শিশু মানেই গৃহের সারা বাড়িতে এক টুকরো আনন্দের ঝলক, শিশুমনের একটা নিষ্পাপ আত্মার সম্মুখ বিচরণ, শিশু মানেই সুন্দর ভবিষ্যতের একটা আগমনী বার্তা। শিশু মানেই সবার মনে আনন্দ লাগিয়ে দেয়ার একটি মিস্টি ছবি। শিশু মানের সবার আনন্দের একটি ছোট্ট পোষা ময়না পাখি বা একটি আদরের তুলতুলে পশমওয়ালা বেড়াল। কিন্তু আজকের এই করোনাবিধৌত বিশে^ শৈশবে একটা শিশুর বেড়ে উঠবার জন্য যে খেলাধুলা বা বিনোদনমুলক পরিবেশ থাকা দরকার সেটা কি আমরা দিতে পারছি? এককথায় একেবারেই না। বিভিন্ন ধরণের বিধিনিষেধ ঘিরে রয়েছে তাদের চারপাশে।
এখন এই করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াতে তাদের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত এটা অস্বীকারের কোন কারণ নেই। বিভিন্ন শিশুবিশেষজ্ঞ এই পরিস্থিতিকে লালসংকেত মনে করছেন। ভুলে গেলে চলবে না শিশুদের বড়দের মতোই মহামারি নিয়ে দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা কাজ করে। বড়দের দুশ্চিন্তার রেশ ছোট মনে প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল ২ মিনিটের জন্য ফোনে কথা বলা ও স্ক্রিনের মাধ্যমে কোন কিছু প্রতিফলিত হলে শিশুমস্তিষ্কের অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ পরিবর্তন হয়ে যায়। মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপটি মেজাজের ধরণ এবং আচরণগত প্রবণতার পরিবর্তনের ফলে শিশুদের নতুন জিনিস শিখতে বা সঠিকভাবে তাতে মনোনিবেশ করতে সমস্যা হয়। শিশুদের অতিরিক্ত জেদ, অসামাজিকতা ও খিটখিটে মেজাজের অন্যতম প্রধান কারণ এখান থেকেও শুরু হতে পারে।
আজকের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় জন্য এবং করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার কারণে সব শিশু চারদেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে আছে। আর তারই প্রভাব পড়ছে তাদের মানসিক অবস্থানের ওপর। তারা নিজেদের নিজস্ব চিন্তা বা মানসিকতার আদান প্রদান সাধারণত তাদের সহপাঠীদের সাথেই করে থাকে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তারা বড়ই অসহায় অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে। আর এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে তাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন মাধ্যম যেটাকে স্ক্রিন আসক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ভিশনে শিশু ও তরুণদের অংশগ্রহণে “চিল্ড্রেন ভয়েজেস ইন দা টাইম অফ কভিড-১৯’ শিরোনামে এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে ৯১ শতাংশ শিশু মানসিক চাপে রয়েছে। তারা তাদের দিক দিয়ে নানা ধরণের সীমাবদ্ধতায় রয়েছে। তাতে করে, শিশুরা এই পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। মহামারির সময়ে জীবনের ছন্দপতনের জন্য সরাসরি তিনটি কারণকে উল্লেখ করেছে শিশুরা। কারণগুলো হলো Ñ শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক বেদনা এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া।
স্ক্রিন আসক্তি বা লিকুইডিফায়েড ক্রিস্টাল ডিপ্লে-তে অতিরিক্ত নেশা (বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর ডিভাইস আসক্তি) এটা একটি লাল সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে বর্তমান সময়ে। আসুন জেনে নিই স্ক্রিনআসক্তিটা কি? এটা সাধারণত স্মার্টফোন, ট্যাব, টিভি, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আসক্তি থেকেই এটার নামকরণ করা হয়েছে স্ক্রিন আসক্তি।
এই স্ক্রিন আসক্তির ফলে শিশুদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ। তবে বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে দেরিতে কথা বলার সমস্যা এবং অন্ধত্ব। আরো কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে যা আরো পরে শিশুদের মাঝে দেখা যাবে।
শিশুদের মধ্যে অন্ধত্ব বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটা শিশুর বড় হওয়ার সময় পারিপার্শ্বিক যে পরিবেশ থাকা দরকার সেটা তারা পাচ্ছে না, তারা বাইরের যে আলোর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে সেই স্বাভাবিক আলোর অভাব দেখা দিচ্ছে তাদের বিভিন্ন ডিভাইসের কারণে। এটি সৃষ্টি হচ্ছে, আর্টিফিসাল বা কৃত্রিম আলো যেটা চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ, তার জন্য। পরিশেষে তারা অন্ধত্ববরণ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ৫ থেকে ১১ বছরের ২৫% শিশু আছে অন্ধত্ব বা ক্ষীণদৃষ্টির ঝুঁকিতে। ক্ষীণদৃষ্টির পেছনে জেনেটিক কারণ থাকলে ও বর্তমানে এর যে বিস্তার ঘটছে তার জন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও জীবন যাপনের ধরণকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শিশুরা এখন একেবারে অল্প বয়সে স্কুলে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশুনা, স্মার্টফোন ব্যবহারসহ নানাধরনের কাজ করছে। শিশুদের বাইরে বের হ্বার সুযোগ কমে গেছে। দূরের কিছু না দেখতে দেখতে তাদের চোখ অলস হয়ে পড়ছে। এতে করে তাদের দৃষ্টিশক্তির ওপর নানাধরণের হীনমন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং দৃষ্টিশক্তি পারিপাশির্^ক অবস্থার সাথে বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলছে।
