‘কানা জাম্বুরা গাছ চিনেনা, কানার হাতে কুড়াল দিওনা’। ঠাডা মালেক নামক জনৈক অন্ধ হকার এ গানটি দিয়ে ঔষধ বিক্রয় শুরু করতেন। অন্ধের কুড়ালের কাছে সুস্বাদু এই জাম্বুরা গাছ যেমন নিরাপদ নয়। ঠিক তেমনি প্রধামনন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের লালসার কারণে প্রশ্নের মুখে। সেই সাথে হুমকির মুখে সরকারের ভাবমূর্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম নির্বাচনী ইশতেহার “আমার গ্রাম আমার শহর”। জাতির জনক বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনারবাংলা বাস্তবায়নের দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখে এগিয়ে চলছে এই প্রকল্প। যা স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো: তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পার্যায়ে একটি জাতীয় কমিটির পর্যালোচনা, মতামত ও সুপারিশ আলোকে সাজানো হচ্ছে। মডেল হিসেবে ১৫টি গ্রামকে ঘিরে শুরু হচ্ছে কর্মকান্ড। প্রকৌশলী আবুল মনজুর সাদেক পিডি হিসেবে যার তদারকিতে।
রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁ ও শেরাটনে এ প্রকল্পের বেশ কয়েকটি সুয়োগ সেমিনারে অংশ গ্রহনের সুযোগ হয়েছে আমার। সচিবালয় ১৯টি মন্ত্রনালয়ের সচিবের উপস্থিতিতে দিকনির্দেশনা মূলক আলোচনায় শুনেছি মুল্যবান মতামত। সভা সেমিনার আধুনিক সুযোগ সুবিধা ও ইট পাথরের ইমারতের উন্নয়নের দিকনির্দেশনা সুপারিশ থাকলেও ন্যায় বিচার ও সুশাসনের বিষয়টি তেমনটা স্থান পায়নি। মডেল হিসাবে বাংলাদেশের আদর্শ একটি গ্রামের নামও উদাহারণ হিসেবে সামনে আসেনি। গ্রামীণ পর্যায়ে সুশাসন, মানবিকতা, নীতি নৈতিকতা এখন তলানীতে। অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি এসব নীতিকথা দৃষ্টান্ত হিসিবে সামনে আনেনা। চেয়ারম্যান, মেম্বার মনোনয়নের ক্ষেত্রে কাউন্সিলের হয়না প্রয়োজন। পেশীশক্তি, কালো টাকার মালিক ও তেলবাজিই প্রাধান্য পাচ্ছে মনোনয়নে। নির্বাচনের পর এসব জনপ্রতিনিধিদের কাছে মানবিক ও নীতিনৈতিকতার আশা করাটা দুরহ। কারণ সুন্দর ফুল বাগানে করলা চাষাবাদ করলে এর স্বাদ তিতাই হবে। আঙ্গুরের স্বাদ পাওয়া যাবে না।
উদ্বেগের বিষয় গতমাসে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পুলিশের তালিকাভুক্ত ১৮জন মাদক ব্যবসায়ী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে। তৃতীয় ধাপে নির্বাচিত হওয়ার অপেক্ষায় আরো অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধি। তাদের কালো টাকার কাছে অসহায় ছিল আওয়ামীলীগের পরিক্ষিত, সৎ ও ত্যাগী কর্মীরা। এরশাদের শাসনামলে মাদক সম্রাট মাফিয়া কিং এজাহার কোম্পানীর কার্যকলাপ অনুসন্ধানে কয়েকদফা টেকনাফ গিয়েছিলাম। তার ছেলে বদি গত সংসদে আওয়ামীলীগের মনোনীত এমপি ছিলেন। মাদক ব্যবসা সহ বিভিন্ন নেতিবাচক ভাবমূর্তির জন্য এবার তাকে মনোনয়ন না দিয়ে বদির স্ত্রীকে বানানো হয়েছে এমপি। অনেকের মতে কক্সবাজারে প্রায় শতাধিক নব নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের নেটওয়ার্ক সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃতি লাভের আশংকা বিদ্যমান। যা প্রধানমন্ত্র্রীশেখ হাসিনার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ইতিবাচক প্রকল্পের জন্য অশনি সংকেত। কারণ ইট পাথরের উন্নয়নে গ্রাম গুলো চাকচিক্য হবে সত্য। কিন্তু আলোকিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া সুশাসন কায়েম অসম্ভব নয়।
গ্রামের উন্নয়নের জন্য পাঁচতারকা হোটেলে সেমিনার ও বিদেশে প্রশিক্ষনের আপতত আর প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের দুটি গ্রামকে ইতিবাচক মডেল হিসেবে সামনে আনা যায়। একটি নরসিংদীর আড়াইহাজার উপজেলার মানার। অন্যটি নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া গ্রাম। যার চিত্র অনেকটা রূপকাহিনীর মতো। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, সবুজ-শ্যামল, অপরূপ ও মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত ধান খেত আর প্রকৃতি। অধিকাংশই উচ্চশিক্ষায় আলোকিত। এখানে নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। নেই ঝগড়া-বিবাদ। সুখে-দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো তাদের মূল বৈশিষ্ট্য। অবাক করা তথ্য হলো, গত ২০০ বছরেও এই গ্রামে কখনো পুলিশ আসার প্রয়োজন হয়নি।
জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা ও শান্ত গ্রামটি চলনবিলবেষ্টিত ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত। আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। জনসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার, ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৬০০। একটি মসজিদ, মন্দির, কওমি মাদরাসা, ডাকঘর, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে গ্রামটিতে। হাই স্কুলটিতে আগামী প্রজেন্মের মাঝে গণতান্ত্রিক চর্চা লালনের জন্য রয়েছে ছাত্র সংসদ।
১৯১৪-১৫ সালে প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। বন্যার পর অনেক চাষি ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন সদস্যকে ডেকে সভা করেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তারা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়েই গ্রামের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত সেই পরিষদই আজ ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে পরিচিত।
এই সংগঠনের মাধ্যমে গ্রামটি নিজস্ব ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে রয়েছেন- একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস-চেয়ারম্যান, ২১ জন নির্বাহী সদস্য ও পাঁচজন উপদেষ্টা। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। অনুরূপ ইতিবাচক সুশাসন প্রবাহিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার মানার গ্রামে। এ গ্রামেও আজ পর্যন্ত পুলিশ ডাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়নি। এ দুটি গ্রামকে মডেল হিসেবে গ্রহন করলে সমাজে সুশাসন ও ন্যায় বিচারের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হবে। পাশাপাশি টুঙ্গিপাড়ার খালগুলোর দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যবর্ধন, সংরক্ষণ ও সংস্কারের মডেল হতে পারে “আমার গ্রাম আমার শহর” প্রকল্পের জন্য গাইড লাইন।