বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সামরিক প্রধান, মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ১০৩ তম জন্মবার্ষিকি ছিল ১ সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন৷ ঐ ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন৷অনেক ইতিহাস তাত্বিকের দাবী বঙ্গবন্ধু, ২৫ শে মার্চের কালোরাতের আগে গ্রেফতার হবার আগেই এম এ ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে লিখিতভাবে নিয়োগ দেবার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিয়ে যান। কেননা, তখন ওসমানী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যান্ত ঘনিষ্ট ও তাঁর দলের নির্বাচিত সাংসদ।
১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সিলেটের এ কীর্তিমান সন্তান। ব্যাক্তিগত জীবনে অবিবাহিত কঠোর নিয়মানুবর্তী, আদর্শে অবিচল মানুষটি ছিলেন আজীবন গণতন্ত্রী, ধার্মিক ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। তাঁর নামটি বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন, তেমনি স্বাধীন দেশেও জাতির দুঃসময়ে কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এই বঙ্গবীর। বহু ক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতিকে নির্ঘাত সংঘাত থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি দু’বার জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। সিলেটে রয়েছে বঙ্গবীর মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত ওসমানী জাদুঘর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির সহজ-সরল জীবনযাত্রার এক জীবন্ত সাক্ষী ওসমানী জাদুঘর। নগরীর ধোপাদীঘির পাড় এবং নাইওরপুলের মাঝামাঝি জায়গায় বঙ্গবীর-১ নম্বর বাসাটির গেটের সামনে দাঁড়ালেই হাতছানি দেবে ওসমানী জাদুঘর। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধোপাদীঘির পাড়ের বঙ্গবীর ওসমানীর এ পৈতৃক বাড়িটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে ধংস্ব করে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ উদ্যোগে বাংলো টাইপ ঘর নির্মাণ করেন সেখানে।
১৯৭৬ সালের ১৮ মে এ বাড়ির ২ বিঘা জায়গা দিয়ে তিনি তার বাবা-মার নামে গঠন করেন জুবেদা খাতুন খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়। একই সঙ্গে ঢাকার ধানমন্ডির রোড ১০-এ, বাড়ি নং ৪২-এর সুন্দরবন নামক ওসমানীর নিজস্ব বাড়ির সম্পত্তি দিয়ে আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে গঠন করা হয় ওসমানী ট্রাস্ট। তিনি মাত্র দু’টি ব্যাটালিয়ান থেকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংখ্যা ছয়টিতে বৃদ্ধি সহ সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালীর সংখ্যা ২ থেকে ১০ এর অধিক করা এবং বাঙালীদের জন্যে নির্দিষ্ট সংখ্যা অনুপাতে কমিশন ও অফিসার পদসহ সর্বস্তরে বাঙ্গালী সিনিয়রদের জন্য পদ সংরক্ষণ করেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় বাংলা কবিতা ‘চল চল চল’ কে পাকিস্তান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ সঙ্গীত হিসাবে অনুমোদন লাভে সফল হন। এ ছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাদ্যযন্ত্র সংগীতে সরকারী ভাবে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ এ দুটি বাংলা গান প্রচলন হয় তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল।
