মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ১২:৩৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
দৈনিক আজকের সংবাদ পত্রিকার সংবাদ পড়তে এখন থেকে আমাদের নতুন ওয়েবসাইট www.dailyajkersangbad.com ভিজিট করুন। টাংগাইল বন বিভাগের দোখলা সদর বন বীটে সুফল প্রকল্পে হরিলুট আগ্রাবাদ ফরেস্ট কলোনী বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেন মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী ফৌজদারহাট বিট কাম চেক স্টেশন এর নির্মানাধীন অফিসের চলমান কাজ পরিদর্শন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে: শেখ সেলিম সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র চলছে সীমাহীন অনিয়ম এলজিইডির কুমিল্লা জেলা প্রকল্পের পিডি শরীফ হোসেনের অনিয়ম যুবলীগে পদ পেতে উপঢৌকন দিতে হবে না: পরশ নির্বাচন যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পেশি শক্তির মানসিকতা পরিহার করতে হবে: সিইসি

নীলরঙ প্রজাপতি

নিউজ ডেক্স:
  • প্রকাশিত সময় : বৃহস্পতিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ২৯৮ পাঠক পড়েছে

নীলরঙ প্রজাপতি

আমজাদ হোসেইন

শেষপর্যন্ত চিতল মাছের কোপ্তা আমি খাইনি । গোস্ত-ভাত খেয়েছি । কালাভূনাটা ছিল অসাধারণ । খাসির গরম রেজালার স্বাদও ছিল অন্যরকম । খাওয়া শেষে দৈ-মিষ্টি আর বড় এক ডাব্বু-চামুচ রসমালাই । কঠিন তৃপ্তি । ক্ষিধে-পেটে খেতে খেতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম । শুয়ে রেষ্ট নিচ্ছি । ফোন বেজে উঠলো ।  ঘড়ি দেখলাম, রাত সাড়ে এগারোটা । দোতালার ওঘর থেকে এঘরে আব্বু ফোন করেছেন । ফোনে যে তিনি হাসছেন,  শুধু শব্দ শুনতে পাচ্ছি তা-ই নয় ; মনে হলো দেখতেও পাচ্ছি ।

আব্বু বললেন, কিরে মা, মা-বেটি’তে গল্প করতে করতে আব্বুর কথা ভুলে গেলি ? বললাম, দশ মিনিট । আমি আসছি আব্বু । তুমি রেডি হও । আমারও মিনিট দশেক সময় লাগবে রেডি হতে । অবশ্যই আব্বু সানন্দে অপেক্ষা করবে । আমি জানি । অনেক কথা জমা হয়ে আছে যে তার ! আব্বু আমাকে কি বলবেন জানিনা, আব্বুকে আমি কি বলবো– সেইটা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে আমাকে । এমন একটা পরিস্হিতির মধ্যদিয়ে আমার সময়গুলো অতিবাহিত হচ্ছে যে, না ভাবলে চলেনা । এখন সিরিয়াসলী মনেহয়, আমার বেহিসেবি-জীবনের দিন শেষ । এই জীবনের আনন্দ আমি আর কখনোই ছুঁতে পারবো না । কাল সকালে আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই আব্বু অফিসে পৌঁছে যাবে । এমন কিছু কথা আছে যে, অফিসে যাবার আগে– অর্থাৎ আজ রাত্রেই আব্বুকে বলতে হবে । আবার আব্বুর এমন কিছু ইচ্ছে বা মানসিকতা থাকতে পারে, যা এখন পর্যন্ত আমি জানিনে।

আমাকে জানতে হবে । এই জানা, না জানার সঙ্গে আমার মনের স্বস্তি আর সুস্হতার সম্পর্ক রয়েছে । দশ মিনিটে আমি এগুলোই ভেবে নিতে চাইলাম । নিচে আম্মু বক্কারের মা’কে সঙ্গে নিয়ে তখনো হাঁড়ি-পাতিল ঘটর-মটর করছে । আমি দোতালায় । কর্ডিগানখানা গায়ে জড়িয়ে আব্বুর রিডিং-রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম । ওমা, আব্বু আমাকে ‘আয়-টায়’ কিছু না বলে আমার দিকে হেসে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন । আমি এগিয়ে গিয়ে আব্বুর কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়াতেই তিনি প্রশ্ন শুরু করলেন : এখন টোটালি তোর আম্মুকে কি মনেহয় ? প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম। দক্ষতার সাথে ঝটপট উত্তর দিলাম, অসাধারণ! আব্বুকে? পচা। তোর নিজেকে ? অপদার্থ।

