মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০১:২১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
দৈনিক আজকের সংবাদ পত্রিকার সংবাদ পড়তে এখন থেকে আমাদের নতুন ওয়েবসাইট www.dailyajkersangbad.com ভিজিট করুন। টাংগাইল বন বিভাগের দোখলা সদর বন বীটে সুফল প্রকল্পে হরিলুট আগ্রাবাদ ফরেস্ট কলোনী বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেন মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী ফৌজদারহাট বিট কাম চেক স্টেশন এর নির্মানাধীন অফিসের চলমান কাজ পরিদর্শন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে: শেখ সেলিম সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র চলছে সীমাহীন অনিয়ম এলজিইডির কুমিল্লা জেলা প্রকল্পের পিডি শরীফ হোসেনের অনিয়ম যুবলীগে পদ পেতে উপঢৌকন দিতে হবে না: পরশ নির্বাচন যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পেশি শক্তির মানসিকতা পরিহার করতে হবে: সিইসি

নীলরং প্রজাপতি

নিউজ ডেক্স:
  • প্রকাশিত সময় : শনিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২২
  • ৩৩০ পাঠক পড়েছে

নীলরং প্রজাপতি

                        আমজাদ হোসেইন 

গাড়ি-বারান্দার গেট তালাবদ্ধ । ভিতরের ঘরে উজ্জল আলো জ্বলছে । আশপাশের বাতাসে বিখ্যাত ব্রান্ডের পারফিউম এভেন্টাস’এর সুগন্ধ ভেসে আছে । মন ভালো থাকলে আব্বু ব্যবহার করেন । বেল টিপে অপেক্ষা করছি । দেরী হলোনা । আলো জ্বেলে আব্বু এসে গেট খুলে দিলেন । পিছনে এসে আম্মু দাঁড়িয়েছেন । তিনি দ্রুত এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ওরে আমার আম্মা, এসেচিস তুই ? এতদিন পরে আম্মুর কথা বুঝি মনে পড়লো তোর ? আমার মুখে কথা নেই । আমি স্বপ্ন দেখছি না তো ? বুকে জড়িয়ে ধরে এসব কথা কি আমার আম্মুই বলছে ? আব্বু বললেন, অনেকটা দূরের পথ জার্নি করে এসেছিস, পথে কোন অসুবিধে হয়নি তো রে মা ?  এতক্ষণ আমি কোন কথাই বলিনি । বলতে পারিনি । আম্মুর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পেয়ে বললাম, সমস্যা হয়নি আব্বু । ভালোভাবেই এসেছি ।
আব্বুর পরনে গরদের পাঞ্জাবী । এক ঈদে আব্বুর জন্যে শশী চয়েস করে কিনে দিয়েছিল । গায়ে জমিদারি ভাঁজে কাশ্মীরি আলোয়ান । মুখে খুশির হাসি । আরো অবাক হলাম আম্মুকে দেখে ; তার প্রানবন্ত সাজ । দুই কানের লতিতে ঝলমল করছে ডায়মন্ড ট্প । ম্যাচ করে শাড়ী পরেছেন আম্মু । আমি এসব কিছুই মেলাতে পারছিনা । তারপরও আমার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে । হঠাৎ মনেহলো, এ সবের সঙ্গে আমার বিয়ের এন্তেজাম জড়িত নয় তো ? এরা পাত্রপক্ষের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বের হয়েছেন অথবা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এইমাত্র ঘরে ঢুকেছেন — এমন নয় তো ? অসম্ভব কিছুই নয় । আব্বু মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা শশীর শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লা গেছিলাম রে মা । সেখান থেকে সবে ফিরলাম । শশীর শ্বশুর এক মজার মানুষ — আমি এরকম মানুষ কখনো দেখিনি ।