বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
দৈনিক আজকের সংবাদ পত্রিকার সংবাদ পড়তে এখন থেকে আমাদের নতুন ওয়েবসাইট www.dailyajkersangbad.com ভিজিট করুন। টাংগাইল বন বিভাগের দোখলা সদর বন বীটে সুফল প্রকল্পে হরিলুট আগ্রাবাদ ফরেস্ট কলোনী বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেন মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী ফৌজদারহাট বিট কাম চেক স্টেশন এর নির্মানাধীন অফিসের চলমান কাজ পরিদর্শন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে: শেখ সেলিম সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র চলছে সীমাহীন অনিয়ম এলজিইডির কুমিল্লা জেলা প্রকল্পের পিডি শরীফ হোসেনের অনিয়ম যুবলীগে পদ পেতে উপঢৌকন দিতে হবে না: পরশ নির্বাচন যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পেশি শক্তির মানসিকতা পরিহার করতে হবে: সিইসি

 নীলরং প্রজাপতি -আমজাদ হোসেইন 

নিউজ ডেক্স:
  • প্রকাশিত সময় : শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০২২
  • ৬৩৫ পাঠক পড়েছে

 নীলরং   প্রজাপতি

                             আমজাদ হোসেইন 

এসো । এসো সিমি । চলো, আমরা ওইখানটায় গিয়ে একটু বসি । লীজা’পা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অনতিদূরের একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের বেদী দেখিয়ে বললেন । এক মিনিট আগে এজায়গাটি ছিল হৈ চৈ, হুল্লোরে সরগম । আমাকে দেখা মাত্র আমার আগমন পথের দিকে চেয়ে লীজা’পা কি মন্ত্র পাঠ করলেন ; মন্ত্র পাঠ শেষ না হতেই দেখি মাঠ ফাঁকা — গড়ের মাঠ । দৃশ্যটি আমার ভাল লাগলো না । বললাম, এখানে তো এখন কেউ নেই আপা, এখানেই বলেন শুনি ?বসবেনা একটু, দাঁড়িয়েই কথা বলবে ?
আমি কোন জবাব দিলাম না । আপা স্বগোক্তির মতো করে চাপা স্বরে বললেন, ঠি-ই-ক আছে । তারপর বললেন, আমি কেন তোমাকে ডেকেছি, আন্দাজ করতে পারো? হ্যাঁ, পারি । বলো দেখি ?আপনি ভয়ানক কিছু বলবেন আমাকে । লীজা’পা খিলখিল করে হেসে উঠলেন । সিনেমায় দেখা রানী সরকারের মতো । হাসি থামলে বললেন, না । ভয়ানক কিছু বলবো না । আমি তোমাকে একটি শুভ সংবাদ দেব । চোখ তুলে তকালাম লীজা’পার চোখের দিকে । শুকনো মুখে চেয়ে রইলাম । লীজা’পা বললেন, শুনেছ মনেহয়, আবীরের বিয়ে ? আজ বুধবার । আগামি রোববার ।
কোনও যৌক্তিক কারণ ছিলনা অথচ তাই হলো । বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠলো । মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল আমার । শক্তি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম । কোনও রকম জড়তা ছাড়াই একটু হাসবার চেষ্টা করে বললাম, শুভ কামনা । খুব সূক্ষ্ম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন লীজা’পা । সূক্ষ্ম করেই হাসলন । বললেন, তুমি কি জানো কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আবীরের ? আমি বললাম, জানি । আপনার সঙ্গে । মেয়ে তুমি তাও জানো ? জানতাম না । এই মাত্র জানলাম । লীজা’পা অবাক হয়ে বললো, কি ভাবে জানলে ? বিয়ের কথা যাকে শোনাবার জন্যে এত আয়োজন, সে যদি এই বেলা কিছু না-ই বুঝতে পারলো তাহলে আপনার চলবে কেন ? ঠিক বলেছ, চলবেনা । তাহলে তো তুমি এ কথাও জানো যে, এই কথাটা তোমাকে বলার জন্যে আমার এত পেরেশানি কেন ?আমি চুপ করে রইলাম ।
