২০১৩ সালের শরৎ সকাল। নির্মল বাতাস,পূর্বাকাশে রক্তিম সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণও দুই একটা দেশীয় পাখির ডাক ধরণীতে মায়াবী মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ধর্মপ্রান মুসল্লিগন ভালুকা থানাধীন ডাকাতিয়া বালিগাড়া জামেমসজিদে ফজরের নামাজ আদায় শেষে যারযার বাড়ী ফিরছে। শহিদুল্লাহর বাড়ীর অনুমান ১০০ গজ উত্তরে কাঁঠাল গাছের নীচে কাঁচা রাস্তার উপর এক ব্যক্তির মৃত দেহ পড়ে আছে।বয়স অনুমান ৫০ বৎসর । অপরিচিত ব্যক্তি । গলা কাটা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের রক্তাক্ত ক্ষত চিহ্ন । দেখে মনে হয় অন্য কোথাও হত্যা করেএখানে ফেলে গেছে। এক কান দুই কান হতে হতে অনেক লোকের সমাগম ঘটে।অনেকেই মৃত ব্যক্তিকে চিনতে পারে। দোলা বাজারের মনোহারি ও কসমেটিকস্ এর দোকানদার। হিজলী পাড়ার জংবাহাদুর। ঢাকা সহ দেশের বড় বড় শহরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জ¦ালাও পোড়াও করে মানুষ হত্যা করছে।আর এটাতো পারাগাঁও। পাড়া গায়ে রাজনৈতিক প্রতি পক্ষ থাকে, কিন্তু একে অপরের প্রতি সহানুভুতিশীল। তা হলে এই দেকানদার হত্যা হলো কেন? সকলের একটাই প্রশ্ন।লোক মুখে সংবাদ পেয়ে ছেলে, ভাই সহ আত্নীয় স্বজন ঘটনা স্থলে আসে এবং সনাক্ত করে।পুলিশ আসে,সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে।তার আত্নীয় স্বজনদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে, গত ৩০/০৯/১৩ খ্রিঃ দোলা বাজারেসন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করে বাড়ীতে না আসায় তার ছেলে ফোন করে এবং ফোন বন্ধ পায়। সম্ভব্য স্থানে খোজ করে পায় নাই। জংবাহাদুর বাহাদুরইবটে।সুঠাম দেহের অধিকারী। ৫০ বৎসর বয়স হলেও বাস্তবে ৪০বৎসরের বলে মনে হয়। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি জড়িত নয়। দোলা বাজারে অনেক দিন যাবৎ মনোহারি ও কসমেটিকস্ এর ব্যবসা করতো। কারো সাথে বিরোধ আছে বা ছিল কেও জানে না।প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ এই হত্যার কোন কুলকিনারা পায় নাই। পরবর্তিতে ডিবি ও সিআইডি মামলা তদন্ত করে।কিন্তু প্রকৃত ঘটনা উৎঘাটন করতে পারে নাই। ঘটনার পরপর অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করতে না পারলে পরবর্তিতে জটিল রুপ ধারন করে। নিয়োগকৃত নামধারী সোর্স নিজে লাভবান হওয়ার জন্য পুলিশকে অন্য পথে চালিত করে। সোর্স জানে প্রকৃত তথ্য উৎঘাটন করলে তার তেমন কোন লাভ নাই। ঝুলে থাকলে অপরাধী সহ আশপাশের অনেককে ভয় দেখিয়ে অনেক টাকা কামাই করা যায়। কিছু অসৎ কর্মকর্তা সোর্সের মাধ্যমে নিজেও লাভবান হয়। সোর্সমানির উৎস থাকলেও যথাযথ ভাবে ব্যবহার হয়না। সিষ্টেমের কারণে তদন্তকারী অফিসারের কাছে সোর্সমানি থাকেনা। ফলে মামলার তথ্য উৎঘাটনের হার অনেক কম। পিবিআই ব্যতিক্রম। তথাকথিত সোর্স ব্যবহার করে না।ফলে পিবিআইয়ের সফলতার হার অনেক বেশী। পিবিআই এই মামলা তদন্ত কালেমৃত জংবাহাদুর(৫০) ও পরির(২০) অসম প্রেমের উপাখ্যান আবিস্কার করে।এই প্রেমের মাঝখানে অনুপ্রবেশ ঘটে জনি, মিজান, আনিছ, রোকন, হুমায়ুন ও রফিকের।