চুপ করো তুমি । আম্মু ধমকে উঠলেন, মেয়েটা ঘরেই উঠলো না — উনি গাল-গল্প শুরু করে দিলেন । সিমি, আয়তো মা আয়, আমার সাথে আয় ।
আমি ক্ষণকাল দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম । পারলাম না । আম্মু শক্ত করে আমার একটা হাত ধরে রেখেছে ; ভিতরে টানছে । একটু ভাবছিলাম, আম্মুর চড়া কথায় আব্বুর কি মন খারাপ হলো ? মনেহয় না । এত তুচ্ছ কথায় এখন আর আব্বুর মন খারাপ হয়না । তাঁর হজম শক্তি প্রবল । তিনি বুদ্ধি করে ধীরে ধীরে সিন-আউট হয়ে যাবেন । এটাই তাঁর স্বভাব । আম্মু আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে গেলেন । চেঁচিয়ে বললেন, বক্কারের মা –বক্কারের মা শুনছো ? যাই আম্মা — লাগেজটা ছোট আপার রুমে নিয়ে যাও তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন আম্মু তার ঘরে । সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললেন, কিছু মুখে দে । শশীর শ্বশুর বাড়ির মিষ্টি । বক্কারের মা’কে বলে আসি দুই কাপ কফি দিক ।
আম্মু চলে গেলেন । অতি দ্রুত । ব্যস্ত-সমস্ত সে । মোটা মানুষ । এমনিতেই তার নড়া-চড়া শিথীল — ঢিলেঢালা, গম্ভীর এবং গজেন্দ্র গামিনী । এতকাল আম্মুকে সে রকমটাই দেখে আসছি আমরা । এই আম্মুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই । বাসায় আসা অবধি শুরু হয়েছে আমার অবাক হবার পালা । কিন্তু তার যথার্থ কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা আমি । কি চিন্তা করবো — বিমূঢ়তাই তো কাটছে না আমার! এরই মধ্যে আম্মু ত্রস্ত পায়ে আবার ফিরে এলো রুমে । সঙ্গে বক্কারের মা । তার হাতে ট্রে — ট্রে’তে দই, মিষ্টি, পানি আর কফি । আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বক্কারের মা চলে গেল । অনেকদিন পর বক্কারের মা’র মুখে হাসি দেখলাম । আম্মু বললেন, খেয়ে দেখ্ । মাতৃ ভান্ডারের মিষ্টি । শশীর শ্বশুর এক গাড়ী ভর্তি করে শুধু খাবার  দিয়ে দিয়েছে । বললাম, আম্মু, তোমাদের এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা । আমি কিছুই খাবোনা এখন । পরে খাবো । এখন কফি খাবো । ঠিক আছে, তাই খা । গরম কফি । চুমুক দিতেই আরাম । চুপচাপ খাচ্ছি আর আম্মুর দিকে তাকাচ্ছি । আম্মুকে আনন্দিত মনে হচ্ছিলো ।