আপা বড় করে একটা শ্বাস ছাড়লেন, বললেন, আমি দেখতে ভালো নই, মোটা —  খাই বেশি, পয়সা ওড়াই, উচ্ছৃংখল । আমি জানি, আমাকে আবীর পছন্দ করেনা । বিগত চার বৎসরেও আমি তার হদীস পাইনি । অথচ একদিনের দেখাতে সে ভালোবেসে ফেললো তোমাকে — কী ভাগ্য তোমার ! আমার হিংসা হয় । প্রতিদিন দেখি, আবীরের খোঁজে তুমি ক্যাম্পাস চষে বেড়াচ্ছো । আবীর তখন তার অসুস্হ মা’কে নিয়ে ঢাকায় । সব জেনেশুনেও তুমি আমার কাছে আসছো না । ভাবলাম তোমাকে একটা দাগা দেওয়া দরকার । সেই সুযোগটা পেয়ে গেলাম আজ । এইটুকু বলে লীজা’পা চুপ করে রইল । একটু বাঁকা করে হাসলো । অহংকারের হাসি । আমি ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে ছিলাম । নড়তে পারছিলাম না । চলে যেতেও পারছিলাম না । ফেলফেলিয়ে চেয়ে ছিলাম ।
সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে লীজা’পা বললেন, টাকার একটা ক্ষমতা আছে, জানো ? আবীর সেটা মানতে চায়না । শুনেছি তোমার কাছেও টাকার দাম নেই । কিন্তু টাকা দুনিয়া উল্টে দিচ্ছে, আবার সোজা করছে । রাজা-গজা, ফকির-আমির টাকার গুনে পরিচয় । আদিকাল থেকেই ভালোবাসা বিকোচ্ছে টাকায় । মমতাজের ভালোবাসা দিল্লীতে তাজমহল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাকায় । এই বলে লীজা’পা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো । হাসির গমকে তার সারা শরীর কাঁপছে । হাসির মধ্যেই বললো সে, আমিও কিনে নিলাম আবীরের ভলোবাসা । কোটি টাকায় । অনেকটা ক্ষ্যাপাটে মনেহচ্ছে লীজা’পাকে । এমনিতেই সে জিদ্দী । কিন্তু আজ এই ক্ষেপুনি তার মনের ঝাল  ঝাড়ছে আমার  উপরে কেন — আমি অনুমান করতে পারছি, হয়ত ভালোবাসায় তার নিজের ব্যর্থতা এমন টগবগিয়ে দিয়েছে তাকে । বোধকরি এর নামই আত্নশ্লাঘা । জ্বলেপুড়ে মরা ।
চুপ করে রইলাম । এর শেষ দেখা দরকার — শেষ পর্যন্ত কি বলে সে, শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে । অ্যাই মেয়ে, তুমি বিরক্ত হচ্ছো নাকি ?  না, আপা — তাহলে কথা বলছো না যে ? বলেন আপনি । শুনছি । আপা বললেন, ঢাকা থেকে ফিরে এসে হন্যে হয়ে খুঁজে আবীর আমাকে পুকুর ঘাটে ধরে নিয়ে গেল । আমার মুখের দিকে তাকলো না সে । শান্ত হয়ে বললো, আমাকে সে বিয়ে করতে  চায় । এক শর্তে । জানতে চাইলাম, কি শর্ত ? আবীর এবার আমার মুখের দিকে এক পলক  চেয়ে মাথা নিচু করলো । মন খারাপ করে বললো, মা বেশ অসুস্হ । ইমিডিয়েট তার একটি কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করা দরকার । ভাল কোন হাসপাতাল হলে ভাল হয় ।
আপা বললেন, আমার কী হলো জানিনা । কোন বুদ্ধি মাথায় খেললো না । চিন্তা করার সুযোগ পেলাম না । সময়ই হলোনা যেন । তাড়াহুড়া করে বললাম, ভাল হাসপাতাল মানে কি –এলিজাবেথ হাসপাতাল হলে কি কোন সমস্যা আছে ? তা নেই ; কিন্তু — আপা বললেন, আমি আবীরকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিলাম না । প্রায় দৌড়ে চলে এলাম রুমে । বলে এলাম, চিন্তা করোনা, একটা ব্যাবস্হা হয়ে যাবে অবশ্যই । লীজা’পা একটু থেমে বললেন আবার, আব্বুর ঘনিষ্ট জন, বন্ধু-বান্ধব সব মন্ত্রী-মিনিষ্টার । তারা চেষ্টা করতে লাগলো যেন দ্রুত কাজটা হয় । তারপরেও হাসপাতালের এডমিশন ডেট কনফার্ম করতে লেগে গেল চার দিন । অবশেষে আগামিকাল বেলা বারোটায় এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় এবং তারপর সিঙ্গাপুর । একদমে কথাগুলো বলে আপা থামলেন । হাঁপাচ্ছেন । একটা ইম্প্রেশন । ধকল । আপা ঘেমে গেছেন । ওড়না দিয়ে মুখ-চোখ মুছে ফেললেন ।