তাদের একজনহুমায়ুনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঘটনাটি ২০১৩ সালে। দোকানে মালামাল কেনার সুবাদেদোলা বাজারেরপাশ্ববর্তী শিংলা পাড়া গ্রামের নুর জামালের সাথে জংবাহাদুরের পরিচয় হয়।পরিচয় সুত্রে ঘনিষ্টতার সুবাদে জংবাহাদুর নুর জামালের বাড়ীতে যাতায়াত শুরু করে।এক পর্যায়ে নুর জামালের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী বেগম (ছদ্দ নাম) ও মেয়ে পরি (ছদ্দ নাম) দোকানে মালামাল কেনার জন্য যেত। আবার জংবাহাদুর ও দোকান বন্ধ করে তাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসতো।আসা যাওয়া কথাবলা ও উপহার দেওয়ার এক পর্যায়ে মেয়ে পরির সাথে জং বাহাদুরের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়। নুর জামালের সংসার তেমন স্বচ্ছল ছিলনা। তাদের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে পরির সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরির সাথে জংবাহাদুরের নিয়োমিত মোবাইলে যোগাযোগ হতো।ভালো বাসার সম্পর্ক দৈহিক সর্ম্পকে গড়ায়। মাঝে মধ্যে জংবাহাদুর রাতে দোকান বন্দ করে অতিগোপনে পরির বাড়ীতে রাত্রি যাপন করতো। পরির স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। পরি ও জংবাহাদুরের সম্পর্ক এলাকার অনেকের চোখ এড়াতে পারে নাই। স্থানীয় অঙ্গার পাড়া গ্রামের জনির সাথে পরির পরিচয় হয়। জনির মাধ্যমে পরির সাথে হুমায়ূনের পরিচয় হয়।হুমায়ুন একা একা অথবা জনির সাথে মাঝে মধ্যে পরিদের বাড়ীতে যেত। জনি ও মিজান পরস্পর খালাতো ভাই। আনিছ ও পরি একই স্কুলে পড়তো বিধায় পূর্ব হতেই তাদের দু’জনের পরিচয়। এই ভাবে পরির সাথে বেশ কয়েক জনের পরিচয় হয়।আস্তে আস্তে পরি ও জংবাহাদুরের অবৈধ প্রেমের ভুবনে তারাঅনুপ্রবেশ করে।অনুপ্রবেশকারীদের অবস্থান মজবুত করতে ও জংবাহাদুরকে বিতারিত করার লক্ষে পরিকে হাতে নেয়। এ দিকে পরি অল্পবয়স্ক নাগরদের সান্নিধ্য পেয়ে বয়স্ক জংবাহাদুরের কাছ থেকে দুরে যেতে থাকে। অনেক দিন অনেক আশা নিয়ে জংবাহাদুর প্রেমিকার বাড়ী আসলেও অনুপ্রেবেশকারীদের উপস্থিতির কারণে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যেতে হয়। ফলে জংবাহাদুর তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়। অপর পক্ষে অন্যরা জংবাহাদুরের সাথে পরির সর্ম্পক মেনে নিতে পারেনা। ঘটনার ২০/২২ দিন পূর্বে জং বাহাদুর একদিন পরির বাড়ীতে গিয়ে জনির সাথে মেলামেশার কারণে পরিকে থাপ্পড় মারে।পরি বিষয়টি কি ভাবে নিল বুঝাগেল না। তবে পরির বন্ধুরা বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। প্রেমিকার গায়ে হাত?তারা জান দিতে প্রস্তুত প্রতিশোধ নিবেই। প্রেমিকার সামনে নিজেদেরকে প্রকাশ করার এইতো মোক্ষম সময়।তাদের আগ্রহ দেখে পরির মনে প্রতিহিংসার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হলো।দপ করে জ্বলে উঠলো। পৃথিবীর শুরুতেই নারীর জন্য ভাইভাইকে হত্যাকরেছিল। আর এটা ছিল প্রথম হত্যা। এরপর পৃথিবীতে যত হত্যা হয়েছে সিংহভাগ নারীর জন্য।নারীর প্রেমে যুবরাজ নির্বাসিত হয়েছে রাজা রাজত্ব ত্যাগ করেছে। কত পুরুষ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা-বোধ করে নাই।