শেষপর্যন্ত চিতল মাছের কোপ্তা আমি খাইনি । গোস্ত-ভাত খেয়েছি । কালাভূনাটা ছিল অসাধারণ । খাসির গরম রেজালার স্বাদও ছিল অন্যরকম । খাওয়া শেষে দৈ-মিষ্টি আর বড় এক ডাব্বু-চামুচ রসমালাই । কঠিন তৃপ্তি । ক্ষিধে-পেটে খেতে খেতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম । শুয়ে রেষ্ট নিচ্ছি । ফোন বেজে উঠলো । ঘড়ি দেখলাম, রাত সাড়ে এগারোটা । দোতালার ওঘর থেকে এঘরে আব্বু ফোন করেছেন । ফোনে যে তিনি হাসছেন, শুধু শব্দ শুনতে পাচ্ছি তা-ই নয় ; মনে হলো দেখতেও পাচ্ছি ।
আব্বু বললেন, কিরে মা, মা-বেটি’তে গল্প করতে করতে আব্বুর কথা ভুলে গেলি ? বললাম, দশ মিনিট । আমি আসছি আব্বু । তুমি রেডি হও । আমারও মিনিট দশেক সময় লাগবে রেডি হতে । অবশ্যই আব্বু সানন্দে অপেক্ষা করবে । আমি জানি । অনেক কথা জমা হয়ে আছে যে তার ! আব্বু আমাকে কি বলবেন জানিনা, আব্বুকে আমি কি বলবো– সেইটা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে আমাকে । এমন একটা পরিস্হিতির মধ্যদিয়ে আমার সময়গুলো অতিবাহিত হচ্ছে যে, না ভাবলে চলেনা । এখন সিরিয়াসলী মনেহয়, আমার বেহিসেবি-জীবনের দিন শেষ । এই জীবনের আনন্দ আমি আর কখনোই ছুঁতে পারবো না । কাল সকালে আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই আব্বু অফিসে পৌঁছে যাবে । এমন কিছু কথা আছে যে, অফিসে যাবার আগে– অর্থাৎ আজ রাত্রেই আব্বুকে বলতে হবে । আবার আব্বুর এমন কিছু ইচ্ছে বা মানসিকতা থাকতে পারে, যা এখন পর্যন্ত আমি জানিনে।
আমাকে জানতে হবে । এই জানা, না জানার সঙ্গে আমার মনের স্বস্তি আর সুস্হতার সম্পর্ক রয়েছে । দশ মিনিটে আমি এগুলোই ভেবে নিতে চাইলাম । নিচে আম্মু বক্কারের মা’কে সঙ্গে নিয়ে তখনো হাঁড়ি-পাতিল ঘটর-মটর করছে । আমি দোতালায় । কর্ডিগানখানা গায়ে জড়িয়ে আব্বুর রিডিং-রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম । ওমা, আব্বু আমাকে ‘আয়-টায়’ কিছু না বলে আমার দিকে হেসে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন । আমি এগিয়ে গিয়ে আব্বুর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়াতেই তিনি প্রশ্ন শুরু করলেন : এখন টোটালি তোর আম্মুকে কি মনেহয় ? প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম। দক্ষতার সাথে ঝটপট উত্তর দিলাম, অসাধারণ! আব্বুকে? পচা। তোর নিজেকে ? অপদার্থ।
বুঝতে পারলাম, আব্বু খোশ মেজাজে আছেন। সাবধান হয়ে গেলাম। মেজাজ ভালো থাকলে তিনি রসিকতা করেন। কঠিন কঠিন কথা বলেন । আব্বু প্রশ্নের ধারা অব্যহত রাখলেন। কি ভালো লাগে ? গোপন হাসি । কি খারাপ লাগে ? কিছুই খারাপ লাগেনা । বাংলায় একটা শব্দ আছে– স্ত্রৈণ। স্ত্রৈণ মানে কি ? আমি ভেবে-চিন্তে বললাম, স্ত্রৈণ মানে ছাগল । আব্বু হা: হা: হা: হা: করে হেসে উঠলেন। মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন, রাইট। আমারও তাই মনেহয় । কিন্তু আব্বুর চোখ-মুখ হাসির সঙ্গে মিললো না। কাঠ-কয়লায় পোড়া হাসি মনেহলো। বুঝতে পেরে আমি বেদিশার মতো বললাম, তুমি ঠাট্টা করছো আব্বু ? ঠাট্টা নয় রে মা । রসিকতা করছিলাম । কতকাল তোদের সঙ্গে রসিকতা করিনে, মনে আছে ?