আমি নির্মম শ্রোতা । কিছু করার নেই । কিছুই বলার নেই । অসহায় ভঙ্গীতে চোখ নামিয়ে আমার শুধু দাঁড়িয়ে থাকা মাত্র ।
লীজা’পা হঠাৎ চড়া গলায় বলে উঠলেন, পৃথিবীটা টাকার গোলাম, বুঝেছ ? সেখানে কপর্দকহীন আবীরের কী দাম ! তোমার এত ভালোবাসা — যাও, তোমার ভলোবাসা দিয়ে এবার আবীরকে ফেরাও দেখি ? আপা চেটাং-চেটাং কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না । হণ্ হণ্ করে হেঁটে এডমিন বিল্ডিং’এর আড়াল হয়ে গেলেন । একটা বেদনাপ্লুত অপমানে আমি সেইখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললাম ।
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল । ঘুমের মধ্যে ভুলে যেতে চেয়েছিলাম সব । কিন্তু ঘুম ভেঙেই হলো বিপত্তি । আবার কানে বাজতে থাকলো এলীজা আপার সেই রূষ্ট-রুক্ষ কন্ঠস্বর । বাক্যবান । অপমান । কপর্দকহীন আবীর ! কী দাম তার ? আমি জানি, এক সময় তার এ টাইটেল বদলে যাবে । টাইটেল হবে ফকির । বস্তি থেকে উঠে আসা ছোটলোক । ওয়ার্থলেস । কোন কথার তখন প্রতিবাদ করা যাবেনা । কারণে-করনে, অকারণে বিভক্তি শুধু বেড়েই যেতে থাকবে ; বেঁচে থাকাটাই আবীরের কাছে তখন মনে হবে অযথা — সময়ের অপব্যয় ।  আমার বাবার অতীত ছিল যেমন । এক সময় সমঝোতার প্রচেষ্টায় হাত দু’টোকে ঢোকাতে হবে নর্দমায় । ঘাঁটতে হবে নোংরা । তবু শেষ রক্ষা হবেনা বহুদিন । বহুদিন । অথবা শেষরক্ষা হবেইনা কোনদিন ।
অথবা ভাগ্য ভালো হলে এরই মাঝে বিষবাষ্পে ফুঁসে ওঠা জীবনে অবশেষে একদিন হয়তো আগ্নেয়গিরির জন্ম হবে, বিস্ফোরণে ভেসে যাবে পুঞ্জীভূত আবর্জানা ; আমার বাবার সংসারের মতোন । আমি তখন কোথায় থাকবো ? হয়তো বিস্মরণে পড়ে থাকবো ধূলোমলিন কোন এক ঝাপসা স্মৃতির পাতায় । অবহেলে ।
সহসা মনেহল, আমি এসব কি ভাবছি ? আবীরকে নিয়ে আমার এখন এমন ভাবনা মোটেই উচিৎ নয় । তবে একটা কথা — কেন যেন আব্বুর কথা মনে পড়লেই আবীরের কথা মনেহয় আমার । আমার বাবার জীবনের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আবীরের জীবনের সাদৃশ্য আছে এবং দু’জনার চারিত্রিক বৈশিষ্টে আবার কিছু পার্থক্যও আছে । বাবা  মূলত নরম মানুষ । কিছুটা আবেগী । আবীর দৃঢ় মানসিকতার । শক্ত । ধনুকভাঙা স্বভাব তার । অন্যায়ের সাথে সমঝোতা, আপোষ আবীরের ধাতে একেবারই নেই । কঠিন বাস্তবানুগ সে ।
সেই চানক্য পুরুষ নিজের বিশ্বাস আর সংস্কারে গড়া প্রবল ব্যাক্তিত্বকে এত সহজে বিসর্জন দিলো কি ভাবে — সারা বিকেল ভেবেও বিষয়টি আমার বুঝে আসেনি । অর্থের সংস্হান কি অন্য কোনও ভাবে ম্যানেজ করা যেতনা ? হেঁট হয়ে অতি সহজ উপায় তাকে বেছে নিতে হলো কেন ? আমার ভূলটি ভাঙলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই । মনেহলো, এইসব যা কিছু ভাবছি আমি, সেসব বোধকরি আমার অভিমানের কথা । আবীরের প্রতি আসলে এভাবে অভিমান করে লাভ নেই । পৃথিবীর বেশির ভাগ কষ্টগুলোর উৎস-ভূমি হলো অভিমান । আর বেশির ভাগ অভিমানের জন্ম হয় ভুল থেকে ।