জংবাহাদুর-পরির সাজানো গোছানো অবৈধ সংসারে প্রকাশ্য হায়নাদের আক্রমন মেনে নিতে না পারলেও প্রতিহত করার ক্ষমতা ছিল না। প্রথমত জংবাহাদুরের সর্ম্পক ছিল অসম। যেসর্ম্পক যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। জংবাহাদুর অন্য এলাকার হওয়ায় তার প্রভাবছিল কম।এই অবস্থায় পরি তাদেরকে সুযোগ না দিলে জংবাহাদুর একছত্র পরির জীবনে রাজত্ব করতো।জংবাহাদুর প্রতিপক্ষের সাথে পেশীশক্তি ও আর্থিক ক্ষমতায় না পারার কারনে তার যত ক্ষোভ দুর্বলের উপর পড়ে। তাই যে হাতে পরিকে আদর-সহাগ করার জন্য কাছে টেনে নিত সেই হাতেই পরির গালে চড় মেরে দুরে সরে দেয়।এই ঘটনায়পরির উপস্থিতিতে জনি, মিজান, আনিছ, রোকন, হুমায়ন ও রফিক জংবাহাদুরকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরির দায়িত্ব জংবাহাদুরকে মোবাইলে বাড়ীতে ডেকে নিয়ে যে কোন অজুহাতে তার সাথে ঝগড়া করে তখনই বাড়ী থেকে বের করে দিবে।পরবর্তি কাজ তাদের। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী,ঘটনার দিনসন্ধ্যার পর পরি, জংবাহাদুরকে ফোন দেয়। পরির ফোন জংবাহাদুরের শরীরে বৈদুতিক তরঙ্গায়ীত হয়ে মনে শক লাগে। জংবাহাদুর মুহুর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। প্রেমিকার মোবাইল পেয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।অনেক কষ্টেনিজেকে সামাল দিয়ে কিছু বলার আগেই অপর প্রান্ত থেকে বলেরাতে বাড়ী আসলে সাক্ষাতে সব কথা হবে বলেই মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।জংবাহাদুর একাধিক বার ফোন দিলে মোবাইল বন্ধ পায়। দোকান বন্ধ করে আফছা অন্ধকারের মধ্যে পরির বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়।রাত্রি আনুমান ১১.০০ ঘটিকায়জংবাহাদুর পরির বাড়ীতে পৌঁছে। পরি বিভিন্ন কথার ছলে ঝগড়া শুরু করে এবং সংগে সংগে বাড়ী থেকে বের করে দেয়।এদিকে জনি, মিজান, আনিছ, রোকন, হুমায়ন, রফিক এবং অপরিচিত একজনজংবাহাদুরকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিদের বাড়ীর পাশে জঙ্গলে উৎপেতে থাকে। শিকারীর তীরে রক্তাক্ত আহত পাখির ন্যায় জংবাহাদুর পরির বাড়ী হতে বের হয়ে আসে। আকস্মিক হায়নার দল আক্রমন করে। জংবাহাদুর বুঝার আগেই ধরাশায়ি হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছোরা দিয়ে আঘাত করে এবং গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করে। পরে মৃতদেহ লোকচক্ষুর আড়ালে রাতের আধারে হাফ কিলোমিটার দূরে রাস্তায় ফেলে আসে। পিবিআই ঘটনা উৎঘাটন করে প্রকৃত অপরাধীদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করতে পেরেছে। যুগ যুগ ধরে তারা আপন জন ও সমাজের চোখে হত্যাকারী হিসাবে বিবেচিত হবে। এটাই শেষ নয় আইনে পুলিশকে অপরাধীর বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বটে তবে অপরাধীর বিবেকের বিচারের ক্ষমতা রহিত করেনি। সেই বিচারে অপরাধীর অপরাধ বোধ আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে। লেকক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অবঃ)।