আমি টার্ন-ওভার করতে চাইলাম। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ একটা আনন্দের দিন, তাইনা আব্বু ? হ্যাঁ । তাহলে আজ আমার প্রার্থনাটি মঞ্জুর করে নাও । তোর প্রার্থনা কি ? ভুলে গেছো ঊনত্রিশে ডিসেম্বরের কথা ? তোর বয়স কি আঠারো হয়ে গেছে ? আগামীকাল হবে । আব্বু বললেন, তাহলে তো দেরী আছে । আঠারো বৎসরের আগে তোর ব্যাপারে আমি যা ইচ্ছা তা-ই তো করতে পারি, নাকি ? পারো । কিন্তু কি করবে তুমি ? তোর ব্যাংক এ্যাকাউন্টে দশলক্ষ টাকা কাল সকালেই ট্রান্সফার করে দেব আমি । আমি একটু চিন্তা করে বললাম, তাহলে এক কাজ করো। এই টাকা আমি দুস্হদের কল্যাণে দান করতে চাই । তুমি সিষ্টেম করে ফেলো । আব্বু হেসে ফেললেন । বললেন, সুন্দর সিদ্ধান্ত । তবে আমি বলি কি মা, এই মহৎ কাজটি তুমি ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখো– অবশ্যই করবে, যখন তুমি নিজে টাকা রোজগার করবে ।
আমি সঙ্গে সঙ্গে আব্বুকে ছেঁকে ধরলাম, তাহলে তুমি এবার নিজেই চিন্তা করে দেখো আব্বু, নিজের টাকার উপর হক শুধু তারই যিনি টাকা রোজগার করেন এবং খরচের অধিকারও শুধু তারই, রাইট ? আব্বু মাথা চুলকাতে লাগলেন । যথার্থ জবাব দিতে পারায় আমি আনন্দিত । শেষমেষ আব্বু বললেন , হলো না রে মা । হেরে গেলাম । তোর অনেক বুদ্ধি । তাহলে আর দেরী কেন, আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হোক । আব্বু হতাশ হয়ে বললেন, ঠি-ই-ক আছে । কিন্তু পরক্ষণেই রুল জারী করলেন, তবে একটা শর্ত আছে । কি শর্ত ?
প্রয়োজনে জরুরী অবস্হা ঘোষনা করা যাবে । আচ্ছা । আব্বুর শর্ত আমি মেনে নিলাম । যেহেতু আমার অবস্হা এখন খারাপ না, ভালই । আব্বু হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরে হলেন মহা খুশি । কিন্তু আমাদের বাপ-বেটির কথা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ । আমি আব্বুকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, তুমি নাকি মনোহরদীপুর দাদীমার কাছে চলে যাচ্ছো, কবে ? ইচ্ছে করলেই তো আর দাদীমার কাছে চলে যাওয়া যাবে না ; অপেক্ষা করতে হবে । আর সেই অপেক্ষাটা আমি মনোহরদীপুরে করতে চাই । এভাবে বলছো কেন ?
আব্বু চুপ করে রইলেন । কথা বললেন না । আমি বললাম, একাই যাবে ? আম্মু যাবে না ? সে যেতে পারবে না । তার যাবার যোগ্যতা নেই । বুঝলাম না । আব্বু রেগে গেলেন, তোর বুঝে কাজ নেই । কঠিন নিরবতা নেমে এলো কয়েক সেকেন্ডের জন্যে । আমি ঘাঁটালেম না আব্বুকে । আম্মুর উপরে তার নানা কারণে অভিমান । কবরে যাবার আগে মানুষের পরিশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা– মনোহরদীপুর যাবার বিষয়ে আব্বু এমনি এক ধারণা পোষন করেন । তাঁর ধারণা, আম্মু পরিশুদ্ধ মানুষ নয় । আম্মুর মধ্যে অর্থ-সম্পদের আকর্ষণ প্রবল ।
আমি আজ ইচ্ছে করে আব্বুকে দাদীমার কথা জিজ্ঞাসা করলাম, ইদানীং দাদীমার কথা কি খুব বেশি মনে পড়ে তোমার ? হ্যাঁ । কোন্ কথাটি তোমার বেশি মনে পড়ে ? আব্বু চুপ করে থাকলেন অনেক্ষণ । বালক বেলার মা’র কাছে ফিরে গেছেন বোধহয় । অবশেষে গাঢ় স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, বেশি মনে পড়ে আমার মা’র মুখে শোনা বাবার কথা । কিন্তু বাবার কথা আমার মনে নেই । মা বলতো, বাবা নাকি মানুষ ছিলেন না ; ফেরেস্তা ছিলেন । একটু থেমে তিনি আবার বললেন, মা’র গায়ের চামড়ার সাথে লেগে থেকে আমি মানুষ । তার মৃত্যুর কথা আমি কখনো ভুলতে পারিনে মা । বুঝলাম, আমি বোকার মতো কথা বলে ফেলেছি । চুপকরে থাকা ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই ।