আম্মু বললো, ওরা অনেক ধনী মানুষ মা । বিশাল বাড়ি । গেটটিও সেই রকম — রাজার বাড়ির গেট । আমি এই সব গল্প শুনতে চাচ্ছিলাম না । কিন্তু মুগ্ধ শ্রোতার মতো ভাব করছিলাম । আমি ভাবছিলাম অন্য কথা । এই সুমতি হলো কি ভাবে — এঁদের হঠাৎ শশীদের ওখানে যেতে ইচ্ছে হলো কেন ?  আম্মু তার খুশির গল্প বলেই চললো । হেসে হেসে বলছিল, সুন্দর গেট দেখে আমরা গেটেই নামলাম । হেলাল গাড়ি ভিতরে নিয়ে গেল । সাদা মার্বেল পাথরের গেট । রোদে ঝকঝক করছে । কিন্তু আমার চোখ আটকে গেল বিরাট একটা ভূলের ওপর । এ পর্যায়ে শ্রোতা  অন্য কেউ হলে –আমি সিওর, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করতো, কি রকম ভূল ? আমি করলাম না। আগ্রহে শুধু কৌতূহল জিইয়ে রাখলাম । আম্মু বললো, ভূলটা ভালভাবে আমিই আগে দেখলাম এবং পরে তোর আব্বুকেও দেখালাম। গেটের মাথার উপর সবুজ পাথর কেটে লেখা ‘রায়হান লস’ ।
অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে আম্মু বললো, এইটা কোন কথা — এত বড় বাড়ির মালিকের এইটা কোন কাজ হয়েছে ? একটা গ্রেট মিসটেক । কিন্তু আমাদের ভুল ভাঙলো রায়হান সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর । মাওলানা মানুষ । বিষয়টি বলার সাথে সাথে তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার । এইটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি বিয়াইন সাহেবা ।  আল্লাহর ইচ্ছে ছিল এমন । সেবার আমি যখন ঢাকায় যাই, মিস্ত্রিকে চোখ-কান খোলা রেখে সবকিছু সতর্ক হয়ে করার জন্যে বলে যাই । দু’ দিন পর ফিরে এসে দেখি মিস্ত্রি ভূল করে বসে আছে । ‘রায়হান লজ’ হয়ে গেছে ‘রায়হান লস’ । রাতে বিছানায়  শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, দুনিয়ায় মানুষের জন্ম নেওয়াটাই তো এক চূড়ান্ত লস । চিন্তা করে দেখুন, মরার সঙ্গে সঙ্গে হিসাবের খাতা খুলে যাবে । জন্ম নিয়ে এই ঝঞ্ঝাটের কোন প্রয়োজন ছিল ? আফসোস, জন্মটা আমাদের হাতে নয় । এইটা আল্লাহর কুদরতি এখতিয়ার । গোনাহগার বান্দা আমরা । আমাদের জন্যে সবই লস । লস — অগাধ টাকা-পয়সা থাকা, লস বেশিদিন বেঁচে থাকা । সবই লস ।
রায়হান সাহেব একটু থেমে মৃদু হেসে আবার বললেন, আমি মেনে নিলাম, তা বাড়ির নাম হলোইবা ‘রায়হান লস’ । মনেহলো মিস্ত্রি খুব একটা ভুল কাম করেনি বিয়াইন সাহেবা, শুদ্ধ কাম করেছে সে । এই বাড়ির নামে আমাকে এখন সবাই শুদ্ধভাবে চেনে । বলে, লস রায়হান । আলহামদুলিল্লাহ । এই পর্যন্ত বলে আম্মু বিগলিত হয়ে হাসতে লাগলো । বেশ একটা ইন্টারেষ্টিং বিষয় । আমিও আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তার হাসি দেখছি । হাসতে হাসতেই আম্মু বললো, আমি তো হেসে বাঁচিনে সিমি । লোকটা পাগল নাকি ! কিন্তু তোর আব্বু হাসছে না । কাঠের পুতুলের মতোন মুখ গোমরা করে বসে আছে । রায়হান সাহেব বললেন, এইটা হাসির বিষয় নয় বিয়াইন সাহেবা । আমার এত টাকা-পয়সা, সয়-সম্পদ — আমার খুব সমস্যা । জানেন তো, এসবে শুধু লোভ, মায়া, অহঙ্কার আর অশান্তি । শেষমেষ সব ফেলে-টেলে ন্যাংটো হয়ে যেতে হবে একদিন । দুনিয়ায় এত সব থেকে তাহলে লাভ কি হলো বলেন ? সবই তো দেখি লস, লোকসান !