এজন্যে তাকে Father of the regiment বলা হয়। তিনি বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ন্যায়হীন ও বৈষম্যমূলক আচরণ ও ব্যবহারে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তাকেঁ মন্ত্রীসহ উচ্চ পদে যোগদানের আমন্ত্রন জানালেও গ্রহণ করেননি তিনি। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে ওসমানী তাঁর আসন থেকে ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে তিনি প্রতিবাদস্বরুপ সংসদ সদস্যপদ এবং আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদও ত্যাগ করেন। অথচ, সেই সময়ে বাঘা বাঘা মন্ত্রী রাজনীতিকরা তো বটেই, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসানের মতো বরেন্য শিল্পীরা রীতিমত নিজেরা ঢোল বাদ্যের তালে নেচেঁ গেয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়) বাকশালকে স্বাগত জানান। গ্রহন করেন বাকশালের সদস্যপদ। উদাহরনটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য, নিজের নীতিবোধের সাথে ওসমানীর অটল-অবিচল থাকবার বিষয়টি বোধগম্য করবার প্রয়াসে। অবশ্য, জাতির জনককে নিমর্মভাবে হত্যার পর সে বছরের ২৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যায় সন্দেহাতীতভাবে সম্পৃক্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন ওসমানী।
মোশতাকের মন্ত্রীসভায় উপদেষ্টা হওয়া প্রসংগে তিনি পরবর্তীতে সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, আর রক্তপাত ও হত্যা এড়াতে, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। তবে, ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার পরই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন ওসমানী । ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী জাতীয় জনতা পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন অবস্থায় ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রয়েল লন্ডন হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন এই মহাবীর। জেনারেল ওসমানীর যখন মৃত্যু হয়, সে সময়টি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ইতিহাস থেকে বিস্মৃত ও বিকৃত দেবার স্বর্ণযুগ।
ছবি তোলা ও অবসর সময়ে বই পড়া ছিল তাঁর শখ। নিজের টাইপরাইটারে টাইপ করে মুক্তিযুদ্ধ, তৎপরবর্তী সময়-বাস্তবতা ও নিজের জীবন নিয়ে দীর্ঘ পান্ডুলিপি লিখেছিলেন তিনি। তাঁর সামরিক সহযোগী লে. কর্নেল ( অব) এ আর চৌধুরীর বয়ান বা জবানিভিত্তিক লেখা থেকে জানা যায়, ওসমানীর মৃত্যুর পর পান্ডুলিপিটি রহস্যজনকভাব আর খোজেঁ পাওয়া যায়নি। পান্ডুলিপিটি পাওয়া গেলে জানা যেত, পাপা টাইগার খ্যাত এ বিনয়ী ও একই সাথে মেজাজী কর্মকর্তা কোন পক্ষের কূটচালে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্টানে অনুপস্থিত ছিলেন। তার স্মৃতিলেখ্য পাওয়া গেলে যুদ্বোত্তর দেশের ইতিহাসের বাঁক-বদলের অনেক অপ্রকাশিত অধ্যায়ের দ্বার খুলত। তেমনি জানা সম্ভব হত, ব্যাক্তি এম এ জি ওসমানীর জীবনের নানা অজানা আখ্যানের।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ অসম সাহসী এ নন্দিত নায়কের ছিল না সংসার। সঙ্গত কারনে তাঁর নেই পারিবারিক বা রাজনৈতিক উত্তরাধীকারও। তাঁর প্রতিষ্টিত দলটিও নিভূ-নিভূ। তাই মহাবীর ওসমানীর নামটি যেভাবে উচ্চকিত কন্ঠে উচ্চারিত হবার কথা ছিল, তা হয়নি, হচ্ছে না। নতুন প্রজন্মের অনেকে জানেন না এ কীর্তিমানের বীরত্বগাঁথা; ইতিহাসের ক্রেডিট ছিনতাইয়ের দেশে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে সমর যুদ্ধের রূপকার, প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক, আদর্শ ও আত্মমর্যাদায় অটল-অবিচল মহাবীরের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ। বাংলাদেশের সব সরকারের আমলের আত্মপ্রচারের ইতিহাসের অপ-রাজনীতি আপনার মতোন বীরদের বীরত্বগাঁথা বিস্মৃত করুক, তবু ইতিহাস আপনাকে পুনঃ শ্রুত করে স্মরন করবে-ই, নির্মোহ সত্যের অনিবার্য প্রয়োজনে। জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বীর। আমরা আপনাকে ভালবাসি, যুগে যুগে বেসে যাব। (লেখক: ড. মো: আবু তারিক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং একজন গর্বিত মুক্তিযুদ্ধা)।