বুঝতে পারলাম, আব্বু খোশ মেজাজে আছেন। সাবধান হয়ে গেলাম। মেজাজ ভালো থাকলে তিনি রসিকতা করেন। কঠিন কঠিন কথা বলেন । আব্বু প্রশ্নের ধারা অব্যহত রাখলেন। কি ভালো লাগে ? গোপন হাসি । কি খারাপ লাগে ? কিছুই খারাপ লাগেনা । বাংলায় একটা শব্দ আছে– স্ত্রৈণ। স্ত্রৈণ মানে কি ? আমি ভেবে-চিন্তে বললাম, স্ত্রৈণ মানে ছাগল । আব্বু হা: হা: হা: হা: করে হেসে উঠলেন। মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন, রাইট। আমারও তাই মনেহয় । কিন্তু আব্বুর  চোখ-মুখ হাসির সঙ্গে মিললো না। কাঠ-কয়লায় পোড়া হাসি মনেহলো। বুঝতে পেরে আমি বেদিশার মতো বললাম, তুমি ঠাট্টা করছো আব্বু ? ঠাট্টা নয় রে মা । রসিকতা করছিলাম । কতকাল তোদের সঙ্গে রসিকতা করিনে, মনে আছে ?

আমি টার্ন-ওভার করতে চাইলাম। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ একটা আনন্দের দিন, তাইনা আব্বু ? হ্যাঁ । তাহলে আজ আমার প্রার্থনাটি মঞ্জুর করে নাও । তোর প্রার্থনা কি ? ভুলে গেছো ঊনত্রিশে ডিসেম্বরের কথা ? তোর বয়স কি আঠারো হয়ে গেছে ? আগামীকাল হবে । আব্বু বললেন, তাহলে তো দেরী আছে । আঠারো বৎসরের আগে তোর ব্যাপারে আমি  যা ইচ্ছা তা-ই তো করতে পারি, নাকি ? পারো । কিন্তু কি করবে তুমি ? তোর ব্যাংক এ্যাকাউন্টে দশলক্ষ টাকা কাল সকালেই ট্রান্সফার করে দেব আমি । আমি একটু চিন্তা করে বললাম, তাহলে এক কাজ করো। এই টাকা আমি দুস্হদের কল্যাণে দান করতে চাই । তুমি সিষ্টেম করে ফেলো । আব্বু হেসে ফেললেন । বললেন, সুন্দর সিদ্ধান্ত । তবে আমি বলি কি মা, এই মহৎ কাজটি তুমি ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখো– অবশ্যই করবে, যখন তুমি নিজে টাকা রোজগার করবে ।

আমি সঙ্গে সঙ্গে আব্বুকে ছেঁকে ধরলাম, তাহলে তুমি এবার নিজেই চিন্তা করে দেখো আব্বু, নিজের টাকার উপর হক শুধু তারই যিনি টাকা রোজগার করেন এবং খরচের অধিকারও শুধু তারই, রাইট ? আব্বু মাথা চুলকাতে লাগলেন । যথার্থ জবাব দিতে পারায় আমি আনন্দিত । শেষমেষ আব্বু বললেন , হলো না রে মা । হেরে গেলাম । তোর অনেক বুদ্ধি । তাহলে আর দেরী কেন, আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হোক । আব্বু হতাশ হয়ে বললেন, ঠি-ই-ক আছে । কিন্তু পরক্ষণেই রুল জারী করলেন, তবে একটা শর্ত আছে । কি শর্ত ?

প্রয়োজনে জরুরী অবস্হা ঘোষনা করা যাবে । আচ্ছা । আব্বুর শর্ত আমি মেনে নিলাম । যেহেতু আমার অবস্হা এখন খারাপ না, ভালই । আব্বু হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরে হলেন মহা খুশি । কিন্তু আমাদের বাপ-বেটির কথা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ । আমি আব্বুকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, তুমি নাকি মনোহরদীপুর  দাদীমার কাছে চলে যাচ্ছো, কবে ? ইচ্ছে করলেই তো আর দাদীমার কাছে চলে যাওয়া যাবে না ; অপেক্ষা করতে হবে । আর সেই অপেক্ষাটা আমি মনোহরদীপুরে করতে চাই । এভাবে বলছো কেন ?

আব্বু চুপ করে রইলেন । কথা বললেন না । আমি বললাম, একাই যাবে ? আম্মু যাবে না ? সে যেতে পারবে না । তার যাবার যোগ্যতা নেই । বুঝলাম না । আব্বু রেগে গেলেন, তোর বুঝে কাজ নেই । কঠিন নিরবতা নেমে এলো কয়েক সেকেন্ডের জন্যে । আমি ঘাঁটালেম না আব্বুকে । আম্মুর উপরে তার নানা কারণে অভিমান । কবরে যাবার আগে মানুষের পরিশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা– মনোহরদীপুর যাবার বিষয়ে আব্বু এমনি এক ধারণা পোষন করেন । তাঁর ধারণা, আম্মু পরিশুদ্ধ মানুষ নয় । আম্মুর মধ্যে অর্থ-সম্পদের আকর্ষণ প্রবল ।