আজ আবার নুতন করে আবিস্কার করলাম আবীরকে । পৃথিবীর সব মা তার সন্তানের জন্যে নিশ্চিত সুখ ত্যাগ করতে পারে, প্রাণও বিসর্জন দিতে পারে কিন্তু সব সন্তান মা’র জন্যে কি তা পারে ? কেউ কেউ পারে । আর কেউ কেউ পারার মধ্যে হয়ত আবীর একজন । হয়ত সে ভেবেছিল নিজেকে যখন বিসর্জন দিতেই হবে তখন বিপরীতে প্রাপ্যটুকু অল্প না হয়ে বিস্তর হলে ক্ষতি কি ! সিঙ্গাপুর হলে সমস্যা কি ? হতে পারে মা’কে বাঁচাতে তাৎক্ষণিক ভাবে সহজ উপায়টিকেই তার বেছে নিতে হয়েছে ?অবাস্তব তো কিছুই নয় । অতি কঠিন বাস্তব সেটা । অস্বীকার করবার তো জো নেই । আবীরের প্রতি  সমস্ত অভিমান আমার তিরোহিত হলো । রাত মনেহয় শেষ হয়ে এলো । দূরের কোন গাছে কাকের দল হঠাৎ কা কা করে ডেকে উঠে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো ।
আবছায়া অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগছিল না আমার । কেমন একটা নিষ্প্রান জড় জড় ভাব ; কেবলই অন্তর বিদ্ধ হচ্ছিলো কোথায় কী যেন একটা অসম্পূর্ণ থেকেই গেল । মনেহচ্ছিলো দুর্ভাগ্যের জটাজালে জীবনে একটা মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, মুখের উপরে অপবাদের খানিকটা ক্লেদ মাখামাখি হয়েই রইল । খুব চাইছিলাম এই অবস্হার অবসান হোক । কাকডাকা ভোরে আমি হল থেকে বের হলাম । কাচারীপাড়া যাবো । আবীর ভাইয়ের অসুস্হ মা’কে একবার চোখের দেখা দেখে আসবো । তার একখানা শীর্ণ হাত আমার মাথায় রেখে আশীর্বাদ চেয়ে নেব, জীবনে যেন আর কোন কিছুতেই আমার হাহাকার না থাকে, অপূর্ণতা না থাকে । একটি নির্মোহ জীবনের ভালোবাসা আমাকে যেন সারাজীবন পূর্ণ করে রাখে ।
কাচারীপাড়ার গলিপথ ধরে কিছুদূর এগুনোর পর অটোঅলাকে বললাম দাঁড়াতে । রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধ । তার চোখে গান্ধী চশমা । মুখখানা হা করে শিশুর মতোন তাকিয়ে আছে সামনে । উনাকে বললাম, আবীরদের বাড়ি কোনটা কাকা ? কোন্ আবীর ? পাবনা প্রযুক্তিতে পড়ে । কাকা ঠাওরাতে পারলেন না । বললেন, কি করে ? ছাওয়ালের বাপের নাম কি ?আমি বললাম, বাবার নাম রানু ।  মুক্তি যুদ্ধের সময় ওনাকে সবাই বাঘমামা বলে ডাকতো । বৃদ্ধকাকা মাথা চুলকে বললেন, অ অ অ — ঐযে, ঐ সামনে যান । সামনে গেলিপারে একটা কালভাট পাইবেননে । ঐ কালভাটের আগের বাড়িটাই, ভাঙা পাঁচিল ।
বাড়ি দেখেই বুঝলাম, এই বাড়ি । সদর দরজায় একটা কাঠের ঝাঁপি । সেটিও খোলা । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঢুকে পড়লাম ভিতরে । নিরব চারদিক । গাছ-গাছালির শুকনো পাতায় উঠোন সয়লাব । এহকালে রোদ ঢোকেনা বোধহয় । সকাল হয়েছে তবু আঁধার-আঁধার । বারান্দায় অনুজ্জল আলোর একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব ঝুলছে । বাড়ির তিন দিকে প্লাস্টার-বিহীন ক্ষয়ে যাওয়া পাঁচিল । কোথাও কোথাও উপর থেকে দু’চারখানা ইট খসে পড়েছে । ভিতরে চার চালার নিচে ছাপরা-বারান্দাসহ পাশাপাশি লাগোয়া তিনটা আধাপাকা ঘর — পশ্চিমে পাঁচিলের প্রয়োজন মিটিয়েছে । ছোট ঘরটি মনেহয় রান্না ঘর-টর হবে কিছু । বারান্দায় উঠে গিয়ে আমি অবাক হলাম । সবগুলা ঘরের দরজা-জানালা হা হয়ে আছে ।একটা ঘরে কেবল বেশ উজ্জল আলো । আমি দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাক দিলাম, আ- আবীর ভাই ! কোন সাড়া এলো না ।