আব্বু মন খারাপ করে বলতে লাগলেন, আমার বয়স তখন ছয়-সাত । মা প্রায়ই মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালেন । বুক চেপে শুয়ে থাকেন । এবং কেন যেন ওই সময়েই আমাকে কোলের কাছে শুইয়ে আদর করেন, চুমু খান । মুখ-চোখ নেড়ে কথা বলেন । আমার শুধু মনেহয়, মা’র হয়ত মাথা ব্যথা অথবা পেট ব্যথা করছে । একদিন দেখলাম, পানি-টানি মাথায় না ঢেলেই পাটীতে শুয়ে আছেন । আমাকে কাছে ডেকে বললেন, বাপরে, কি খেতে মন চায় ? আমি বললাম, কিসসু না ।
মা কঁকিয়ে কাঁদছিল । আঁচলে চোখ মুছে বললেন, তোকে তো কোনদিন একবেলা ‘পোলোয়া-ভাত’ও আমি রেঁধে খাওয়াতে পারলেমনা রে বাপ ! গোস্ত দিয়ে ‘পোলোয়া-ভাত’ খাবি ? গোস্ত চিনি । ‘পোলোয়া-ভাত’ কি জিনিস আমি তখনও চিনিনা । বললাম, খাবো না । মটরের ডাল, শুকনো মরিচের ‘আলু-ভততা’ আর ডিম ভাজি দিয়ে গরম ভাত আমার পছন্দ । মা জানে । সেদিন সারাদিন খাওয়া হয়নি । আমি বললাম, ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাবো । মা বললো, মুরগির চামড়া, পা-পাখনা, লেজের-পুটলি যদি দেই, খাবিনে ? আমি খুশিতে বাগবাগ । এ গুলো আমার জন্যে তখন ছিল রসনা বিলাস ।
বাড়ির ডিমপাড়া মুরগি কখনো কখনো বিরাম হয়ে ঝুমলে মা জবাই দিয়ে ভাজা-ভাজা করে রেঁধে দিত । আমি জানতাম, পৃথিবীতে এর চেয়ে ভালো খাবার আর নেই । আব্বু থামলেন । কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আমিও চুপ ।
পিনপতন নিরবতা ভেঙে এবার আব্বু বললেন, হঠাৎ কঁকিয়ে উঠে মা আমাকে চেপে ধরলো । বুকের মধ্যে তখন তার হাঁফড় টানছে । মাথা-মুখ-বুক ঘামে ভিজে যাচ্ছে । চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মা’র । কোনমতে বললো, ভয় পাসনে বাপ আমার । তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আয়, পানি নিয়ে আয়– আমি দৌড়ে গিয়ে হাঁড়ি থেকে কাঁসার বাটিতে করে পানি এনে দেখি, মা ঘাড়ি ভেঙে পড়ে আছে । এত ডাকলাম, কথা বললো না । একটু নড়লোও না মা ।
আমার এখনো মনে আছে, মা’র পিঠের উপর পড়ে আমি তখন কেঁদে কেঁদে চিৎকার করছি, আর মা মা বলে ডাকছি … আব্বু আর কথা বলতে পারলেন না । একদম চুপহয়ে গেলেন । নিজেকে নির্দয় আর নির্মম মনে হলো আমার । খুব খারাপ লাগছিল । বোবা হয়ে বসে রইলাম । আব্বুর কষ্ট আমাকে স্পর্স করলো । আমার চোখেও পানি চলে এসেছে । আব্বু আবার কথা বলে উঠলেন, সিমি,মা, খুব ভালোলাগছে এখন । এই প্রথম তোর দাদীর কথা শেয়ার করার সৌভাগ্য হলো আমার । তারপর হঠাৎ করেই আবার হেসে বললেন, একদিন তুই নিজে আলুভর্তা দিয়ে ডাল-ভাত রেঁধে খাওয়াবি নাকি আমায় ?
আমি ওড়নায় চোখের কোনা মুছে বললাম, এবার নয় ; যেদিন মনোহরদীপুর যাবো সেদিন । আব্বু আমার কপোলে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, মাই হেভেন ! অনেক রাত হয়েছে মা । ঘরে যা । আমি ছোট্ট মেয়ের মতো গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আমার ঘরে চলে এলাম ।