আবার একটু থেমে তিনি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন, কাদের জন্যে আমি এসব রেখে যাবো বিয়াইন সাহেবা ? আমার তিন পুত্র ।নাআ’উজুবিল্লাহ, তিনো জনাই ইবলিসের সর্দার । একজন জুয়ার আসরে রাত-দিন শুয়ে থাকে — ঘরে আসেনা । একজন মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে — বাড়ি চেনেনা । আর একজন নিখাদ খচ্চর । হিন্দী ভাষায় যাকে বলে ‘উল্লুককে পাঁঠে’ । শেষ বাক্যটি বলে আম্মু উদভ্রান্তের মতো আবার হাসতে শুরু করলো । হাসলাম আমিও । হাসির গল্পে আম্মুর নেশা ধরে গেছে । হেসে হেসে আম্মু বলতে লাগলো, দেখলাম রাগে বিয়াই সাহেবের ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে জ্বলছে । মুখের সামনে মুষ্টিবদ্ধ তর্জনী তুলে ধরে তিনি চাপা স্বরে বললেন, আল্লাহু আকবার । আল্লাহসুবহানাতা’লা তাওফিক দিলে এবার আমি শেষবারের মতো হজ্বব্রত পালন করতে যাবো এবং ফিরে এসে দুমুঠো ভাত খাওয়ার সংস্হান রেখে আমার সব অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে নবী নগরে আমার মায়ের কবরের পাশে একটা পূর্ণাঙ্গ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবো । সেখানে দুস্হ আর ইয়াতিম প্রতিপালনের এন্তেজাম থাকবে ইনশাআল্লাহ্ । থাকবে বড় পরিসরে কোরআন গবেষণার সুযোগও । আপনারা এলেমদার মানুষ । আমার জন্যে দিলখোশ দোআ করবেন ভাই ।
রায়হান সাহেব মুছাবা করার জন্যে তোর আব্বুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন । তোর আব্বু উঠে দাঁড়ালো  । এতক্ষণ সে কোন কথাই বলেনি । তাকিয়ে দেখি তার মুখখানা থমথমে । রায়হান সাহেবকে তিনি বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন । আর্দ্র কন্ঠে বললেন, ভাই সাহেব, আপনিও আমাদের জন্যে দোয়া করবেন । এরপর গল্পে আর হাসি থাকেনা । গল্প এখানেই শেষ হবার কথা ।  কিন্তু আম্মুর মুখে হাসি লেগে আছে । তিনি কেমন করে যেন হেসে ঠোঁট উল্টে বললেন, আবেগে বেবাক পাগল আরকি !আশ্চর্য্য, আম্মু মুরব্বী মানুষটির কথার কোন দামই দিলোনা ।
যা হোক, আমার ফ্রেস হওয়া দরকার ছিল । তাছাড়া এতক্ষণ আমি যে আশায় বসে ছিলাম আম্মুর সামনে, সে কৌতূহলও আমার মিটলো না ।আমি উঠে আমার ঘরে চলে গেলাম । বলে গেলাম, রুমে গেলাম । সুইচ অন করে দেখলাম শাওয়ারে গরম পানির প্রবাহ আছে । লোভ হলো । এই ঠান্ডায় গরম পানিতে ল্যাভেন্ডার সৌরভের জেল মেখে শান্তি করে শাওয়ার নেয়া যাবে । প্রায় এক ঘন্টা পর ওয়াসরুম থেকে বের হলাম । চনমনে গরম শরীর, ঠান্ডায় বেশ লাগছে । মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে বিছানায় চিৎপটাং শুয়ে কিছুক্ষণ আরাম উপভোগ করছিলাম । বক্কারের মা রুমে ঢুকতে এসে আমার অবস্হা দেখে মুহূর্তেই আবার পিছিয়ে পর্দার ওপারে গিয়ে দাঁড়ালো। ছোটু আপা, আসপো ? কি দরকার ? আম্মা ডিনার করার জন্যি আপনেক টেবিলি যাতি কইচে । তুমি যাও । আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি ।
চুল আঁচড়ে গরম কাপড়-চোপড় পরে অযথাই আরো কিছুক্ষণ সময় ক্ষেপণ করলাম আমি । ইচ্ছে করেই । ভাবছিলাম আম্মুকে কিছুই জিজ্ঞাসা করবো না আমি । ভাবছিলাম ‘ফ্রী মাইন্ড’ বলে একটা কথা আছে । আম্মুর মাইন্ড ফ্রী হলো কি করে, আম্মু গল্পে এমন প্রগলভ হলো কি ভাবে, পরিত্যক্ত কন্যাদের পুনরায় কোলে তুলে নিতে হঠাৎ এমন ইচ্ছেইবা হলো কেন তার, কোন্ অনুতাপে দগ্ধ হলো মন — এসব জানতে মন চাইলেও কিছুই বলবো না তাকে । আম্মু নিজে থেকে বললে বলুক, নাহয় না বলুক । তবে সে কিছু না বলে থাকতে পারবে না । আমি জানি । তার একলা মন এখন টলমল জল । একজন শ্রোতা তার এখন খুব প্রয়োজন । ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার । টেবিলের সামনে প্রসণ্ণ মনে বসে আছে আম্মু । হরেক রকম বিলাসী খাবার — মনেহচ্ছে, খাওয়ার জন্যে নয় ; এসব প্রদর্শনীর জন্যে রাখা হয়েছে । বিয়াই বাড়ির অতুল আতিথিয়েতার নিদর্শন । দেখানোতেও গৌরব ।
বেশিরভাগ খাবারের আমি নাম জানিনা । গরুর গোস্ত ভূনা — সম্ভবত কালা ভূনা । খাসির রেজালা । ডাক রোষ্ট, কয়েক রকমের কাবাব আর কীসব পুচকু-পুচকু মাছ-মাংসের আইটেম, বলতে পারবোনা । বারকোসে চিতল মাছের প্রকান্ড-প্রকান্ড পেটিগুলো দেখে অবাক হলাম । আম্মু বললো, এইগুলা কোপ্তা । আর এদিকে তো দৈ-মিষ্টির শেষ নেই । কার্ব-হাইড্রেড হলো প্রসেসড পরেটা, নান, খাবছা এবং বাসমতি বয়েল্ড রাইস । সবই গরম গরম পরিবেশন করা হয়েছে । তাপ নিয়নন্ত্রিত বিশাল-বিশাল ফুড-পটগুলির খাদ্য সামগ্রি পুনরায় গরম করতে একজন এডিশনাল ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসায় যত রকম কুকিং-সুবিধা আছে — বুঝলাম, সব সুবিধাই ব্যবহৃত হয়েছে । শশব্যস্ত হয়ে কাজগুলো করতে পেরে বক্কারের মা’কে দেখলাম খুব খুশি । অনেকদিন পর হাসি-খুশি বক্কারের মা’কে দেখে আমারও ভালো লাগলো । আচমকা আম্মু বললো, দাঁড়িয়েই থাকবি, নাকি খেতে-টেতে বসবি ? আম্মুর ধমক খেয়ে টেবিলের অপর প্রান্তে গিয়ে বসে পড়লাম । আমার চোখে লেগে আছে চিতল মাছের কোপ্তায় । কিন্তু তাড়াহুড়োয় সেটা হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল । ভাত নিয়ে বসে আর একবার বারকোসের দিকে তাকাতেই আম্মু বললো, কোপ্তা নিবি ? হ্যাঁ ।
আম্মু বক্কারের মা’কে কিছু বলার আগেই সে বারকোস এগিয়ে দিল আমার দিকে । খেতে শুরু করলাম । কিন্তু শুরু করেই মনে হলো, এ জিনিস খাওয়া যাবেনা । ভ্যাপসা গন্ধ । টক, ঝাল, মিষ্টির সংমিশ্রণে এক ধরনের বিটকেলে-বিস্বাদ । তেঁতুল আর চিনির মিশেলে ঝাল দিয়ে আনাজি কলা ভর্তার মতোন । আম্মু রয়েছে আম্মুর জগতে । আমাকে লক্ষ করে সে কঠিন কন্ঠে বললো, তুই তোর আব্বুকে কতটুকু চিনিস ? ঠান্ডা, নিরীহ — ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না, তাইনা ? এসব কথার জবাব দিতে নেই । ক্ষেধের কথা এসব ।আম্মুর এমন আরোসব কথা শোনার জন্যে আমি প্রস্তুতি নিয়ে নড়ে-চড়ে বসলাম ।
আম্মু আফসোস করে বললো, বত্রিশ বৎসরের আমার এই সংসার, আমার মুখের উপরে মুখ রেখে তোর আব্বু কোনদিন কোন কথা বলতে পারেনি । তার সাহস হয়নি । সেই মানুষ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠলো কী করে — আমি ভেবে পাইনে । তুই পাবনা চলে গেলি । কয়েক দিনের মধ্যেই টের পেলাম বাসা শ্মশান হয়ে গেছে । তোর আব্বু আমূল বদলে গেছে । বাসাতেই থাকে, মনেহয় কেউ বাসায় নেই । যতক্ষণ থাকে উপরে পড়ার ঘরে থাকে । রাতে শোয়ও সেখানে । আমার সঙ্গে কথা বন্ধ । সকালে নিজেই চা বানিয়ে একটা বিস্কিট খেয়ে অফিসে যায় । বাসায় চাকর-বাকর, ড্রাইভার-মালী সব দেখে, বোঝে । বক্কারের মা আড়ালে চোখ মোছে । আমি মনেমনে গালি দেই । বলি, অমানুষ । একদিন রাত দুপুরে সে আমার ঘরে এসে হজির । বসতে বললাম । বসলো না । ঠান্ডা মাথায় বললো, কিছুদিনের মধ্যে সে চাকরি ইস্তফা দেবে এবং তার পরেপরেই সে মনোহরদীপুর চলে যাবে — তোর দাদীর কবর যেখানে দেওয়া হয়েছিল, জংলা সেই ভিঁটে-বাড়িতে চলে যাবে । এই একটি কথা ছাড়া আর দ্বিতীয় কথা তোর আব্বু বললো না । ঘর থেকে বের হয়ে গেল । খাটের উপর আমি থোম ধরে বসে রইলাম অনেক্ষণ । বিয়ের পর এই প্রথম আমার চোখে পানি এলো । কেবলই মনে হতে লাগলো, এইটা বোধহয় আমার শাস্তি । আমার কৃতকর্মের ফল । ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে …
আম্মুর বাক্য পূর্ণ হলোনা ; আব্বু দোতালার সিড়ি ভেঙে ডাইনীং টেবিলের একেবারে সামনে এসে সটান দাঁড়িয়ে গেছেন । কিছু বললেন না তিনি । মুখে তাঁর একটুখানি হাসি লেগে আছে । আর তাতেই আম্মু মহা বিরক্ত হয়ে বললো, আমরা মা-বেটিতে কথা বলছি, তুমি এর মধ্যে এসে দাঁড়লে কেন, তুমি ঘরে যাও । আব্বু কিছু একটা বলার আগেই টেবিলে রাখা আম্মুর মোবাইল-ফোন বেজায় জোরে বেজে উঠলো । অসহ্য লাগলো আমার । কল দেখে আম্মু খুশিতে বাগবাগ । তোর বড় খালামনি ফোন করেছে । ফোন কানে ধরে আম্মু আশপাশে তার খুশি ছড়ায়ে দিল । হ্যাঁ আপা, হ্যাঁ — আমরা গেছিলাম । এই ঘন্টা দেড়েক হলো বাসায় এসে পৌঁছেছি । … সে অনেক কথা । বলছি, পরে বলছি । দুলাভাইকে বলো, তিনি সঠিক কথা বলেছিলেন — ওরা অনেক ধনী । … হ্যাঁ, ভালো আছে, ভালো আছে । আম্মু কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো, আমাকে বললো, তুই খেয়ে নে । উঠে যাসনে কিন্তু । আমি আসছি । বলে আম্মু দ্রুত পায়ে চলে গেল নিরাপদ অন্চলে । তার ঘরে । আব্বু আনন্দিত হয়ে আম্মুর ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটিতে বসতে বসতে বললেন, তোর মা’র কথা শুনেচিস তো ? শুনলাম । কী বোকা মানুষ একটা ! ‘এ আর নুতন কথা কি’  — কিন্তু কথাটা বললাম না আমি । চুপ থাকলাম ।