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে গেলাম । সরাসরি ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম । আশ্চ্যর্য, আবীর ভাই তার মায়ের শয্যাপাশে টুল পেতে  বসে আছে মূর্তির মতন । যেন পাথর । মা নীমিলিত চোখে চাদর গায়ে একটা চৌকির উপর চিৎ হয়ে ঘুমোচ্ছেন । ঘুম ভেঙে যেতে পারে বলে শব্দ করে আমি আর কথা বলতে চাচ্ছিলাম না । তবু কেমন করে যেন একটু শব্দ হলো । আর তাতেই আবীর ভাই ঠান্ডা চোখে এক পলক আমার দিকে চেয়ে তর্জনী ঠোঁটে চেপে ধরে ইশারায় বললেন, চুপ । কথা বলা যাবেনা । বসো । আমি দাঁড়িয়েই রইলাম । বসবো কোথায় ? ঘরে বসবার কোন জায়গা নেই । শয্যা-শিয়রে একখানা মাত্র কাঠের চেয়ার । তাতে অষুধের বোতল, ষ্ট্রীপ,পানির গেলাস-জগ, চামুচ-পিরিচ, ডিমের খোসা । অগোছালো জিনিস-পত্রে ঘরখানা ঠাসা ।
নিস্তব্ধ সময়, গড়িয়ে যাচ্ছেই । আমি আবীর ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি অনেক্ষণ । আবীর ভাই তাকিয়ে আছে তার ঘুমন্ত মা’র দিকে । হঠাৎ চমকে উঠলাম । দেখি একটা নীল রং প্রজাপতি মা’র কপোলে আয়েশে বসে অনবরত দুই পাখা দুলিয়ে যাচ্ছে । মা’র চোখের পাতা, ভ্রু — নড়ছে না কিছুই । মুখখানা নিথর । আবীর ভাইয়ের বিষণ্ণ দৃষ্টি স্হির হয়ে আছে সেখানেই ।
অকস্মাৎ প্রজাপতিটি উড়ে এসে আমার মাথার উপরে বসলো । উড়ন্ত প্রজাপতিকে অনুসরণ করে আবীর ভাইয়ের দৃষ্টি আমার মুখের উপর গিয়ে স্হির হয়ে রইল । কেউই কোন কথা বললাম না । আমি মুখ ছাপড়ে নিলাম । বিশেষত আবীর ভাইকে আমি ঘাঁটাতে চাইলাম না । সে বসে থাকুক আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ । কিন্তু সময় বসে থাকলো না । সময় চুপিসারে অন্তর বিদ্ধ করতে লাগলো মূহুর্মূহু।
আমি বুঝতে পারছিলাম আবীর ভাই ব্যথার সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে । অতলে ডুবে যাচ্ছে । আবার ভেসে উঠছে । তার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিনা ।
প্রজাপতিটি আমার মাথা খামছে ধরেছে । অস্বস্তি লাগছে । ছোটবেলায় আব্বু বলেছিল, প্রজাপতিরা বেহেশতের ফুল । ওদের ভলোবাসতে হয় । আমি সর্বাত্বক চেষ্টা করছি নড়া-চড়া না করে চুপচাপ থাকার । আবীর ভাই আর একবার চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকালো । চোখদুটো লাল । ফোলা ফোলা । আজ বুঝলাম তাপে পাথরও গলে । আবীর ভাইয়ের চোখ থেকে দু’ফোটা পানি ঝরে পড়লো জামায় । একটা বুকফাটা কষ্ট কোনও রকমে চেপে সে বললো, কেউ রইলনা আমার । কেউ বলবে না আর, এখন তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো? আমার ঠোঁট কাঁপছিল । কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম । কিন্তু আমার বুকের কথা মুখে এলোনা কিছুতেই । সামান্য এগিয়ে গিয়ে আবীর ভাইয়ের মাথায় হাত রাখলাম । ক্লান্ত মাথাটি সে আস্তে করে এলিয়ে দিল আমার কাঁধে । পরম নির্ভরতায় তার সব ক্লান্তি যেন ঢেলে দিল সেখানে । আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ওঠো । অনেক কাজ । উঠে পড়ো ।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580