আমি আজ ইচ্ছে করে আব্বুকে দাদীমার কথা জিজ্ঞাসা করলাম, ইদানীং দাদীমার কথা কি খুব বেশি মনে পড়ে তোমার ? হ্যাঁ । কোন্ কথাটি তোমার বেশি মনে পড়ে ? আব্বু চুপ করে থাকলেন অনেক্ষণ । বালক বেলার মা’র কাছে ফিরে গেছেন বোধহয় । অবশেষে গাঢ় স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, বেশি মনে পড়ে আমার মা’র মুখে শোনা বাবার কথা । কিন্তু বাবার কথা আমার মনে নেই । মা বলতো, বাবা নাকি মানুষ ছিলেন না ; ফেরেস্তা ছিলেন । একটু থেমে তিনি আবার বললেন, মা’র গায়ের চামড়ার সাথে লেগে থেকে আমি মানুষ । তার মৃত্যুর কথা আমি কখনো ভুলতে পারিনে মা । বুঝলাম, আমি বোকার মতো কথা বলে ফেলেছি । চুপকরে থাকা ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই ।

আব্বু মন খারাপ করে বলতে লাগলেন, আমার বয়স তখন ছয়-সাত । মা প্রায়ই মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালেন । বুক চেপে শুয়ে থাকেন । এবং কেন যেন ওই সময়েই আমাকে কোলের কাছে শুইয়ে আদর করেন, চুমু খান । মুখ-চোখ নেড়ে কথা বলেন । আমার শুধু মনেহয়, মা’র হয়ত মাথা ব্যথা অথবা পেট ব্যথা করছে । একদিন দেখলাম, পানি-টানি মাথায় না ঢেলেই পাটীতে শুয়ে আছেন । আমাকে কাছে ডেকে বললেন, বাপরে, কি খেতে মন চায় ? আমি বললাম, কিসসু না ।

মা কঁকিয়ে কাঁদছিল । আঁচলে চোখ মুছে বললেন, তোকে তো কোনদিন একবেলা ‘পোলোয়া-ভাত’ও আমি রেঁধে খাওয়াতে পারলেমনা রে বাপ ! গোস্ত দিয়ে ‘পোলোয়া-ভাত’ খাবি ? গোস্ত চিনি । ‘পোলোয়া-ভাত’ কি জিনিস আমি তখনও চিনিনা । বললাম, খাবো না । মটরের ডাল, শুকনো মরিচের ‘আলু-ভততা’ আর ডিম ভাজি দিয়ে গরম ভাত আমার পছন্দ । মা জানে । সেদিন সারাদিন খাওয়া হয়নি । আমি বললাম, ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাবো । মা বললো, মুরগির চামড়া, পা-পাখনা, লেজের-পুটলি যদি দেই, খাবিনে ? আমি খুশিতে বাগবাগ । এ গুলো আমার জন্যে তখন ছিল রসনা বিলাস ।

বাড়ির ডিমপাড়া মুরগি কখনো কখনো বিরাম হয়ে ঝুমলে মা জবাই দিয়ে ভাজা-ভাজা করে রেঁধে দিত । আমি জানতাম, পৃথিবীতে এর চেয়ে ভালো খাবার আর নেই । আব্বু থামলেন । কিছুক্ষণ মাথা নিচু  করে বসে রইলেন। আমিও চুপ ।

পিনপতন নিরবতা ভেঙে এবার আব্বু বললেন, হঠাৎ কঁকিয়ে উঠে মা আমাকে চেপে ধরলো । বুকের মধ্যে তখন তার হাঁফড় টানছে । মাথা-মুখ-বুক ঘামে ভিজে যাচ্ছে । চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মা’র । কোনমতে বললো, ভয় পাসনে বাপ আমার । তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আয়, পানি নিয়ে আয়– আমি দৌড়ে গিয়ে হাঁড়ি থেকে কাঁসার বাটিতে করে পানি এনে দেখি, মা ঘাড়ি ভেঙে পড়ে আছে । এত ডাকলাম, কথা বললো না । একটু নড়লোও না মা ।

আমার এখনো মনে আছে, মা’র পিঠের উপর পড়ে আমি তখন কেঁদে কেঁদে চিৎকার করছি, আর মা মা বলে ডাকছি … আব্বু আর কথা বলতে পারলেন না । একদম চুপহয়ে গেলেন । নিজেকে নির্দয় আর নির্মম মনে হলো আমার । খুব খারাপ লাগছিল । বোবা হয়ে বসে রইলাম । আব্বুর কষ্ট আমাকে স্পর্স করলো । আমার চোখেও পানি চলে এসেছে । আব্বু আবার কথা বলে উঠলেন, সিমি,মা, খুব ভালোলাগছে এখন । এই প্রথম তোর দাদীর কথা শেয়ার করার সৌভাগ্য হলো আমার । তারপর হঠাৎ করেই আবার হেসে বললেন, একদিন তুই নিজে আলুভর্তা দিয়ে ডাল-ভাত রেঁধে খাওয়াবি নাকি আমায় ?

আমি ওড়নায় চোখের কোনা মুছে বললাম, এবার নয় ; যেদিন মনোহরদীপুর যাবো সেদিন । আব্বু আমার কপোলে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, মাই হেভেন ! অনেক রাত হয়েছে মা । ঘরে যা । আমি ছোট্ট মেয়ের মতো গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আমার ঘরে চলে এলাম ।

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580