আব্বু উস্মা প্রকাশ করে বললেন, আর কথা খুঁজে পেলনা — শশীর শ্বশুররা অনেক ধনী, এই বিষয়টি বোনের কাছে আজ তাকে হাই-লাইট করতেই হবে যেন । নির্বোধ । আমি আব্বুর কথা বুঝেছি । কিন্তু শুধু তাকিয়ে থাকলাম । বললাম না কিছুই ।আব্বু বললেন, শশীর গা ভর্তি গহনা, বেশভূষার চাকচিক্য, ঘর-দোরের শান-শওকত দেখে তোর মা মেয়েটির অন্তর আর দেখতেই পেলনা । সে চোখ তো তার নেই । উনি ঘরে ঘরে ঘুরে কন্যার শ্বশুর বাড়ির ঐশ্বর্য দেখে বেড়াত লাগলেন । উজবুক ।আমি তবু নিরব । আব্বু ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন, শশীরে জিগাইলাম জামাই কোথায় — দুই দিন হলো এসেছি, এরমধ্যে একবারও জামাই’র দেখা পেলাম না । এই কথার জবাব দিতে গিয়ে মেয়ে যে তার বানিয়ে বানিয়ে একশ’টা মিথ্যে কথা বলল, সেটাও তোর মা বুঝলো না । গর্ধভ ।
আসলে শশী অথবা শ্যামা কারো খবরই আব্বু জনেন না । আর আম্মু তো খবর রাখেই না । আব্বুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা প্রখর । তিনি অল্পতে অনেক বোঝেন । আম্মু বিত্ত-বৈভব ব্যতিরেকে আর সবকিছু চোখ কপালের উপর তুলে দেখে । কাজেই দর্শনীয় ব্যাপারে তাদের মধ্যে গড়মিল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক । আমি কিন্তু সব জানি । আমার সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে । দুজনার এমন দু’টা খবর আমি জানি যে, আব্বু-আম্মু এখন পর্যন্ত তা জানেনা । না বললে জানতেও পারবেন না । আমি বলবো না । প্রকৃতিই একদিন সব খবর জানিয়ে দেবে তাদের ।
সুবাতাস বইতে শুরু করেছে । খবর দুইটা খুব শিঘ্রী জানাজানি হয়ে যাবে হয়ত । ন্যাচারালী জানার মধ্যে একটা আনন্দ আছে । সে ভাবেই জানুক সবাই । ভালো হবে । চমকেও যাবে । খবর দু’টো হলো : এক, শ্যামার পেটের বাচ্চাটি যথা সময়ে দুনিয়াতে এসেছে । ওরা কখনো এ্যাবোরশনের কথা চিন্তাও করেনি । নিয়মিত চেক-আপ করা হতো । এখন আট-ন’ মাসের একটি ফুটফুটে ছেলে বাচ্চা শ্যামার কোলে । ভাল আছে । দুই, শশীর গর্ভে প্রথম সন্তান অঙ্কুরিত হবার পরেপরেই রায়হান সাহেব শশীর নামে প্রায় বিপুল অর্থ-সম্পদ হস্তান্তর করে দেন । কেন দেন — সে কথা তিনি বলেননি । শশী অজ্ঞাত এই বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত এবং মনেকরে সে বিপদ গ্রস্হ ।
