বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
দৈনিক আজকের সংবাদ পত্রিকার সংবাদ পড়তে এখন থেকে আমাদের নতুন ওয়েবসাইট www.dailyajkersangbad.com ভিজিট করুন। টাংগাইল বন বিভাগের দোখলা সদর বন বীটে সুফল প্রকল্পে হরিলুট আগ্রাবাদ ফরেস্ট কলোনী বালিকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেন মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী ফৌজদারহাট বিট কাম চেক স্টেশন এর নির্মানাধীন অফিসের চলমান কাজ পরিদর্শন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে: শেখ সেলিম সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র চলছে সীমাহীন অনিয়ম এলজিইডির কুমিল্লা জেলা প্রকল্পের পিডি শরীফ হোসেনের অনিয়ম যুবলীগে পদ পেতে উপঢৌকন দিতে হবে না: পরশ নির্বাচন যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পেশি শক্তির মানসিকতা পরিহার করতে হবে: সিইসি

সত্য ঘটনা অবলন্বনে

মোঃ আবু বকর সিদ্দিক পিপিএম
  • প্রকাশিত সময় : মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১
  • ১৩৭১ পাঠক পড়েছে

বিরোবাড়ী রেলওয়ে ষ্টেশনের বহি সিগনালের পাশে রেল লাইনের উপর ৪৫/৫০ বৎসর বয়সী এক ব্যক্তির দেহ ট্রেনে কেটেখন্ড বিখন্ড হয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়ে আছে । কাকডাকা ভোর । ১৩ ডিসেম্বর /২০১৬। কুয়াশার চাদরে ঢাকা ধরণী । সূর্যের তেজস্ক্রীয় প্রকৃতির কাছে হার মেনে আহত পাখির মত চুপটি মেরে আছে। অথচ জনমানবের শোরগোলে কুয়াশার চাদর ভেদ করে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ছোট বড় বৃদ্ধ পুরুষ-মহিলা কাঁথা চাদোর মুরি দিয়ে পিপিলিকার ন্যয় সারি বেধে বিরোবাড়ীর দিকেযায়। কেউ কেউ ফিরে আসতে আসতে বলে“আহা! কার মায়ের বুকের ধন, সর্বনাশা ট্রেন কেঁড়ে নিছে।” সময় অতিবাহিত হয়। সূর্য তার আগমন বার্তা সকলকে জানান দিচ্ছে। কূয়াশা ধরণীতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। অনেক দূর থেকে মানুষের জটলা দেখা যায়। মনপুর গ্রামের আমেনা বেগমের চোখে ঘুম নাই। ছোট ছেলে মেয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বামী বাড়ী আসেনি। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রাতের ১ম প্রহর ২য় প্রহর তৃতীয় প্রহর শেষ হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে প্যাঁচার ডাক কানে তীক্ষন আঘাত লাগে। আজ ঝিঝি পোকার সুরেলা আওয়াজও বেসুুর হয়ে গেছে। সারা রাত উঠা, বসা,ঘরের মধ্যে পায়চারী করতেকরতে কখন রাত শেষ হয়ে যায় বুঝতে পারে নাই। একটু শব্দ হলেই এই বুঝি এলো দরজা খোলে এদিক ও দিক উকি-ঝুকি মারে। কুয়াশা ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনা। সাদা শুভ্র কুয়াশার চাদর দিয়ে সারা পৃথিবী ঢাকা। মনে হয় অনেক দিন এরকম কুয়াশা দেখেনি। আজকে একটু বেশী।স্মৃতির অতল গহীন থেকে অনেক কথাই মনে পরে। বিয়ের কিছুদিন পর হতেই বুঝতে পারে স্বামী জুয়া খেলে। ১৮ বৎসরের সংসার জীবনে ৪ জন ছেলে-মেয়ে জন্ম দেয়। অল্পবয়সে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। জুয়া না খেলার জন্য কতবার বলেছে।মেয়ের বিয়ে হয়েছে। অবশেষে তাশ দিয়ে জুয়া খেলা বন্ধ হলেও মাঝে মধ্যে ঘোড়দৌড়ে জুয়া খেলে। আগে এই নিয়ে কম ঝগড়া হয়নি। কতদিন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হয় জুতা-সেন্ডেল না হয় কাপড় চোপর বা সারা শরীর ভিজে বাড়ী আসতো। নিজের যৎসামান্য যে গহনা ছিল বিক্রি করে বাড়ীর অদুরে একতা বাজারে মুদি দোকান করে দিয়েছে।কিছুদিন হলোও পাড়ার মাষ্টারের বউ্ এর কাছ থেকে সুদে টাকা এনে অন্যর কাছে সুদে টাকা খাটায়।এ নিয়েও কানাঘোষা কম নাই। দুরে কোথাও গেলে বলে যায়। কিন্তু আজ ! ঘুম থেকে উঠে ছেলে বলে মা, বাবা আসেনি? না বাবা। তাদের মধ্যে তেমন কোন অনুভুতি নাই। সকাল অনুমান ১০.০০ টার দিকে লোক মুখে জানতে পারে যে, ১৫/১৬ কিঃমিঃ দুরেবিরোবাড়ী রেলওয়ে ষ্টেশনের বহি সিগনালের পাশে রেল লাইনের উপর এক ব্যক্তির দেহ ট্রেনে কেটে কয়েক টুকরা এলো মেলো ভাবে পড়ে আছে । কেউ চিনতে পারেনি। এই সংবাদ শুনে ছেলেকে নিয়ে উন্মাদের ন্যয় বিরোবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিরোবাড়ী পৌছে লাশের কাছে বহু লোকজন ও পুলিশ দেখতে পায়। লোক জনের ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই লাশের ছেড়া-কাটা জামা ও লুঙ্গিদেখে চিৎকার করে বলে উঠে এইডা তো আমাগো পোলার বাবা।চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ছেলেও চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এখন সকলের চোখ মা-ছেলের দিকে। পুলিশ আশ্বস্ত হলো, যাক লাশের পরিচয় জানা যাবে। পুলিশ তাকে ডেকে একটু দুরে নিয়া জিজ্ঞাস করে আপনার কে হয়। আমার স্বামী। নাম কায়রুল। বাড়ী মনপুর গ্রামে।“ মারা গেল কেন? বাড়ীতে কোন ঝগড়া হয়েছিল কিনা। অন্য কোন অশান্তি ছিল কি না মানুষিক রুগী কিনা।” স্যার এই তা কিছু না। বাজারে একটা মুদির দোকান ছিল। পাঁচ জনের সংসার কোন রহম চলতো। তার একটু জুয়া খেলার অভ্যাস ছিল। একজনের টাকা অন্যজনের কাছে সুদে লাগায়। শুনতাম এই নিয়া মাঝে মধ্যে ঝগড়া হতো। গত কালসন্ধ্যা অনুমান ৬.০০ঘটিকায় লাবিব ও সিরাজ আমাগো বাড়ী যায়। পুলার বাবার লগে কথা কয়। টাকা পয়সার ব্যাপারে মনে হয়।তারে লগে লইয়া যায়।” স্বামী বাড়ীতে না আসায় রাত্রে আমেনা বেগম একতা বাজারে মুদির দোকানে যায়। দেখে তার দেবর দোকানে বসা। কায়রুলের মোবাইল র্চাজে দেওয়া। কায়রুল কোথায় গিয়েছে বলতে পারে না। দোকান খোলা তাই দোকানে বসে আছে। দোকান বন্ধ করে বাড়ী যায়। পরের ঘটনা তো এই ……। পরদিন লাশের পোস্টমর্টেম হয়। স্বামীর মৃত দেহ বাড়ী নিয়া যথাযথ ধমীয় বিধানে দাফন সর্ম্পূণ করে। আমেনা বেগম বুঝতে পারে সুদের টাকা লেনদেনে তার স্বামীর সাথে এলাকার বেশ কিছু লোকের সাথে বিরোধ ছিল। লাবিব ও সিরাজ বাড়ী থেকে ডেকে নেয়। তারা তাকে হত্যা করতে পারে। এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ১। লাবিবুর রহমান ২।তুরুজ ৩। রতন ৪। জালাল ৫। সিরাজ ৬। হাসান৭। রবি ৮। হক গণের বিরুদ্ধেআদালতে মামলা করে। আদালতের আদেশে থানায় হত্যা মামলা হয়। থানা পুলিশ মামলা তদন্ত করা অবস্থায় তদন্তে দক্ষসিআইডি মামলার তদন্ত ভার গ্রহন করে। সিআইডি দীর্ঘদিন মামলা তদন্ত করে। ইতিমধ্যে ময়না তদন্ত রিপোট প্রাপ্ত হয়। ডাক্তার মহোদয় প্রথম মতামত দেন “ Death due to haemorrage and shock cause of death is pending still visera report”পরে ভিসেরা রিপোটে “ বিষ পাওয়া যায় নাই।” মতামত পাওয়া যায়। পরবর্তীতে চুড়ান্ত মতামতে উল্লেখ করেন দুঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারের রিপোর্টে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ১। দেহের গুরুত্ব র্পূণ স্থান গলার উপরি ভাগে তিনটি ও বাম পাজরে একটি ছিদ্রযুক্ত জখম হলো কি ভাবে? ২। ট্রেনে কাটা হলে ভিসেরা রিপোটের প্রয়োজন কি? ৩। মৃত্যুর আগে ট্রেনে কাটা না মৃত্যুর পরে ট্রেনে কাটা পোস্টমর্টেমে জানার কথা।এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞেরদায়সারা কাজে আগ্রহী বেশী থাকায় বহু হত্যাকান্ড ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সিআইডি তদন্ত কালে বাদীর অভিযোগ, ট্রেনে কাটা হলেও বিশেষ স্থানে আঘাতের চিহ্ন, ঘটনার দিন দুইজন ব্যক্তি ডেকে নেয়া এইসকল বিষয় আমলে না নিয়ে ডাক্তারের রিপোর্টের ভিত্তিতে এজাহার নামীয় সকল আসামীকে বাদ দিয়া ট্রেন দুঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মর্মে চুড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। বাদিনীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পিবিআই মামলার তদন্ত ভার গ্রহন করে। পিবিআই মামলা তদন্ত কালে সুরতহাল রিপোর্ট, ময়না তদন্ত রিপোর্ট, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বিভিন্ন লোকের নিকট প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে যে সকল বিষয় গুরুত্বের সাথে নেয় তা হলো ১। মৃতের স্ত্রী আমেনা বেগম কেন একই গ্রামের আট জনকে আসামী করে কোর্টে মামলা করে, ২। সুরতহাল রিপোর্টে গলার উপরি ভাগে তিনটি ও বাম পাজরের নিচে একটি গোলাকার ছিদ্র যুক্ত রক্তাক্ত জখম হলো কি ভাবে ৩। কেন সে ঐখানে গেল? ৪। কখন থেকে দোকানে অনুপস্থিত হয়? ৫।সুদের টাকার উৎস ও আদান প্রদানে কোন বিরোধ ছিল কি না ৬। জুয়া খেলা নিয়ে কোন বিরোধ ছিল কিনা ৭। পারিবারিক বিরোধ ছিল কিনা ৮। আত্মহত্যা করার কোন যথাযথ কারণ ছিল কিনা এই বিষয় গুলি বিবেচনায় নিয়ে তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ দুইটি কারণ আবিস্কার করে ১। মৃত কায়রুল নিদিষ্ট তিন চার জনের নিকট থেকে সুদে টাকা এনে সেই টাকা অধিক সুদে অন্যত্র দেয়। কেউ নিদিষ্ট সময়ে সুদ বা মূল টাকা দিতে না পরলে খারাপ ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করে। এইভাবে এলাকার অনেককে ক্ষতি গ্রস্থ করে। ফলে তার প্রতি কিছুলোক ক্ষিপ্ত ছিল। তার মধ্যে তুরুজ একজন। কায়রুলের প্রতিবেশী এক মহিলার নিকট থেকে টাকা নিয়ে অন্যত্র সুদে খাটায়। উক্ত মেয়ের স্বামী একজন শিক্ষক। চাকরী করার সুবাদে সিলেটে থাকেন। টাকা লেনদেনের মধ্যে দিয়ে একটা সম্পর্ক হয় যা পরবর্তিতে পরকিয়ায় রুপ নেয়। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে মতি মাষ্টার ও তার ভাতিজা লাবিবুর ও মিলন মিলিত ভাবে কায়রুলকে মতি মাষ্টারের বাড়ী যেতে নিষেধ করেছিল। পিবিআই ময়মনসিংহ সাবিক অবস্থা বিবেচনা করে মতি মাষ্টারের ভাতিজা মিলনকে গ্রেফতার করে। পিবিআই অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার আদিঅন্ত বিস্তারিত বর্ননা করে। মতিমাষ্টারের স্ত্রীর কাছে কারণে অকারণে আসা যাওয়া করায় সমাজে তারা হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছিল। বাধা নিষেধ করলেও না মানলে গত ১০/১২/১৫ তারিখ আছরের নামাজের পর মতি মাষ্টারের নেতৃত্বে ১। লাবিবুর রহমান ২। তুরুজ ৩। রতন ৪। জয়নাল ৫। সিরাজ ৬। মিলনগণ সিরাজের টিনের দোকানে কায়রুলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ঘটনার দিন ১২/১২/১৫ তারিখ সন্ধা অনুমান ৬.০০ঘটিকায় লাবিব ও সিরাজ মিলে কায়রুলেরবাড়ী গিয়া তুরুজের নিকট পাওনা টাকার ব্যপারে বিরোবাড়ী রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে বৈঠকের কথা বলে একতা বাজারে নিয়া আসে।সুচতুর অপরাধীরা কেউ যেন সন্দেহ না করে তাই কায়রুলকে আলাদা বিরোবাড়ী বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কায়রুল নিজ দোকানে গিয়ে মোবাইল র্চাজে দিয়ে অটোরিক্সায় বিরোবাড়ী বাজারে যায়।মতি মাষ্টার একতা বাজারে থেকে যায় এবং অন্যান্য অপরাধীরা আলাদা আলাদা ভাবে বিরোবাড়ী পৌছে। সেখানে সকলে বসে নাস্তা খায়। রাত একটু ভার হলে সকলে মিলে বিরোবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যায়। পথিমধ্যে সরিষাক্ষেতে নিয়ে সকলেই এক সাথে কায়রুলকে শ্বাস রোধ করেও পরে ধারালো ছোড়া দিয়া হত্যা করে। এই হত্যাকে অন্য খাতে নেওয়ার জন্য মৃত কায়রুলের লাশ অত্যন্ত সর্তকতার সাথে নিয়া রেলওয়ে লাইনের উপর রেখে যায়। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে ট্রেনে কেটে দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। পিবিআই সুস্পষ্ট একটা মৃত মামলাকে মেধা, শ্রম, ধের্য্য ও সততা দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করে অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় এনেছে। আদালতে বিচারে কি হবে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা নিজে জানেন কিন্তু হত্যাকারী হিসাবে নিজের আত্নীয় স্বজন ও সমাজের কাছে আমৃত্যু হেয় প্রতিপন্ন হবে। এটাই বিবেকের বিচার।পিবিআই অন্য যে কোন তদন্ত সংস্থা হতে ভিন্ন। তাদের পেশাদারিত্ব মানুষের আস্থার জায়গা। যুগ যুগ ধরে মানুষের আস্থা ধরে রাখবে এটাই সকলের কাম্য। লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অব:)

নিউজটি শেয়ার করে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019-2020 । দৈনিক আজকের সংবাদ
Design and Developed by ThemesBazar.Com
SheraWeb.Com_2580