বছর দুই আগে কিশোরগঞ্জে স্কুলগামী সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থীর ওপর একটি গবেষণা চালান সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের অপথালমোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা। ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের ওপর পরিচালিত ওই গবেষণায় ১৫ শতাংশের চোখে সমস্যা ধরা পড়ে। এরমধ্যে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা ধরা পড়ে ৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সুত্র অনুযায়ী ২০% শিশু আছে কথা না বলতে পারার ঝুঁকিতে রয়েছে। কথা না বলতে পারার প্রধান কারণ বিভিন্ন ডিভাইসে তাদের মনোনিবেশ খুব গাঢ় থাকে। যার কারণে তারা শ্রবণ প্রতিবন্ধি থেকে বাকপ্রতিবন্ধি হয়ে যাচ্ছে। ছোট একটা বাস্তব ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। বান্ধবীর মেয়ে রিদিমার বয়স ২ বছর ৭ মাস। ওর বাবা ও মা রিদিমাকে ডাকলে উত্তর দেয় না বা, মোবাইল ট্যাব ডিভাইস থেকে চোখ সরায় না। ওরা কিছুদিন খেয়াল করে দেখলো তাদের মেয়ের কথা বলার স্বাভাবিক বয়স পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কথা বলে না কেন, কথা বলার চেষ্টাও করে না, সব ইশারাতে করে। রিদিমার বাবা মা আর দেরি না করে সাথে সাথে শিশু ডাক্তারের দারস্থ হলো তাকে নিয়ে। এখন তাদের কিছু সচেতনতা ও প্রচেষ্টাতে রিদিমা কিছু কথা বলে। চিকিৎসক বলেছেন, আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তণ হয়ে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওইয়ানলাইট ইনিস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও সভানেত্রী শারমিন আহমেদ শিশুদের মোবাইল আসক্তি কমানোর উপায় সম্পর্কে জানিয়েছেন, মোবাইল নিয়ে শিশুদের আসক্তির (স্ক্রিন এডিকশন) ফলাফল শুভ নয়। এই অবস্থা থেকে শিশুদের সরিয়ে আনতে হবে। তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে বিচরণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
১০ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের জরিপে দেখা গেছে তারা আছে সাইবার ক্রাইমের ঝুঁকিতে। করোনার সময় এই সমস্যা আরও বেড়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আমরা টিভিতে বা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দেখতে পাই প্রযুক্তির কারণে কিশোর ক্রাইম মানসিকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
একবার ভাবুন তো বাচ্চারা, তাদের ডিভাইসনির্ভর বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলছে এবং একে অন্যেকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে, এটা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। এমন নিষ্পাপ বাচ্চাগুলো নিজেরাও জানে না নিজদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করবার বদলে কোন ভবিষ্যতের হাতছানি দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাচ্চাদের মধ্যে হতাশা এবং অ্যানোরেক্সিয়ার কারণগুলির সাথে স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং ইন্টারনেটের সাথে নিবিঢ় সংযোগ রয়েছে। যেহেতু এটির মাধ্যমে বাচ্চারা ধোঁকা দেওয়া এবং প্রায়শই নিরীক্ষণের কাজ করে, তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমনটা চলতে থাকলে গোটা সমাজ সেইসাথে গোটা বিশ্ব একটা মেধাশুন্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। জাতির ভেতর সৃষ্টি হবে মেধাশূন্য অন্তসারশূণ্য একটি ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠী।
এই করোনাকালে শিশুদের রক্ষার জন্য বাবা মায়েরা তাদের বাইরে বের হতে বারণ করছে। বলা চলে কঠোর শাসনের মধ্যে রাখছে। সহপাঠী বা পাশের বাড়ির বন্ধুদের সাথে মিশবারও সুযোগ দিচ্ছে না। তাতে করে তারা ভীষণভাবে গৃহবন্দি হয়ে পড়ছে। বাবা মায়েরা অনেক সময় তাদের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। তখন শিশুরা হাতের কাছে পাওয়া সেলফোনে বা অন্যান্য ডিভাইসে নিজদের ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করে এবং এভাবে সময় পার করার সুযোগ পায়। তারা এসব ডিভাইসে আস্তে আস্তে আসক্ত হয়ে পড়ে কারণ, যে কোন একটি অ্যাপে গিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো খেলা বা গেম পায়। ধীরে ধীরে এসবে তারা আসক্ত হয়ে পড়ে, ভুলে যায় বাইরের আলো-বাতাসের পৃথিবী।
পরিশেষে বলা যায় পূর্ণাঙ্গ সমাধান বলে কোন কথা হয়ত নেই এমন এলার্মিং সময় কিন্তু বাবা মায়ের কিছু সচেতনতা এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন আইন বিভাগের সচেতনতা প্রতিকার করতে না পারলেও পারবে প্রতিরোধ করতে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট