শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
দৈনিক আজকের সংবাদ পত্রিকার সংবাদ পড়তে এখন থেকে আমাদের নতুন ওয়েবসাইট www.dailyajkersangbad.com ভিজিট করুন। টাংগাইল বন বিভাগের দোখলা সদর বন বীটে সুফল প্রকল্পে হরিলুট আগ্রাবাদ ফরেস্ট কলোনী বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেন মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী ফৌজদারহাট বিট কাম চেক স্টেশন এর নির্মানাধীন অফিসের চলমান কাজ পরিদর্শন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে: শেখ সেলিম সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র চলছে সীমাহীন অনিয়ম এলজিইডির কুমিল্লা জেলা প্রকল্পের পিডি শরীফ হোসেনের অনিয়ম যুবলীগে পদ পেতে উপঢৌকন দিতে হবে না: পরশ নির্বাচন যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পেশি শক্তির মানসিকতা পরিহার করতে হবে: সিইসি

নীলরঙ  প্রজাপতি

নিউজ ডেক্স:
  • প্রকাশিত সময় : শনিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২২
  • ২৮৬ পাঠক পড়েছে

নীলরঙ  প্রজাপতি
                                                  আমজাদ হোসেইন

শীতের রাত। চারদিক হালকা কুয়াশায় ছাওয়া । নিম নিম করে হাওয়া বইছে। রিক্সায় জড়সড়ো হয়ে বসেও শান্তি নেই । বিষ ঠান্ডা । দূরের মসজিদে কোথাও আজান শুরু হয়েছে । এশার আজান ।সাঁঝরাতেই রাস্তা-ঘাট প্রায় জনশূন্য । লোকজন নেই খুব একটা । বাতাসে ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। এই এলাকাতেই — কাছেপিঠে কোথাও হবে, কয়েক ঘর প্রাচীন নৃ-গোষ্ঠি বৌদ্ধদের বাস। অনেকদিন আগে তাদের পূর্বপুরুষের কিছুঅংশ ব্রম্মদেশের আরাকান রাজ্য থেকে মুসলিমদের তাড়া খেয়ে বঙ্গদেশে এসেছিল । যাযাবরের মতো ভাসতে ভাসতে একদিন তারা যশোরের কপোতাক্ষ নদের তীরে  এসে বসতি স্হাপন করে । কালক্রমে স্হানান্তরিত হয় এবং আজকের এই লাকায় বৌদ্ধমন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্হায়ী হয় । তখন থেকে লোকমুখে এলাকাটির নাম হয়ে যায় বার্মাপাড়া ।সান্ধ্যকালীন অর্চনার ধূপের গন্ধ এই মন্দিরেরই । আমি রিক্সাঅলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা বার্মাপাড়া কি পার হয়েছি ? রিক্সাঅলা পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে উচ্চস্বরে জবাব দিল, আমি আসলে বাপ-মা মরা আপা । তারা এখন আর বেঁইচে নেই । লোকটা ঠসা । নিশ্চিত হলাম ।কাজেই ওর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা বাদ দিতে হলো ।

সে এবার আরো জোরে জোরে কথা বলা শুরু করলো । ঠসারা নিজেরা কানে কম শোনে অথবা শোনেইনা, অন্যদেরকেও তাই ভাবে ।সে বলছিল, আপা, আমার বাপ-মা দুইজনেরই বয়স একশ বছর পার হইয়ে গেছিলো । এ কতা বিশ্বেস করেনা কেউ । তয় আমি জানি আপনে ক’রবেন । আপনে মানবতা লোক । নইলে কি আর আপনে আমার মতোন একজন রিক্সাঅলার বাপ-মা’র কতা সোধেন ?

কোথায় যেন পড়েছিলাম, মফস্বল শহরের নাপিত আর রিক্সাঅলা একবার সুযোগ পেলে ওরা অনর্গল কথা কয় । থামেনা । তখন ওদের অর্গল খুলে যায় । আমি বললাম, তোমার নাম কি ? বাম কান খারাপ আপা । ডান কানেও কম শুনি । চেঁচিয়ে বললাম, নাম– তোমার নাম কি ? অ অ অ, আমার নাম বজু । ভাল নাম সেখ বজলু আপা । আমি মুখে তালা লাগিয়ে দিলাম । এর সাথে আর কথা বলা যাবেনা ।

বজু একা একাই কথা বলে যাচ্ছিলো, আপা, আমার বাপ-মা ছিলো একজুড়া মহব্বতের কৈতর । এখনকার দুনিয়ায় মাইনষ্যের মদ্যি এই মহব্বত আর দেকা যায়না । দুনিয়া এখন হয়ে গেছে বালখামছানির জায়গা । আমার মাথার মধ্যে ছিল অন্য চিন্তা । ভাল করে বুঝলাম না বজলুর কথা । কেন যেন চুপ থাকতে পারলাম না । তাই  হেসে উৎসাহ দিয়ে বললাম, তোমার বাবা-মা ছিল সুখি দম্পতি, তাইনা ?

সঙ্গে সঙ্গে এ কথার প্রতিবাদ এলো, আরে না না, আপা । আমার বাপ-মা’র কোন সয়-সম্পত্তিই ছিলনা । আমরা খুব গরীব । দুই ভাই-ই রিক্সাঅলা । গুঁড়্যাগাঁড়ার মুখে দু’বেলা ভাত তুইলে দেওয়াই আমাগের জন্যি কটিন । একটা শ্যাষ ঘটনার কতা কই শোনেন । বাজারে জম্মের আকাল, একা আর আমি সংসার চালাতি পারতিছিল্যাম না আপা । একদিন বিয়েন বেলা উঠোনে দাঁড়ায়ে আমি ছোড্’ডারে কইলেম, এতদিন তো আমি একলাই বাপ-মা’ক টইনলেম, এখন এক কাম কর রে ভাই, , ইবার তুই একজনেক লে, হয় বাপেক, লয় মা’ক । বজু একটু থামলো । দম নিয়ে আবার সে বললো, আপা, আমার মুখের কতা ফুরোলই না, মা উঠোনে নাইমে আইসে আমার হাত ধইরে কইলো, বজু, বাপ, চিন্তা কইরবানা । আমরা বুড়ো-বুড়ি আর বেশি দিন বাঁইচবোনা, ক’ডা দিন কষ্টো করো । মরার আগে তুমার বাপেক আর আমার কাছ থেইকে ভেনো কইরোনা । এইডা আমার শ্যাষ কতা । বজলু কাঁধের গামছা দিয়ে নাক মুছলো । রিক্সা স্লো হয়ে গেল । এবার সে ভেঙে পড়ে বললো, আপা, পরেদ্দিন কিরাম কি অয়ে গেল বুজতি পারলাম না, বিয়েন বেলা আমার মা মইরে গেল। আর বিকেল বেলা গেল বাপ । মানিকজোড় মরা । পিথীবির এক আচ্চয্য মিত্যু । বজলু গামছা দিয়ে এবার চোখ মুছে পিছন ফিরে অনুনয় করে বললো, আপা, তাগের জন্যি দুআ ক’রবেন।

আমার মনেহলো, বজলুর কথা এখানেই শেষ হয়ে গেল । এরপর আর কি কথা ! কিন্তু বজলুর কথা শেষ হলোনা । অর্গল খুলে গেছে ।
কিন্তু সেসব কথা আর আমার কান পর্যন্ত পৌঁছুলো না । বজলুর অনেক কথাই হয়ত সত্য নয় ; কিন্তু মূল কথটি হলো, দাম্পত্যে মহব্বত । মিল । একজন অশিক্ষিত লোকের মুখে তার বাপ-মা’র দাম্পত্য জীবনের এমন সুখের গল্প শুনতে আমার ভাল্লাগছিল না । কেবলই মনে হচ্ছিল, আমি এই রিক্সাঅলার চাইতেও অধম । আমার এ রকম কোন গল্প নেই । খারাপ লাগছিলো । বারবার ঘুরেফিরে নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম : সুখি হওয়ার জন্যে আমার আম্মুর সংসারে কীসের এত অভাব ? কোন্ উপকরণের ঘাটতি রয়েছে সেখানে ? সংসারে এত অশান্তি কেন ? লোকচক্ষুর আড়ালে মাঝে মাঝে আমাদের সবাইকে চোখের জল লুকাতে হয় কেন ? শশী, শ্যামা, আব্বুর মনে কি প্রতিক্রিয়া হয় আমি জানিনা ; কিন্তু আমার মনে এরকম  হাজারো প্রশ্নের জন্ম হয় দিবারাত্রি । জবাব মেলেনা । আমি ঠিক জানিনা ; তবু মনেহয়, আসলে সুখের জন্যে জীবনে অল্পে তুষ্ট  থাকার একটা বিষয় আছে । আসলে অর্থ-সম্পদ প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে একটা সীমারেখা টানার প্রয়োজন আছে । আসলে ব্যক্তিগত জীবনে ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের দাপট থেকে মুক্ত থাকার একটা বিষয়
আছে । আমাদের এসবের কোন বালাই নেই । আমাদের কিসের এত অহঙ্কার ?

আম্মুর সংসার । অর্থ । সম্পদ । শাসন । আর নিয়মের বেড়াজালে বন্দী । সেখানে আবেগের কোন মূল্য নেই । নানাজানের বংশানুক্রমিক প্রতাপ নিজের চরিত্রে এখনো ধারন করে আছেন আমার জননী ।ফুলের মতন দু’টি মেয়ে হারিয়ে ফেলেছেন তিনি ।আব্বুর মন জয় করতে পারেননি আজও । আমি সবেধন নীলমনি ; আমার ভবিষ্যৎ পদ্মপাতার জল । টলমল । প্রচন্ড মেধাবী দেখে একজন এতিম ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে আমার নানাজান নিজের আত্নরম্ভি কনিষ্ঠ-কন্যার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন । সেদিন কিন্তু কারো কোন দ্বিমত করার সুযোগ ছিলনা । আমার ধারণা, সেইথেকে জগৎ-সংসারের প্রতি এক ধরনের বীতশ্রদ্ধভাব সবসময় আম্মুকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । হয়তো নিজেদের রাজবাড়িতে আশ্রিত ছেলের সঙ্গে তার বিবাহ সেদিন আম্মু মনথেকে মেনে নিতে পারেনি । হয়তো আজো সে অনুতাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি । আব্বুর জন্যে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে আমার । খুব দুখী মানুষ । বুঝতে দেননা কাউকে। পাথর বুকে চাপা রেখে হাসি মুখে আম্মুর সব হুকুম তামিল করে যান । হয়ে গেছেন ছাল-বাকলাবিহীন টাকা-ফলের গাছ । ভিতরে রক্তক্ষরণ যে তার হয়না ; হয় । আমি টের পাই — যখন দেখি মাঝরাতে তিনি বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন । আকাশের দিকে বোবার মতো চেয়ে থেকে বাকি রাতটুকু একলা পার করে দেন ।

এই যে দীর্ঘদিন পর বাসায় ফিরছি, গিয়ে কি দেখবো আমি ? আমার জন্যে বাসায় কি সিচ্যুয়েশন অপেক্ষা করছে ? আমার বিয়ে নিয়ে জোড়াজুরী ? নাকি দেখতে হবে, গাড়িবারান্দার দুই মেরুতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো দুইখন্ড কাঠ-মানুষের মুখ ? আমার কান্না পাচ্ছিলো । হঠাৎ দেখি, রিক্সাঅলা বজু পেছনে তাকিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে, আপা, কতা কন’না ক্যা, এখন কুথায় যাতি অবে, কন’না ক্যা ? আরে, এ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো, থামো থামো । দেখলাম, বজলু ডিসি অফিস, ট্রেজারী অফিস আর এসপি অফিসের মাঝখানে তে-মাথায় দাঁড়িয়ে আছে । বললো, আপনে এসডিও কোটে যাইবেন না ? রাতেরবেলা আমি এসডিও কোর্টে কেন যাবো, এখানে তুমি এসডিও কোর্ট কোথায় পেলে ? তা’অলে এখন কুথায় যাবো ? আমি বিরক্তহয়ে চেঁচিয়ে বললাম, তুমি রিক্সা ঘোরাও । এসডিও কোয়ার্টার, এসডিও কোয়ার্টার, এসডিও কোয়ার্টারে  যাও — বজু ঠসা এবার কানে শুনলো । শক্তি দিয়ে সে দ্রুতগতিতে এসডিও কোর্টারের দিকে ছুটতে থাকলো ।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580