বাস যখন নড়তে শুরু করেছে সেই সময় ভূতের মতো কোথাত্থেকে সে এক লাফ দিয়ে এসে গাড়ির মধ্যে পড়লো । সামনে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে, একবার আঙ্কেলের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে থাকলো । তারপর সিটে বসতে গিয়ে ঝুঁকে আমার কানের কাছে মুখ এনে অনুচ্চস্বরে যে ভাষায় যা আমাকে বললো, তা আমার বাপের জন্মে কখনো শুনিনি, আর কখনো শুনবো বলে মনেও হয়না । সে অতি জঘন্যভাবে বললো, এইসব মাগিকে বিশ্বেস নেই ।
আমি অপমানে কাঠ হয়ে বসে রইলাম । চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে থাকলাম, কথাটা কেউ শুনতে পেল কিনা । না, তেমন মনে হলোনা । কেউ শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলোনা । বাসের মধ্যে মৃদু হৈচৈ, কলরব । শিশুরা কথা বলছে, স্ন্যাকস-ফাষ্টফুড খাচ্ছে । মায়েরা বাচ্চাদেরকে আদর করছে, শাসন করছে । আনন্দঘন জীবন্ত পরিবেশ । আমিই কেবল মনখারাপের মূর্তি ধারন করে মরণে মরে গিয়ে তবলা হয়ে বসে আছি ।
হাইওয়ে’তে উঠে বাসের আলো নিভে দেওয়া হলো । আর কি আশ্চর্য্য, সঙ্গে সঙ্গে আমিও যেন এই আবছায়া অন্ধকারে নিজেকে নিরাপদে লুকিয়ে রাখার এক নিশ্চিত স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম । কেউ আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেনা, আমাকেও কারো মুখ দেখতে হচ্ছেনা । ধীরে ধীরে নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম । ঘুম আচ্ছন্ন বৃদ্ধ লোকটা কখন যে নেমে গেছে বুঝতে পারিনি । বিচিত্র এই দুনিয়ায় মানুষের জীবনে অহর্নিশি কত কিছুই না ঘটে, সবকিছু ধরে রাখলে কি চলে, না চলা উচিৎ ? আঁধারে মিশে ঝিমধরে আবার অনেক্ষণ বসে রইলাম । আম্মুর কথা মনে পড়লো । শশী-শ্যামার কথা, নীতু-মিতুর কথা মনেহলো । সিগারেটখোর ওই আবীরের মুখোচ্ছবিও একবার চোখে ভেসে উঠলো । আবীরকে যা মনে করেছিলাম আমি, ও সেরকম নয় । যতোটা একাগ্রচিত্ত, লক্ষ্যভেদী ভেবেছিলাম তার চাইতে সে বেশি ছন্নছাড়া । ক’দিন আগে আম্মু ফোনকরে বলল, বড়দিনের ছুটিতে বাসায় আয়, কথা আছে। কি আর কথা, ওই একই রেকর্ড হয়তো বাজানো হবে, ছেলে আমেরিকায় থাকে, ভাল চাকরি করে । কত স্যালারী পায় জানিস ? আন্দাজ কর্ তো একবার ! আমি স্ট্রেইট বলে দিয়েছি, আসতে পারবো না । আম্মু মন খারাপ করবে দেখে মুখের উপর শুধু বলে দেইনি — একশ’একটা বিলগেটসও যদি আমার জন্যে প্রোপোজ করে, আমি একজনকেও চয়েস করবো না । আমার কথা আগেও যা, পরেও তাই । আমি আজ যশোর যাচ্ছি শুধু আব্বুকে বলতে, প্লীজ, তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো । আমাকে আর টাকা পাঠিও না । আমাকে আমার পায়ে দাঁড়াতে দাও ।
এই যাত্রার শুরু থেকে দু’টি আনন্দের অনুসঙ্গ আমাকে অনুপ্রানিত করে রেখেছে । যশোর যাবো বলে আম্মুর জন্যে পাবনা দোগাছী ইউনিয়ন থেকে সূক্ষ্ম-জ্বালি সূতায় কাজ করা ‘রানি প্রিয় শাড়ি’ আর আব্বুর পাঞ্জাবীর জন্যে মেটে তাঁতের খানদানী তশর থান কিনে রেখেছিলাম । আছে । লাগেজে । এগুলো আমার প্রথম রোজগারের টাকায় খরিদ করা । আমার প্রথম আনন্দ । প্রথম খুশির অনুভূতি। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমি ।
দ্বিতীয় বিষয় নীতু-মিতু । নীতু-মিতুর জন্মদিনে আমার কিছু গিফট দেওয়া হয়নি । মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি ছিল । পরেরদিন সন্ধ্যে বেলা গিয়ে ওদের বাড়ি হাজির হলাম । বললাম, আজ পড়াবো না । শুনে ওদের চেয়ে ওদের মা’ই বেশি খুশি হলো । ঠিক আছে মা, আজ ওদের সাথে বসে মজা করে গল্প করো । আপা একগাল হেসে চলে গেলেন । আমার মনের মধ্যে কিন্তু জন্মদিনের দিন থেকে আরো একটা অস্বস্তি কাজ করছিল । আপার মুখে আজ ‘ঠিক আছে মা’ শুনে সে অসস্তি দুর হয়ে গেল। আমি মিটিমিটি হাসছিলাম বোধহয় । নীতু-মিতু একসাথে বলল, আপা, হাসছো কেন তুমি ? আমি বললাম,আজ মজাকরে গল্প করবো বলে হাসছিলাম । ওরা দু’জন আবার একসাথে বললো, তাহলে গল্প শুরু করো । সাধারনত নীতু-মিতু ওরা দুজন কম কথা বলে । আর যখন বলে তখন প্রায়ই এককথা এক সাথে বলে । বিশেষত কৌতূহলোদ্দীপক কথা ।
আমি গল্প শুরু করলাম । আমার দু’টি বোন ছিল । তারা আমার চেয়ে বড় । খুব বেশি বড় নয়, পিঠেপিঠি বড় । একজনের নাম শশী, আর একজনের নাম শ্যামা । তারা আমাকে খুব ভালোবাসতো । ওরা প্রশ্ন করলো, নাম দু’টো খুব সুন্দর, কাব্যিক নাম । রোম্যান্টিক আর প্যাট্রিওটিকও । উনারা এখন নেই ? হ্যাঁ,আছে — তাহলে তুমি উনাদেরকে ‘ছিল’ বলছো কেন ? ‘ছিল’ বলছি এই জন্যে যে, ওদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের কারো এখন আর সম্পর্ক নেই। নীতু-মিতু সমস্বরে বললো, কেন, সম্পর্ক নেই কেন ? আমি বললাম, শশী আর শ্যামা ওরা নিজেরা নিজেরা দুইজন দুই ছেলেকে পছন্দ করে আব্বু-আম্মুকে না বলে বাড়ি থেকে চলে গেছে । আব্বু-আম্মু ওদের উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা । ওরাও আব্বু-আম্মুর উপর ক্ষ্যাপা । নীতু-মিতু বললো, উনারা তোমার উপরেও কি ক্ষ্যাপা ? আমি হেসে বললাম, না । ওরা আমার উপর ক্ষ্যাপা নয় । আমাদের মধ্যে ভালোবাসা এখনো আছে ।
নীতু এবার সাহস করে জানতে চাইলো, আপা, তুমিও কি বড় আপাদের মতো কোন ছেলের হাত ধরে চলে যাবে ? আমি উচ্চস্বরে হেসে ফেললাম, কক্ষনো নয় । কোন ছেলেকে পছন্দ হলে আমি আব্বু-আম্মুকে বলবো । নীতু-মিতু চুপকরে থাকলো কিছুক্ষণ । তারপর প্রায় একসাথেই বলে উঠলো, আপা, তুমি খুব ভালো । ওদের কথায় কর্ণপাত না করে আমি আমার ঢাউস সাইজের হ্যান্ডব্যাগ খুলে তিনটা বই বেরকরে বললাম, এ বইগুলো তোমাদের । ওরা সঙ্গে সঙ্গে বইগুলো কেড়ে নিতে চাইল, দেখি দেখি কি বই ! আমি বই’সমেত হাত সরিয়ে নিয়ে বইগুলো উল্টোকরে রেখে দিলাম । বললাম, আগে আমার কথা শোনো । বইগুলোর একটা ইতিহাস আছে । এ বইগুলোর মধ্যে পাঁচ বৎসর আগে আমার জন্মদিনে পাওয়া সবচে’ দুইটা প্রিয় বই রয়েছে । বই দু’টো আমাকে কে কে দিয়েছিল জানো ? ওরা ঘাড় ঝাঁকালো, জানেনা ।