থাক সেসব কথা । এখনকার কথা বলি । আব্বু সহসা একটুখানি খুশি হয়ে তাকালেন আমার দিকে । বললেন, গাধা-টাধা যাই হোক, একটা বিষয়ে তোর মা’কে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই । আমি আনন্দিত হয়ে বললাম, দাও । মানা করেছে কে ? আব্বু বললেন, এ জীবনে ধন্যবাদ পাওয়ার মতো একটা কাজই তোর মা করেছে । আমি খুশি । ধন্যবাদটা নাহয় দিয়েই দেই, কি বলিস ? আব্বু, তুমি বড্ডো কিপ্টে । আব্বু হা হা করে হাসলেন । আমি বললাম, তোমার এই মহামূল্যবান ধন্যবাদটুকু আম্মুকে কেন দিতে হবে শুনি ?  আব্বু বললেন, আমি বুঝতেই পারলেম না — কেমন কেমন করে যেন তোর মা দিন-ক্ষণ সহ শশীর শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আয়োজনটা সেরে ফেললো ! অবাক কা — এবার আব্বুর কথাটা শেষ হলোনা ।
ধুপধাপ করে মেঝে কাঁপিয়ে আম্মু এসে ডাইনীং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো । আমার দিকে চোখ পড়তেই এক রাশ প্রশ্নবাণ, কি ব্যাপার তুই কোঁচে হাত তুলে বসে আছিস যে ? খাওয়া হয়ে গেছে ? কি খেলি ? তারপর আব্বুকে আম্মু ঝাড়ি মারার মতো করে বললো, তুমি এতক্ষণ বসে বসে এখানে কি করছো, সিমির সঙ্গে খেয়ে নিলেই তো পারতে ? বুড়ো হচ্ছো, আর অযথা সময় নষ্ট করা তোমার স্বভাবে পরিণত হচ্ছে । আব্বু বললেন, তুমি তো জানো দুপুরে বেশি হলে আমি আর রাতে খাইনে । শুধু শুধু বাড়তি কথা বলো কেন ? আমি তোমাকে বলতে এসেছিলাম যে, হেলাল কি গাড়ী গ্যারেজ করে চলে যাবে, না অপেক্ষা করবে ? কেন, হেলাল কে দিয়ে এখন আমি কি করবো ?
আব্বু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, বিয়াই বাড়ির মিষ্টি কি তুমি একাই খাবে — ঝিকরগাছা বড় আপাকে দেবেনা ? হেলাল, হেলালের কাছে একটা নুতন ছেলে এসেছে, বক্কারের মা আছে — এদের দেবেনা ? আম্মু তীব্র ঝাঁজালো কন্ঠে বললো, আমি কি তবে এতক্ষণ ঘোড়ার ঘাস কাটলাম ? সে দায়িত্ব আমার পালন করা হয়ে গেছে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব ! হেলাল চলে গেছে । বক্কারের মা কাল সকালে যাবে । সিমির বড় খালার কথা মনে করার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । শুনে আব্বু আর দাঁড়ালেন না । আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে চলে গেলেন । আব্বুর এই মুচকি হাসির চাওয়াটি ছিল মিনিংফুল । সুযোগ পেয়ে আমিও হেসে বললাম আম্মুকে, তোমার জন্যে আব্বুর একটা সুন্দর গিফট মিস হয়ে গেল । যা তুমি কখনো আব্বুর কাছ থেকে পাওনি । নেবে ? আম্মু কথাটা বুঝতে পারলো না । তাকিয়ে রইল । আমি বললাম, আব্বু তোমাকে একটি ধন্যবাদ দিতে চেয়েছে । হাসি লুকিয়ে আম্মু বললো, তোর বাপ জীবনে কাউকে একটা ধন্যবাদ দিয়েছে না ? সে কি জানে ধন্যবাদ মানুষকে কি ভাবে দিতে হয় ?
বিচিত্র মানুষের মন । কখন যে কার মনে কি উদয় হয় কেউ বলতে পারেনা । হঠাৎই আমার মনেহলো, নারিন্দা কারিকর পাড়ার বাসিন্দা শ্যামার শ্বশুর লেদু মিস্ত্রীর কথা । অজানা-অচেনা একজন মানুষ । কোন একদিন আমার আব্বু-আম্মু অখ্যাত ওই অতি সাধারন মানুষটির অবস্হান খুঁজে বের করে কি সেখানে যাবার ইচ্ছে পোষন করবে ?

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580