আমি একটা একটা করে বই দেখিয়ে বললাম, এইটা দিয়েছিল শশী আর এইটা শ্যামা । আজ আমি আমার প্রিয় এই বই দুইটা তোমাদের জন্মদিন উপলক্ষে তোমাদেরকে গিফট করবো । কে কোনটা নেবে, নাও । আমি নাম লিখে দিচ্ছি । ওরা বইয়ের ভিতরে না দেখে, শুধু উপরের নাম দেখেই কাড়াকাড়ি করে বই দু’টা সেপারেট’করে ফেললো । নীতু নিল আব্দুল হাই’এর ‘জীবন আমার বোন’ । মিতু নিল হুমায়ূন আহমেদের ‘জোসনা ও জননী’ । আমি তৃতীয় বইটি দেখিয়ে হেসে বললাম, এইটা কার ? ওরা সমস্বরে বললো, ওইটা ইংলিশ বই, ওইটা তোমার । হারুকি মুরাকামী’র মৌলিক ভাষায় লেখা বইটি ছিল আমার অধরা । আমার অনেক পছন্দের বই ‘Here the wind song’ । নীতু-মিতু দু’জনেই উঠে এসে ততক্ষণে আমাকে দু’দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । আনন্দের আবেশে আমার দু’চোখ তখন জলে ভরে গেছে । আমি টের পেলাম ।
ঘুম ঘুম আচ্ছন্নতা থেকে তীব্র আলোয় চোখ মেলে তাকালাম । বাসের মধ্যে আলো জ্বলে উঠেছে । বাস ঝাঁকি দিয়ে কোথাও দাঁড়িয়ে গেছে । বাইরে তাকালাম । আর ফার্লং খানেক পরেই যশোর বাসস্ট্যান্ড । বাস দাঁড়িয়ে আছে পদ্মপুকুর পাড়, বাটারফ্লাই মোড়ে । প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি । কয়েক মুহূর্ত পরে দেখলাম, বাসের মধ্যে পুলিশ । গেটের কাছে দু’জন, নিচে রাস্তায় এক-আধজন আর একজন এস আই টর্চ হাতে উপরে উঠে এসেছে । উচ্চস্বরে সে বলছে, যে যেখানে আছেন, সেখানেই চুপচাপ বসে থাকুন । বাসের যাত্রীদের মধ্যে রমেশ মৈত্র কে, রমেশ মৈত্র ? আশ্চর্য্য হয়ে দেখলাম, বৃটিশ আঙ্কেল বলছেন, আমি । আমি রমেশ মৈত্র । পুলিশ বললো, আপনাকে স্যার আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে । কেন ?
আমাদের কাছে স্যার ইনফরমেশন আছে, আপনি বেনাপোল দিয়ে ইন্ডিয়ায় যাবেন, কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে যোগদান করতে । এটা নাগরিক আইন পরিপন্থী । আপনাকে আগামীকাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের আদালতে হাজির হয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিতে হবে । বৃটিশ আঙ্কেল সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে পুলিশের সঙ্গে বাস থেকে ধীরে ধীরে নেমে গেলেন । বাসের সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল । আর আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম । এই ঘটনার পরেপরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেঁতো, অসভ্য ওই লোকটাও দ্রুত বাস থেকে নেমে পদ্ম পুকুরপাড়ের আঁধারে মিলিয়ে গেল ।বাস নির্ধারিত স্হানে পৌঁছুলে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে আমিও নামলাম ।অনেকে অনেক কথা বললো। গা-জ্বালানো কথা সব । রমেশ মৈত্র। নাম শুনেছি । খবরের কাগজে তাঁর লেখা পড়েছি । বর্ষীয়ান রাজনীতিক এবং বিখ্যাত কলামিষ্ট । আজ তাঁকে দেখলাম । রাজনীতি বিষয়টিই যেন কেমন ; ভালো মানুষগুলো শুধু জেল খাটে আর লোভী মানুষরা কেবল ক্ষমতায় থেকে মজা লোটে । লাগেজ নিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি । চারদিকে শুধু অটো-রিকসা । তারা কুমীরের মতো ভিঁড় করে দাঁড়িয়েছে ।আমি একটা রিক্সা খুঁজছি ।